কলেজের পরিবেশটা–
–"সকাল থেকেই জমজমাট। ফার্স্ট ইয়ার নতুন ব্যাচ ভর্তি হয়েছে, আর তাদের ভিড় যেন পুরো ক্যাম্পাসকে এক নতুন প্রাণ দিয়েছে। চারদিকে কোলাহল, হাসাহাসি, কেউবা পথ হারিয়ে দিক জিজ্ঞেস করছে, কেউ আবার ক্লাসরুম খুঁজছে।
কলেজ এর গেইট দিয়ে হাঁটার সময় হঠাৎ আমার চোখ থমকে গেল।
সামনে দাঁড়িয়ে আছে এক মেয়ে—কলেজ ড্রেসে, চুলগুলো খোলা, কপালের সামনে কয়েকটা এলোমেলো আঁচল যেন বাতাসে উড়ছে। চোখ দুটো যেন একেবারেই ভিন্ন—যেখানে সারল্য আর দীপ্তি একসাথে খেলে বেড়াচ্ছে। ঠোঁটের কোণে এক অদ্ভুত মিষ্টি হাসি।
মুহূর্তেই আমার বুকের ভেতর কেমন যেন কেঁপে উঠল। আমি থেমে গেলাম, অথচ কেন থেমেছি তার উত্তর তখন আমার নিজের কাছেই ছিল না।
মনে হলো, তার রূপকে শব্দে আঁকা যায় না। যেন কোনো কবি কলম থামিয়ে দেবে, কোনো চিত্রশিল্পী তুলি নামিয়ে ফেলবে। কারণ তার সৌন্দর্যকে ধারণ করার মতো শব্দ বা রং পৃথিবীতে নেই।
আমি—বিজয়। বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়া।
দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র আমি ।
প্রতিদিনের মতো কলেজে এসেছিলাম, মনে মনে ভেবেছিলাম, "নতুনদের ভিড় নিয়ে আজ খুব ঝামেলা হবে।" কিন্তু জানতাম না, সেদিনের সকাল আমার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সকাল হয়ে থাকবে।
সেই মুহূর্তে আমি এক অদ্ভুত সত্য উপলব্ধি করলাম—
ভালোবাসা সবসময় ধীরে ধীরে জন্ম নেয় না, কখনও কখনও তা বজ্রপাতের মতো হঠাৎ আঘাত হানে। আর আমি সেই আঘাতে মুহূর্তেই জড়িয়ে পড়লাম।
আমি তাকিয়ে রইলাম, অথচ কথা বলতে সাহস হলো না। হয়তো সিনিয়র-জুনিয়র ভদ্রতা, হয়তো ভেতরের অচেনা ভয়।
মেয়েটা কেবল পাশ কাটিয়ে হেঁটে গেল, কিন্তু আমার ভেতর রেখে গেল এক অদ্ভুত কম্পন।
তারপর থেকে প্রতিদিন কলেজে এলেই আমার চোখ খুঁজতে থাকতো তাকে। ভিড়ের মধ্যে কোথাও দাঁড়িয়ে থাকলে মনে হতো, পুরো পৃথিবীর রঙ হারিয়ে গেছে, শুধু ওর রঙটাই বাকি আছে।
সে হাসলে, আমার মনে হতো সময় থেমে গেছে। ক্লাসে নোট লিখতে লিখতেও তার মুখ ভেসে উঠত, রাতে বই খুললে তার চোখের দীপ্তি আমাকে পড়তে দিত না।
একদিন দেখলাম লাইব্রেরির সামনে দাঁড়িয়ে বই খুঁজছে। সাহস সেদিনও হয়নি কথা বলার, তবু মনে মনে ভাবলাম—
"যদি এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে পারতাম সারাজীবন, শুধু ওকে দেখেই।"
তাকে দেখলে যেনো মনের ভিতর এক সাহিত্যিক সাহিত্যিক ভাব জন্মে যায়। তাকে দেখে যাই কল্পনা করি তাই যেনো কবিতা
হয়ে যায় —
" তাকে দেখলে মনে হয়, গল্পেরা জীবন্ত হয়,
চোখ দুটো তার — যেন ভোরবেলা
দুধসাদা আলোয়।
চলনে ছন্দ, কথায় প্রেম, হাওয়ারাও পথ ভুলে যায়,
একটুখানি তাকালে মনে হয়— আবার
প্রেমে পড়া যায়।
দিনগুলো যত গড়াতে লাগল, আমার অনুভূতিগুলো তত গভীর হতে লাগলো। আমি বুঝে গেলাম—এটা কেবল মোহ নয়, এটা এমন এক ভালোবাসা যার শুরু আছে কিন্তু শেষ নেই।
আমি কাউকে কিছু বলিনি। বন্ধুরা বুঝতে পেরেছিল, কিন্তু ঠাট্টা করলে আমি এড়িয়ে যেতাম। অথচ ভেতরে ভেতরে আমি একটা জগৎ গড়ে তুলছিলাম—
যেখানে আমি আর সে, যেখানে কোনো সিনিয়র-জুনিয়র নেই, শুধু দুটো মানুষ একে অপরের জন্যই তৈরি।
প্রথম দেখার পর থেকে আমার জীবন যেন আর আগের মতো রইল না। প্রতিদিন কলেজে আসাটা হয়ে গেল নতুন এক অভিযানের মতো—একটা গোপন মিশন। ভেতরে ভেতরে আমার সব মনোযোগ ছিল একটাই জায়গায়, তাকে আবার দেখা যাবে কি না।
ক্লাসরুমের সামনে দাঁড়িয়ে থাকলেও চোখ চলে যেত সিঁড়ির দিকে, ও আসছে কি না দেখতে। ক্যান্টিনে গেলে চায়ের কাপ হাতে বসতাম জানালার ধারে, শুধু যেন হঠাৎ করে হেঁটে আসা তাকে চোখে ধরা যায়–
"তাকে দেখার লোভে কাটে না দিন,
চোখে তার প্রেম, মুখে নীরব বেদনাসিন।
হাসলে যেনো হৃদয় গলে যায় বিনা অনুমতিতে নিঃশব্দে, নীরব বিনিময়।
একদিন কলেজ ক্যান্টিনে দাঁড়িয়ে বন্ধুর সঙ্গে কথা বলছিলাম। হঠাৎ দেখলাম, ও কয়েকজন নতুন সহপাঠীর সঙ্গে হেসে হেসে গল্প করছে। সেদিন মনে হলো, আমি জীবনে কখনও এমন হাসি দেখিনি। সেই হাসি যেন চারপাশের কোলাহলকে ঢেকে দিল, একেবারে নিস্তব্ধ করে দিল আমার ভেতরটা।
বন্ধু খোঁচা মেরে বলল,
—“ওই দ্যাখ, নতুন ব্যাচে কিন্তু রাজকন্যা ঢুকছে!”
আমি কিছু বললাম না, শুধু মনে মনে বললাম, “ও তো শুধু রাজকন্যা নয়, আমার
পুরো পৃথিবী।”
একবার–
লাইব্রেরিতে ওরে একা দেখলাম। হাতে রবীন্দ্রনাথের বই “শেষের কবিতা”। আমি বুক কাঁপিয়ে ভেতরে ঢুকলাম, অন্য এক শেলফ থেকে বই হাতে নিলাম, অথচ চোখ বারবার চলে যাচ্ছিল ওর দিকে।
সেদিন আমি প্রথম শুনেছিলাম তার কণ্ঠস্বর। সে লাইব্রেরিয়ানকে বইয়ের নাম জিজ্ঞেস করছিল। স্বরটা ছিল নরম, অথচ স্পষ্ট, যেন গানের সুর।
আমার বুকের ভেতর চাপা আনন্দ জমতে লাগল।
আমি সাহস করে কিছু বলতে পারিনি, তবু মনে হচ্ছিল—আমি এক অমূল্য সম্পদ খুঁজে পেয়েছি।
সিনিয়র হওয়ার কারণে আমার ভেতরে একটা দ্বিধা সবসময় কাজ করত। আমি নিজেকে প্রশ্ন করতাম—
“এভাবে মুগ্ধ হয়ে থাকা কি ঠিক?”
“ও যদি আমাকে ভুল ভাবে?”
“একজন সিনিয়র হিসেবে আমার দায়িত্ব কি শুধু দূর থেকে দেখা?”
এই প্রশ্নগুলো আমাকে অস্থির করতো। তবু যখনই ওরে দেখতাম, সব দ্বিধা ভেঙে যেত। মনে হতো, ওর হাসির আলোয় আমার অন্ধকার মুছে যায়।
তাকে দেখলে মনে আমার শুধু অন্য রকম অনুভূতি কাজ করতো–
"তাকে দেখে মনে পড়ে ধাক্কা,
চোখে তার প্রেমের যেনো ফাঁদ রাখা।
হাসির ছোঁয়ায় দিন হয়ে যায় অন্য রকম
ভাবি শুধু—এ মন কবে হবে আমার প্রিয়জন ?
---
আমি লক্ষ্য করতাম—ও সবসময় চুলটা কানের পেছনে সরিয়ে দেয় কথা বলার সময়। ওর হাঁটার ভঙ্গি শান্ত, অথচ আত্মবিশ্বাসী। যদিও সে দেখতে মনে হতো রাগান্নিত। কখনও ক্লাসের সামনে দিয়ে গেলে হালকা বাতাসে ওর ওড়না উড়ে যেত, আর আমি নিঃশ্বাস আটকে তাকিয়ে থাকতাম।
দিন গড়িয়ে সপ্তাহ, সপ্তাহ গড়িয়ে মাস। আমি যেন নিজের অজান্তেই ওর জন্য অপেক্ষা করার অভ্যাস তৈরি করে ফেললাম।
প্রতিদিন সকালে কলেজের গেটে দাঁড়িয়ে ওরে ভেতরে ঢুকতে দেখি।
দুপুরে ক্যান্টিনে গিয়ে ওর বন্ধুদের টেবিলের পাশের টেবিলে বসি।
বিকেলে লাইব্রেরি গেলে বুকশেলফের আড়ালে লুকিয়ে শুধু তাকাই।
আমার বন্ধুদের কাছে এসব ছিল মজা, কিন্তু আমার কাছে ছিল জীবন।
ধীরে ধীরে বুঝতে পারলাম, আমি আর আগের বিজয় নেই। আগে আমি বইপ্রেমী, নিরিবিলি মানুষ ছিলাম। এখন প্রতিদিনের হাসি-আনন্দ, মন খারাপ—সবকিছু নির্ভর করে এক মেয়ের উপর, যে হয়তো এখনো আমার নামও জানে না।
কিন্তু আমি ভয় পাইনি। মনে হলো, যদি এই অনুভূতিই ভালোবাসা হয়, তবে আমি তা শেষ পর্যন্ত বাঁচবো।
আমি শেষ পর্যন্ত তার ভালোবাসা পাওয়ার
চেষ্টা করবো,
হাজার বাধা আসুক, তবুও থামবো না তো। তার নামেই গড়বো আমার সব স্বপ্নের ঘর,
ভালোবাসা দিতেই পারি, চাই না
কোনো উত্তর।
অপেক্ষা, মুগ্ধতা আর নীরবতা আমাকে ভেতরে ভেতরে খেয়ে ফেলছিল। প্রতিদিন তাকে দেখা মানে ছিল আনন্দ, কিন্তু একইসাথে কষ্টও—কারণ আমি এখনও একবারও তার সঙ্গে কথা বলিনি।
আমি নিজেকে প্রশ্ন করতাম—
"বিজয়, তুই যদি একটুও সাহস না দেখাস, তাহলে কীভাবে জানবি সে কী ভাবে? অন্তত একটা সাধারণ আলাপ শুরু কর।"
অবশেষে একদিন ভাগ্য নিজেই আমাকে সুযোগ এনে দিল।
পরিচয় হলো কিছু ছোট বোন এর সাথে।
তারাও ফাস্ট ইয়ার এ পড়ে। তাদের সাথে আমার সম্পর্ক টা পুরোপুরি বন্ধুত্ব সুলভ হয়ে যায়। যদিও তারা আমার জুনিয়র ছিলো। কিন্তু আমাদের সম্পর্ক টা বন্ধুতের মতো হয়ে যায়। ওদের খুজ নিয়ে দেখি ওদের ফ্রেন্ডই ছিলো আমার গল্পের রানী। যাকে আমি প্রথম দেখাতেই ভালোবেসে ফেলেছিলাম। যদি এটা তাদের কাছে আমি বলি নি। তাদের শুধু দেখিয়ে ছিলাম মেয়ে টা আমার ভালো লাগছে।
কিন্তু তারপরের গল্পটা শুনলে আপনাদের নিশ্চয়ই একটু ইন্টারেস্টিং লাগবে। কারন সিনিয়র আর জুনিয়র রা মিলে যখন একটা প্লানিং করে তখন তা সফল হতেই হবে। আর আমাদের প্লান টা সফল ও হয়েছিলো। এখন আপনাদের মনে প্রশ্ন কি ছিলো সেই প্লানিং…? আপনারা হয়তো ভাবতাছেন প্লানিং সফল হওয়াতে হয়তে মেয়ে টা আমার হয়ে গেসে তাই তো…? নাকি না…?
চলুন আমার গল্পে ফিরে যাই...
সেই ছোট বোন গুলো–
মানে আমার জুনিয়র ফ্রেন্ড গুলো। তাদেরকে সাথে নিয়ে প্লানিং করি কি করে আমার গল্পের মেয়েটার কাছাকাছি যাওয়া যায়। সকলে মিলে সিদ্ধান্ত নেই যেহেতু মেয়ে টা তাদের ও বন্ধু ছিলো তাই একটা গ্রুপ খোলা হবে। যেখানে আমার গল্পের মায়াবী ও এড থাকবে। যেই কথা সেই কাজ। গ্রুপ খোল হলো।
জানি না আজও কি সেই গ্রুপ টা আছে কি না। তবে সময়ের সাথে মানুষ গুলো অনেক পরিবর্তন হয়ে গেসে। চেঞ্জ হয়ে গেসে সব।
কারন আমাদের জানা ছিলো সরাসরি তার ফেইসবুক একাউন্টে রিকোয়েস্ট দিয়ে এড হওয়া কখনোই সম্ভব না। তাই আগে তার সাথে একটা ফ্রেন্ডশীপ করতে হবে ৷ পরিচিত হতে হবে ৷
গ্রুপ এর মাধ্যমে তার সাথে আমার প্রথম কথা হয়। সকলে আমাকে সুযোগ করে দিয়েছিলো যার জন্য এতটুকু সম্ভব হয়েছে। তখন ও তাকে আমি প্রচন্ড ভয় পেতাম কিন্তু কেনো তা আমার জানা নেই।
কয়েকদিন পর লাইব্রেরিতে বসে আছি। দেখি, সেও ভেতরে ঢুকল। বুকের ভেতর কাঁপতে লাগল, তবু এবার আর পিছু হটিনি।
আমি সাহস করে বললাম,
—“তুমি কি রবীন্দ্রনাথ পড়ো?”
সে একটু চমকে তাকাল, তারপর মাথা নেড়ে হেসে বলল,
—“হ্যাঁ, মাঝে মাঝে।”
আমি বললাম,
—“আমি ভাবছিলাম, তোমাকে দেখেই মনে হলো তুমি কবিতা পড়তে ভালোবাসো।”
সে খুঁটিয়ে তাকাল আমার দিকে। চোখে যেন কৌতূহল।
—“আপনি তো সেকেন্ড ইয়ারে পড়েন, তাই না?”
সেদিন প্রথমবার জানলাম, সে আমাকে অন্তত লক্ষ্য করেছে।
তারপর থেকে আমরা সামান্য কিছু কথা বলতাম। আমাদের এখন ফেইসবুক এ কানেক্টেড ছিলাম। খুব সাধারণ আলাপ—কোন বই পড়ছো, কোন ক্লাসটা কেমন লাগছে, কলেজের শিক্ষকরা কারা ভালো।
কিন্তু সেই সামান্য কথাগুলোই আমার কাছে ছিল মহামূল্যবান। আমি মনে করতাম, প্রতিটি শব্দ যেন আমার হৃদয়ের গভীরে খোদাই হয়ে যাচ্ছে।
প্রতিবার তার সঙ্গে কথা বলার পর রাতে ঘুম আসত না। আমি তার হাসি, তার চোখ, এমনকি তার বলা ছোট্ট শব্দগুলোও মনে মনে বারবার আওড়াতাম।
আমি অনুভব করতাম—এটা আর কেবল মুগ্ধতা নয়। এটা সেই ভালোবাসা, যা জন্মেছে প্রথম দেখাতেই, আর প্রতিদিন একটু একটু করে গভীর হচ্ছে।
বন্ধুরা এখন বুঝে ফেলেছিল।
—“বিজয়, আজও ওকে দেখেছিস?”
আমি তাদের ঠাট্টায় কিছু বলতাম না। শুধু মনে মনে বলতাম, “ওরা কী বুঝবে? এটা ঠাট্টার নয়, আমার জীবনের সবচেয়ে সত্যি অনুভূতি।”
আমি প্রায়ই–
কল্পনায় এক ভবিষ্যৎ আঁকতাম। ভাবতাম, একদিন নিশ্চয়ই তাকে বলব আমার মনের কথা। সে হয়তো প্রথমে অবাক হবে, হয়তো চুপ থাকবে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত হয়তো বুঝবে—আমার ভালোবাসা শুধু কথার নয়, এ ভালোবাসা আমার অস্তিত্বের অংশ।
কলেজ জীবনের দিনগুলো একেকটা নতুন গল্পের মতো আসত। ক্লাস, পরীক্ষা, হঠাৎ ঘোষিত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, বিতর্ক প্রতিযোগিতা, আর ভ্রমণের পরিকল্পনা—সবকিছুর মাঝেই ছিল আমার একটিমাত্র লক্ষ্য। আমি যেন প্রতিটি ঘটনায় তাকে খুঁজে বের করি।
কলেজে পিঠা উৎসব প্রতিযোগিতা হচ্ছিল। চারপাশ সাজানো, স্টেজে আলোর ঝলকানি। আমিও অংশ নিয়েছিলাম। হঠাৎ চোখ পরে এক অদ্ভুত মায়ার দিকে।
ফার্স্ট ইয়ারের সেই মায়াবী…..............( নামটা না হয় নাই প্রকাশ করি)”
মুহূর্তে আমার বুক কেঁপে উঠল।
লাল-সাদা পোশাকে যেন আকাশ থেকে নেমে আসা কোনো অপ্সরা।
আমি চোখ সরাতে পারছিলাম না। মনে হচ্ছিল,
তার দিকে তাকিয়ে জনমের পর জনম কাটিয়ে দেই।
বন্ধু খোঁচা দিয়ে বলল,
—“বিজয়, ওকে দেখার নাম করে গিলে খাচ্ছিস নাকি?”
আমি কিছু বললাম না। শুধু মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম, “একদিন ওকে জানাবো, ওর প্রতিটি সুর আমার জীবনের গল্প হয়ে গেছে।”
কয়েক মাস পর কলেজ থেকে বান্দরবান ভ্রমণের আয়োজন হলো। পুরো ব্যাচ, শিক্ষক আর কিছু সিনিয়ররা যাবে। আমিও নাম লিখালাম।
বাসে ওঠার সময় হঠাৎ দেখলাম, সেও এসেছে। বুকের ভেতর আনন্দে ঝড় উঠল।
পাহাড়ি রাস্তার আঁকাবাঁকা পথে বাস চলছিল। সবাই গান গাইছিল, গল্প করছিল। হঠাৎ একসময় সে জানালার ধারে বসে পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে বলল,
—“প্রকৃতি আসলেই ভীষণ সুন্দর, তাই না?”
আমি সাহস করে জবাব দিলাম,
—“হ্যাঁ, তবে প্রকৃতির সব সৌন্দর্য মিলে একসাথে দাঁড়ালেও… তোমার কাছে হার মানে।”
সে হেসে তাকাল আমার দিকে, তারপর আবার জানালার বাইরে চোখ রাখল। আমি বুঝলাম, কথাটা হয়তো হালকাভাবে নিয়েছে। কিন্তু আমার ভেতরে সেই মুহূর্তটা চিরদিনের জন্য খোদাই হয়ে গেলো। ভ্রমণের সময় অনেক ছোট ছোট ঘটনা ঘটল—
পাহাড় চড়ার সময় সে হোঁচট খেয়ে সামলে নিল, আমি দূর থেকে তাকিয়ে হৃদস্পন্দন থেমে যাওয়া অনুভব করলাম।
ঝর্ণার ধারে দাঁড়িয়ে সবাই ছবি তুলছিল, আর আমি চুপচাপ ওর হাসি দেখছিলাম।
রাতে ক্যাম্পফায়ারে সবাই গল্প বলছিল, সে হঠাৎ করে একটি কবিতা আবৃত্তি করল। আমি ভাবলাম—"এই মেয়েটা শুধু সুন্দর নয়, অদ্ভুত প্রতিভাবানও।"
প্রতিটি মুহূর্ত যেন আমার ভালোবাসাকে আরও গভীর করে তুলছিল।
ভ্রমণ শেষে কলেজে ফিরে আসার পরও সেই স্মৃতিগুলো আমাকে ভেতরে ভেতরে আলো দিত। মাঝে মাঝে ক্যান্টিনে দাঁড়িয়ে আমরা দু’একটা কথা বলতাম।
—“তুমি কি গল্পের বই পড়ো?”
—“ক্লাসের কোন স্যারটা তোমার প্রিয়?”
সাধারণ আলাপ হলেও আমার কাছে যেন সেটা ছিল এক অমূল্য সম্পদ।
তবুও একটা ভয় সবসময় আমাকে ঘিরে থাকত।
“যদি সে আমাকে কেবল সিনিয়র হিসেবেই দেখে?”
“যদি সে ভাবেও না আমি তার প্রতি অন্য কোনো অনুভূতি পোষণ করি?”
এই প্রশ্নগুলো আমার বুকের ভেতর আগুন ধরিয়ে রাখত। তবু আমি বুঝতে পারতাম, এ ভালোবাসা থামানো যাবে না। এটা এমন এক স্রোত, যা আমাকে ভাসিয়ে নিয়ে চলেছে।
"আমি তার ভালোবাসা পাবো, এই
আশায় বাঁচি,
চোখে তার স্বপ্ন দেখি, মনে রাখি
কাছে আছি।
যদিও সে জানে না, তবুও নিঃশব্দে বলি,
তোমাকেই চেয়েছি আমি—তোমাতেই
আমি বাঁচি....
প্রতিদিনই তার সঙ্গে ছোট ছোট আলাপ আমার জীবনে আলো জ্বালাত। ওর হাসি, কণ্ঠস্বর, চোখের চাহনি—সবকিছু যেন আমাকে বাঁচার নতুন কারণ দিত।
কিন্তু ভেতরে একটা অস্থিরতা জমতে লাগল। আমি বুঝলাম, এই ভালোবাসা আর নীরবে রাখা যাবে না। একসময় না একসময় আমাকে বলতে হবেই।
রাতগুলোতে ঘুম ভাঙতো বারবার। বুকের ভেতর যুদ্ধ চলত—
“বলবি বিজয়! অন্তত জানুক, তুই কেমন অনুভব করিস।”
আবার মনে হতো—
“না, যদি সে কষ্ট পায়? যদি মনে করে তুই শুধু সিনিয়র-জুনিয়র ভেদ ভুলে অকারণ ঝুঁকি নিচ্ছিস?”
এই দ্বন্দ্ব আমাকে অস্থির করে রাখত। তবুও আমি জানতাম—দিন আসছে, যখন সব খুলে বলতেই হবে।
সেদিন বিকেলে হঠাৎ প্রবল বৃষ্টি শুরু হলো। কলেজের সামনে বারান্দায় দাঁড়িয়ে ভিজতে থাকা আকাশ দেখছিলাম। হঠাৎ লক্ষ্য করলাম, সেও দাঁড়িয়ে আছে, হাতে বই। চুলের কোণ ভিজে গেছে, মুখে মৃদু হাসি।
আমি কাছে গিয়ে বলতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সাহস হলো না। মনে মনে চিন্তা করতে থাকলাম। আর তাকে কল্পনায় আবিষ্কার করলাম,
—“তুমি বৃষ্টি ভালোবাসো?”
সে চমকে তাকাল, তারপর মিষ্টি স্বরে বলল,
—“হ্যাঁ… বৃষ্টি মানে তো নতুন শুরুর প্রতীক।”
আমি বলতে চেয়েছিলাম, “আমার নতুন শুরুটা তুমি।”
কিন্তু ঠোঁট পর্যন্ত এসে থেমে গেল কথা। শুধু মাথা নেড়ে দাঁড়িয়ে রইলাম।
এটা শুধুই আমার কল্পনা ছিলো বাস্তবে হয়তো বলা কখনো সম্ভব না। তার রূপ আর গুনের কাছে আমি কিছুই না। আর আমি দেখতেও তেমন সুন্দর বা স্মার্ট না। গ্রামের সাদাসিদে ছেলে আমি। কখনো ভালোবাসা প্রকাশ করার মতো সাহস নিজের মাঝে পাই নি। তাও মনে মনে স্থির করি একদিন ঠিক তাকে আমার মনের কথা গুলো বলবো।
এরপর থেকে আমি নিজেকে প্রস্তুত করতে শুরু করলাম। বন্ধুরা উৎসাহ দিল—
—“দেখ বিজয়, ওর সঙ্গে তো তোর এখন কথাবার্তা হয়। একদিন না একদিন তোকে বলতেই হবে।”
আমি শুধু চুপ করে হাসতাম। মনে মনে ঠিক করলাম, সঠিক মুহূর্তে আমি সব বলে দেবো।
কলেজের সাংস্কৃতিক ক্লাবের এক আলোচনায় সবাই জড়ো হয়েছিল। সে-ও এসেছিল। আলো-আঁধারিতে বসে আমি ওর দিকে তাকিয়ে ছিলাম। একসময় আমাদের চোখ মিলল। মুহূর্তের জন্য মনে হলো, পৃথিবী থেমে গেছে।
আমি ভেতরে ভেতরে বললাম, “হয়তো সময় এসে গেছে।
কিন্তু তখনই যেন আকাশে কালো মেঘ জমতে শুরু করল।কয়েকদিন পর বন্ধুর কাছ থেকে শোনলাম—ওর পরিবার নাকি খুব রক্ষণশীল, বিয়ে নিয়ে তাদের পরিকল্পনা অনেক আগেই ঠিক করা।
সংবাদটা আমার বুকের ভেতর পাথরের মতো নেমে এলো।
আমি নিজেকে প্রশ্ন করলাম—
“তাহলে কি আমি কখনোই তাকে পাবো না?”
“তবুও কি বলা উচিত, অন্তত জানাতে?”
আমার মনের মধ্যে দ্বিধা আর কষ্ট মিশে এক ঝড় তুলল।
দিন যত গড়াচ্ছিল, ততই মনে হচ্ছিল সময় ফুরিয়ে আসছে।
আমি ঠিক করলাম, যাই হোক না কেন, আমি একদিন ওকে বলব। হয়তো সে কিছুই বলবে না, হয়তো প্রত্যাখ্যান করবে, তবুও অন্তত আমার হৃদয়ের ভারটা কমে যাবে।
কিন্তু তখনও জানতাম না, সামনে আসছে এমন এক বাস্তবতা, যা আমার সমস্ত স্বপ্নকে চিরতরে ভেঙে দেবে।
দিনগুলো যেন ক্রমেই ভারী হয়ে উঠছিল। প্রতিদিন তাকে দেখে আনন্দ পেতাম, আবার একইসাথে বুকের ভেতর হাহাকার জেগে উঠত—"আমি কি কোনোদিনই তাকে জানাতে পারব না?"
একদিন লাইব্রেরির সিঁড়িতে বসে ছিলাম। হাতে বই থাকলেও চোখ ছিল শূন্যে। হঠাৎ শুনলাম পরিচিত কণ্ঠস্বর—
—“আপনি কি পড়ছেন?”
চমকে তাকালাম। সে দাঁড়িয়ে আছে, মুখে চিরচেনা মিষ্টি হাসি। আমি হেসে বললাম,
—“বই খোলা আছে, কিন্তু আসলে পড়া হচ্ছে না।”
সে হেসে বইটা উল্টে দেখল।
—“তাহলে পড়াশোনার ভান করছেন?”
আমি তার চোখের দিকে তাকিয়ে থমকে গেলাম। বুকের ভেতর চাপা ঝড় যেন মাথা তুলে দাঁড়াল। মনে হলো—এই মুহূর্তটাই হয়তো আমার সুযোগ।
আমি আস্তে বললাম,
—“আসলে একটা কথা অনেকদিন ধরে বলতে চাইছিলাম…”
সে কৌতূহলী চোখে তাকাল।
—“কী কথা?”
আমি বুকের ভেতর সাহস জড়ো করে বললাম,
—“তোমাকে প্রথম দিন থেকেই দেখে আমি… মুগ্ধ হয়ে আছি। জানি না এটা বলা ঠিক হচ্ছে কি না, কিন্তু তোমাকে ছাড়া আমার দিনগুলো এখন কল্পনাই করতে পারি না।”
কথাগুলো বলে ফেলেই বুকের ভেতর কেমন যেন হালকা লাগল। অথচ মুখ শুকিয়ে গেল তার প্রতিক্রিয়ার অপেক্ষায়।
সে কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। চোখ নামিয়ে রাখল মাটির দিকে। তারপর আস্তে বলল,
—“আপনি সিনিয়র, তাই বলছি… আপনার অনুভূতিকে আমি অসম্মান করছি না। কিন্তু আমার পরিবার অনেক ভিন্ন। আমাদের ঘরে এসব বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জায়গা নেই।”
আমার বুকের ভেতর কেঁপে উঠল। মনে হলো, পৃথিবীটা হঠাৎ ফাঁকা হয়ে গেছে।
তবুও সে আরও বলল,
—“আমি আপনাকে ছোট করতে চাই না। শুধু চাই, আমাকে বুঝবেন।”
তার চোখে হালকা জল দেখলাম। সেই জল যেন আমার বুকের ভেতরে ছুরির মতো বিঁধল।
এরপর কয়েকদিন আমি তাকে এড়িয়ে চললাম। তাকে আর মেসেজ করা হতো না। সে হয়তো কিছুটা বুঝতে পেরেছিল, কিন্তু কিছু বলেনি।
বন্ধুরা খেয়াল করেছিল আমার পরিবর্তন।
—“বিজয়, কী হলো? তুই এত চুপচাপ কেন?”
আমি কোনো জবাব দিইনি। শুধু মনে মনে বলেছি, “যেটা আমার সবচেয়ে প্রিয়, সেটা হয়তো আমার কখনোই হবে না।”
কিছুদিন পর এক রাতে খবর আসে ছোট বোন গুলো থেকে –
—“শোনেন,ভাইয়া আপনার গল্পের মায়াবতীর বিয়ের কথা চলছে। নাকি এক আত্মীয়ের ছেলের সঙ্গে ঠিক করছে।”
সংবাদটা শুনে আমার বুকের ভেতর সবকিছু ভেঙে পড়ল। মনে হলো, পুরো পৃথিবীটা হঠাৎ আঁধারে ঢেকে গেল।
আমি ভাবলাম—"তাহলে এটাই শেষ? যাকে এতদিন ধরে আমার হৃদয়ের সবটুকু দিয়ে ভালোবেসেছি, সে কি চলে যাবে অন্য কারো হয়ে?"
রাতে খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে থাকতাম। তারকারা জ্বলজ্বল করত, কিন্তু আমার ভেতরে কেবল অন্ধকার। আমি কাঁপা গলায় নিজেকেই বলতাম,
—“ভালোবাসা হয়তো মানেই পাওয়া নয়। হয়তো মানেই ত্যাগ।”
তবুও আমি একবার তাকে দেখতে চাইছিলাম, একবার অন্তত চোখের সামনে দাঁড়িয়ে বলতে চাইছিলাম—"তুমি আমার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর অধ্যায়।
"আমার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর অধ্যায় তুমি
তোমার নামেই শুরু, তোমাতেই শেষ,
এই হৃদয়ে শুধু তোমারই বসত বেশ।
ভাঙা গল্প, হারানো সময়ের ছায়া,
তবু তোমায় নিয়ে স্বপ্ন গাঁথি নিরালায়। তুমি না থেকেও থেকো মনে প্রতিদিন,
তোমায় ভালোবেসে পাই না কোন গ্লানির চিন।
শেষ পাতায় লেখা থাকবে এই সত্য কথা,
আমার জীবনের শেষ অধ্যায়—শুধুই "তুমিই রথা"।
বিয়ের খবর শোনার পর থেকে আমার ভেতরের পৃথিবীটা একেবারে বদলে গেল। ক্লাসে গেলেও বইয়ের অক্ষরগুলো অস্পষ্ট লাগত। বন্ধুরা হাসাহাসি করত, আড্ডা জমাত, কিন্তু আমি শুধু দূর থেকে বসে থাকতাম।
রাতে ডায়েরি খুলে লিখতাম—
"তুমি জানো কি, তোমার নাম লিখতে লিখতেই আমার কলম কাঁপে? জানো কি, তোমার হাসির ভেতরে আমি এক জীবন খুঁজে পাই?"
মন বলল—"বিজয়, এভাবে কি শেষ করে দিবি? অন্তত একবার তার সঙ্গে কথা বল, অন্তত একবার তাকে বুঝানো দরকার তাকে কতটা ভালোবাসোস তুই।
আমি দ্বিধায় ভুগলাম। ভয় ছিল—হয়তো সে ভুল বুঝবে, হয়তো কষ্ট পাবে। কিন্তু অন্তর থেকে একটাই কথা উঠছিল—"শেষবার, শুধু শেষবার।"
সেদিন বিকেলে সাহস করে কলেজে গেলাম। ভাগ্যের খেলা, বারান্দায় হঠাৎ তার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। হাতে কিছু কাগজ ছিল তার, হয়তো লাইব্রেরি থেকে ফিরছিল।
সে আমাকে দেখে থেমে গেল। দুজনেই কয়েক সেকেন্ড চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম। বাতাসে অদ্ভুত এক ভারী নীরবতা নেমে এলো।
আমি ধীরে বললাম,
—“শুনেছি… তোমার বাসায় কিছু ঠিক হচ্ছে।”
সে মাথা নিচু করল। আস্তে বলল,
—“হ্যাঁ, পরিবার চাচ্ছে… আমি খুব একটা কিছু বলতে পারি না।”
আমার গলা শুকিয়ে গেল। তবুও চোখের ভেতর সাহস জড়ো করে বললাম,
—“তুমি জানো কি, তুমি আমার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর অধ্যায়? তুমি আমার জন্য স্বপ্নের মতো… যদিও জানি, সেই স্বপ্ন কোনোদিন সত্যি হবে না।”
সে চোখ তুলে তাকাল। তার চোখে জমে থাকা জল দেখে মনে হলো, ভেতরে সেও লড়ছে। কিন্তু ঠোঁট দিয়ে বেরোল কেবল একটা দীর্ঘশ্বাস।
—“আপনি আমাকে ভুল বোঝেন না। আমি আপনাকে সম্মান করি… খুব। কিন্তু সবকিছু আমার হাতে নেই।”
তার কথাগুলো আমার বুকের ভেতরে হাজার সূঁচ ফোটালেও আমি শান্ত স্বরে বললাম,
—“আমি কিছু চাই না। শুধু চাই, তুমি সুখী হও। যে-ই তোমার জীবনে আসুক, সে যেন তোমার হাসিটা চিরকাল অটুট রাখে।”
সে কোনো উত্তর দিল না, শুধু চোখ মুছে চলে গেল। তার পায়ের শব্দ বারান্দার ফাঁকা জায়গায় মিলিয়ে যেতে লাগল।
আমি সেখানে দাঁড়িয়ে রইলাম অনেকক্ষণ। মনে হলো, আমার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানুষটা আস্তে আস্তে দূরে সরে গেল, অথচ আমি কিছুই করতে পারলাম না।
সেই রাতে আকাশের দিকে তাকিয়ে আমি কেঁদে ফেললাম। চাঁদটা মেঘের আড়ালে ঢেকে যাচ্ছিল। আমি মনে মনে বললাম,
"হে আল্লাহ, আমি কিছু চাই না। শুধু চাই, সে যেন সুখে থাকে।"
চোখ ভিজে এলেও হৃদয়ের ভেতরে এক অদ্ভুত শান্তি এল। কারণ আমি জানতাম—ভালোবাসা মানেই পাওয়া নয়, ভালোবাসা মানে কারো জন্য নিরন্তর প্রার্থনা।
তার বিয়ের খবর যত কাছে আসছিল, আমার অন্তর ততই ভারী হয়ে উঠছিল। কলেজে হাঁটলে মনে হচ্ছিল, চারপাশের হাসি-আড্ডা সব যেন আমার কাছে ধোঁয়া হয়ে গেছে। বন্ধুরা খোঁচা দিত,
—“বিজয়, এখনও তার দিকে তাকাচ্ছিস?”
আমি কেবল হেসে পেছনে তাকাতাম না। কারণ জানতাম, আমার চোখ আর মন সবসময় সেখানে—তার দিকে।
একদিন আমি সাহস করে কলেজে গেলাম। জানতাম, হয়তো এইই শেষবার দেখা হবে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিলাম। হঠাৎ সে এল। লাল শাড়ি পরা, চুল ভিজে গেছে হালকা বৃষ্টিতে।
আমার বুকের ভেতরে সব ভাঙছিল।
আমি ধীরে ধীরে বললাম,
—“আমি শুধু বলতে চাই, তুমি আমার জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান মানুষ।”
সে চোখ নামিয়ে হাত দুলিয়ে বলল,
—“আপনি কষ্ট পেয়েছেন, জানি… কিন্তু আমি কিছু করতে পারবো না।”
আমি মাথা নেড়ে বললাম,
—“আমি চাই না। শুধু চাই তুমি সুখী হও। যে-ই তোমার পাশে আসুক, তাকে ভালোবাসো। আর তুমি হাসিও।”
সেদিন আমি তার হাত ধরতে পারিনি, শুধু চোখে চোখ রেখে বিদায় জানালাম।বিয়ের দিন আসলো। আমি কলেজ থেকে দূরে থাকলেও ঠিক সময় অনুযায়ী বাসা থেকে বের হয়ে গিয়েছিলাম। দূর থেকে দেখলাম, সে লাল শাড়িতে সাজে সাজে দাঁড়িয়ে। চোখে কিছুটা জল, মুখে হালকা হাসি।
আমি চুপচাপ দূর থেকে তাকিয়ে রইলাম। মনে হলো, আমার হৃদয়টা এক মুহূর্তে থেমে গেছে। প্রতিটি মুহূর্তের স্মৃতি—লাইব্রেরি, ক্যান্টিন, ভ্রমণ, বারান্দার দেখা—সব ঝরে গেল।
বন্ধুরা আমার কাঁধে হাত রাখল,
—“বিজয়, চলে যা। সে সুখী হবে।”
আমি মাথা নেড়ে জানলাম, এটাই সত্য। ভালোবাসা মানেই সবসময় পাওয়া নয়, কখনও কখনও মানে ছেড়ে দেওয়াই।
বিয়ের আসরে আমি দূর থেকে দেখলাম, সে তার নতুন জীবনে প্রবেশ করছে। আমি তার কাছে যেতে পারিনি, শুধু অন্তরে প্রার্থনা করলাম—
"হে আল্লাহ, তাকে সুখী করো। তার জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত যেন আলোয় ভরে থাকে।"
মুহূর্তটা ছিল তীব্র, হৃদয় কাঁপানো, অথচ শান্ত। কারণ আমি জানতাম, আমি যে ভালোবাসা অনুভব করেছি, তা আমার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর অধ্যায়–
"লাল শাড়িতে সে আজ পরের হয়ে যায়,
চোখের জল লুকিয়ে আমি শুধু তাকিয়ে থাকি।
ভালোবাসা ছিল আমার, কপাল ছিল না — এইতো ফাঁকি....
বিয়ের আসর শেষ। সে চলে গেছে তার নতুন জীবনের দিকে। আমি দূরে দাঁড়িয়ে থেকে দেখলাম, সে হাসছে, ঘর আলোয় ঝলমল করছে, নতুন জীবন শুরু করছে।
বুকের ভেতরে এক অদ্ভুত খালি ভাব। চোখ ভিজে গেছে, কিন্তু ভেতরে শান্তি। কারণ আমি জানি—আমি ভালোবেসেছি, পুরো হৃদয় দিয়ে। ভালোবাসা মানে সবসময় পাওয়াই নয়; কখনও কখনও মানে ছেড়ে দেওয়া।
আজও যখন কলেজের করিডোরের কথা মনে পড়ত, মনে হয় সে হাঁটছিল, বই হাতে হাতে, খোলা চুল, মৃদু হাসি। লাইব্রেরি, ক্যান্টিন, পাহাড় ভ্রমণ—সব স্মৃতি যেন এক অমোঘ আলো হয়ে বুকের ভেতরে থাকে।
আমি ভাবতাম—
"আমি হয়তো তার পাশে থাকিনি। কিন্তু আমার ভালোবাসা সত্য। আমার অন্তর জানে, সে সবসময় আমার জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান অধ্যায় হয়ে থাকবে।"
"সে তার জীবন নিয়ে ভালোই আছে, সুখে হাসে প্রতিদিন,
আমি আছি তার মায়ায়, স্মৃতির পিছু ছুটে নির্বাক ছায়াছিন।
ভুলতে পারি না তাকে, তবু মুখে হাসি আঁকি,
ভালোবাসা একতরফা ছিল—এটাই আমার ভাগ্য লিখা রাখি।
আমি বিজয়। বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়া।
এক সাধারণ ছেলে, যিনি কলেজ জীবনের প্রথম দেখাতেই এক JUNIOR মেয়ের রূপে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। তার রূপ, তার গুণ, এমনকি তার হাসি—সবকিছুই আমার জীবনের অনন্য অধ্যায়।
আমি জানি, হয়তো আমরা একসাথে থাকিনি, কিন্তু তার জন্য আমার অনুভূতি চিরকাল অটুট। এই ভালোবাসার গল্প আমাকে শিখিয়েছে—প্রথম দেখার মুগ্ধতা কখনও কখনও জীবনের সবচেয়ে গভীর অনুভূতি হয়ে ওঠে।
📔🖋️ জাহিদুল ইসলাম বিজয়
[ ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা]