Posts

কিডজ ফ্যাক্টরি

আয় ভাই নাটক বানাই

September 26, 2025

Palash Ahasan

Original Author পলাশ আহসান

Translated by পলাশ আহসান

131
View

ভাইনাটক বানাই

পলাশআহসান

রাত১২টার মত বাজে। আজিজমল্লিকের বাড়ির উঠোনে হাজির আবেদ গাজি আরমনা কাজি। আবেদ গাজির বাজখাইগলা, মল্লিক জাইগা আছ না ঘুমায়াগেলা। আর একটু কমস্বরে কথা এলো। আবেদেরপাশ থেকেই, কী কও আবেদনাতি নাতনিগরে দিয়া আমাগো ঘুমনষ্ট কইরা অখন অয়ঘুমাইবো। দাঁড়াও ঘুম ছুটাইতাছি। ঠিকতখনই ঘরের ভিতর থেকেআরেক প্রবীণ প্রায় ছুটে এলেন, তিনিএখনো বাইরের পোশাক ছাড়েননি। আরে এ কী ! তোমরা দুই জন একসাথেহইলা কেমনে ! তাও আমার বাড়িতে।কথা বলার ধরণ দেখেবোঝা গেলো আগের দু’জন এনারই ঘুমছুটাতে চাচ্ছিলেন। যাকে মল্লিক ডাকছিলেনতিনি এবং এই দু’জনের বয়স ৭৫এর বেশি হবে। তারাআসলে বন্ধু। স্কুল বন্ধু, পাড়ার বন্ধু খেলার বন্ধু। প্রাণের বন্ধু।

দু’জনকে নিয়ে উঠনেরঅন্য প্রান্ত বসার ঘরে চলেগেলেন আজিজ মল্লিক। যেতেযেতে বললেন আসছো ভালা করছো।কী কইবা খানিকটা বুঝতাসি।বাকিটা পরে শুনি। আগেপানি টানি খাও। চাখাও। খাবার দেওয়ার দেরি আছে। সবাইব্যাস্ত ছিল। একটু আগেআসছে স্কুলের মাঠ থিকা। আমরাওআসছি স্কুলের মাঠ থিকা। কিকও তোমরাও মাঠে ছিলা! নাটকদেখছ নাকি ? বন্ধুদের কথা বলার সুযোগদিচ্ছেন না আজিজ মল্লিক।কারণ তিনি জানেন এইদু’জনের কাউকে কথাবলার সুযোগ দেয়া যাবে না।এরা কথা বললেই তারউদ্দেশ্য মাঠে মারা যাবে।তারা যে আসবে তাতো তিনি জানতেনই।

ওদিকেফিসফাস চলছে মূল ঘরে।রফিক ওয়াশরুম থেকে বের হলেন।  ওখানথেকেই আবেদ আর মনাভাইয়ের গলার আওয়াজ পেয়েছেন।তারা আসবেন জানা ছিলো। কিন্তুএত তাড়াতাড়ি আসবেন বুঝতে পারেননি।  আলেয়াচা দিচ্ছে সবাইকে। মুচকি মুচকি হাসছে। শফিকও ফ্রেস হয়ে এসে বসলেনে। বড় ভাইয়া চানেন । বলে হেসেপ্রায় গড়িয়ে পড়লো। কিরে হাসিস কেন? ভাইয়া আসামি হাজির । শফিক খানিকটাধমক দিলেন। চুপকর। যা রান্না ঘরেগিয়ে হেলপ কর। আজফজরের আজানের আগে রাতের খাবারদিতে পারবি বলে মনে হচ্ছেনা। তবু ভাল আব্বাএখনো দুই বন্ধুর সম্মানেবিশেষ কোন রেসিপি ঘোষণাকরেনি। ভাইয়া আপনাদের কী দুটো টোস্টদেবো? খাবার দিতে সত্যিই কিন্তুদেরি হবে। যা নিয়েআয়। এই শোন বাচ্চাগুলোসব কই? জিজ্ঞেস করলেনরফিক। সবাই মেকআপ তুলেফ্রেস হচ্ছে। যা হয়ে গেলেবল, সবাই যেন এখানেচলে আসে। তুইও হাতেরকাজ শেষ করে চলেআয়।

চায়েরকাপ হাতে নিয়ে আসলোফারজানা। দুই ভাইয়ের একমাত্রবোন। বসতে বসতে বললেনযাই বলো ভাইয়া, মাত্রতিনদিনের প্রস্তুতিতে আমাদের রফিক কিন্তু জমিয়েদিয়েছে নাটকটা। ছেলে মেয়েগুলো যেঅ্যাকটিং করলো ! ভাবাই যায় না! তুমিখেয়াল করেছিলে মাঠ ভরা দর্শক। একদম চুপ। অনকেক্ষণপর শফিক বললেন, আমারতোমনে হয় সবচেয়ে ভালঅভিনয় করেছে আলেয়া। তবে তোর মেকআপেরজোরও কিন্তু মারাত্মক। হাড় ভাঙার ডাক্তারএমন মেকআপ করে জানলে তোরসব রোগী আরেকবার ওদেরভাঙা যায়গাগুলো এক্স-রে করিয়েদেখবে । এগুলো মেকআপনা সত্যি জোড়া লেগেছে। ভাইয়া , মেকআপ না হলে লোকজনশুধু শুধু তোমার ভাইয়েরলেখা ডায়ালগ শুনতো বল? তাছাড়া ফিজিক্সেরমানুষ হয়ে গানের সুরতাল লয়গুলো তুমি যেভাবে ঠিককরলে ভাবাই যায় না। সেটাওতোবলতে হবে।

এবারকথা বললো রফিক। ভাইয়াসবচেয়ে বড় কথা দুইপাপি নাটক শেষ হওয়ারআধঘণ্টার মধ্য আমাদের বাড়িতেহাজির। এটা কিন্ত ডায়ালগমেকআপ অভিনয় আর সুরের সমন্বয়৷এটাকে তুমি কি বলবে  নিউটনেরদ্বিতীঁয় সূত্র ? না রে দ্বিতীয়সূত্রও এত দ্রুত কাজকরে না। এটাই আসলেসাহিত্য। এত দিন যাবলেছি বলেছি। এখন বলতে বাধ্যহচ্ছি সাহিত্যের গতি বিজ্ঞানের চেয়েবেশি। তাই হাতে হাতেফল। তিন ভাই বোনেহাসির ফোয়ারা ছোটালো আরেক এক দফা।

ঈদেরতৃতীয় দিনের রাত ১২টা ।গ্রামের ১২টা মানে গভীররাত হওয়ার কথা ছিল। রাতমানে নিশুথি রাত। মাঝে মাঝেশেয়াল কুকুরের দীর্ঘ ডাক, বড় জোরদুএকটা ঘর থেকে নাকডাকার শব্দ পাওয়ার কথাছিল। কিন্তু আজকের পলাশপুর-রসুলপুরে এসব নেই। আরঈদের সময়তো আরও নেই ।এমনি গরমের দিন যে যারবাড়ির সামনে বসার ব্যবস্থা করে।সেখানে আড্ডা জমে। কিন্তু এবারএকটু বেশি উৎসব মুখরমনে হচ্ছে। একটু আগে স্কুলেরমাঠে নাটক করেছে মল্লিকবাড়ির ছেলেরা।

প্রতিবারঈদের দু'দিন পরস্কুলের মাঠে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানহয়। মূলত ঈদের পরগ্রামের যারা বাইরে থাকে, তাদের জন্যে ঈদের তৃতীয় দিনস্কুল মাঠে সারাদিন খেলাধুলা, আড্ডা এবং        খাওয়াদাওয়ার আয়োজন থাকে। একটা বিরতি দিয়েসন্ধ্যায় থাকে পুরস্কার বিতরণীও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। এবার যুক্ত হয়েছিলনাটক। এখন থেকে গ্রামেঈদের তৃতীয় দিনের চর্চায় একটা নাটক মঞ্চায়নওঢুকে গেলো মনে হচ্ছে।কিন্তু এবারের নাটকটা ঠিক সাধারণ নাটকনয়। গ্রামেই গ্রামের নাটক। দীর্ঘদিন জমে থাকা একটিসমস্যা নিয়ে নাটক। মূলচরিত্রগুলো সবার চেনা। সমস্যাটাওচেনা।

বৈঠকঘরেও আড্ডা জমে গেছে তিনবন্ধুর। কামডা তুমি ঠিক করনাই আইজ্জা। কোনডা কও। এই যেপুরো গ্রামের মানুষের কাছে আমগো দুইজনরেভিলেন বানাইলা। পোলাপান নাটকে যেডা কইছে এইডাআমগো ডাইকা দুইদিন কইতে পারতা না।কী কও?  অবাকহলেন আজিজ মোল্লা। কয়বছর ধইরা কইতাছি কও?  কতবারকইছি কও?  তাছাড়াগত পাঁচ বছর তোমরাদুইজন দুইজনের মুখ দেখছ? আইজকাএক নাটকে তোমাগোরে এক বানাইয়ে আমারকাছে আনছে৷ গত ঈদেও তোমাগোদাওয়াত দিছি। আসতে কইছি একলগে। আসছ কিন্তু আলাদাআলাদা। দুইজনেই কইছ ওই ছোটলোকের সঙ্গে বসুম না।  আবেদ  মনাদুজনেই খানিকটা বিব্রত হলেন। তার পর বললেনবললেন, অখন ডাকো পোলাপানগুলারে। কথা কই। আজিজজিজ্ঞাসা করলেন কথা কইয়া খাইবা, না খাইয়া কথা কইবা। কথাকইয়াই খাই। একদিনই তো।সায় দিলেনে দুই সদ্য সাবেকশত্রু।

আজিজ ,আবেদ ও মনা তিনজনইে রসুলপুর-পলাশপুরের স্বচ্ছল কৃষক পরিবারের সন্তান।তাদের বাবারাও বন্ধু ছিলেন। বড় পরিবার। আজিজেরবাবা হামিদ মল্লিক, রসুলপুর হাইস্কুলের প্রতিষ্ঠাতা৷ স্কুলের ছাত্রাবাসটি তাঁর নামে প্রতিষ্ঠিত।আবেদের বাবা ছবেদ গাজীএবং মনার বাবা শহীদকাজী নামডাকা ফুটবল খেলোয়াড় ছিলেন। হামিদও খেলতেন বাড়ির মাঠে। গ্রামের ক্লাবেও খেলেছেন । তবে ছবেদআর শহীদ নারায়ণগঞ্জ, কুমিল্লা, ঢাকায় তো খেলেছেনই। ঢাকারক্লাবের হয়ে কোলকাতায় খেলেছেন। এর পর টানাতিন বছর কোলকাতার ক্লাবলিগ খেলেছেন। সব মিলিয়ে ছবেদ-শহীদের গ্রাম হিসাবে রসুলপুর-পলাশপুরকে চিনতো মানুষ। ফুটবলের কিংবন্তী হলেও তাদের দু’জনের স্কুলের পরেআর লেখাপড়া এগোয়নি । খেলা ছাড়ারপর গ্রামেই চলে আসেন। দু’জনেই বসে যানপারিবারিক সম্পত্তিতে। তবে ফুটবল ছাড়েননিদু’জনের কেউই। রসুলপুরক্লাবের কোচ হন ছবেদএবং পলাশপুরের কোচ শহীদ।

আব্দুলহামিদ লেখাপড়ায় ভাল ছিলেন। ছবেদ-শহীদ যখন মাঠকাঁপাচ্ছেন হামিদ তথন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েগণিতের ছাত্র । কিন্তু তিনবন্ধুর বন্ধুত্ব কিন্ত অটুট। ঢাকায় গেলে হামিদের হলেউঠতেন। হামিদও সুযোগ পেলে মাঠে যেতেন। লেখাপড়া শেষ হলে তারমহকুমায় একমাত্র কলেজে গণিতের শিক্ষক হিসাবে যুক্ত হন। বাড়ির চাপছিল গ্রামে চলে আসার। তাছাড়াদুই বন্ধুর গ্রামে থাকার বিষয়টি তাঁকে উৎসাহ দিয়েছিল। ওরাও বললো আয়আমরা সবাই মিলে গ্রামটারওউন্নতি করি। আমরা দু’জন খেলাধুলার বিষয়গুলোএগিয়ে নিলাম। তুই শিক্ষার বিষয়টিদেখলি। তিনজনই ততদিনে পরিবারের হাল ধরেছেন। যারযার কাজে একটা দীর্ঘসময় পার করলেন।

এর মধ্যে মুক্তিযুদ্ধ এসে গেলো।  তিন পরিবার একসঙ্গেকাজ করলেন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে। রসুলপুর পলাশপুর গ্রামে প্রতিটি ঘরে গেলেন তারা।ভোট, স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে সচেতন করলেন।তাদের দুই গ্রামে কোনরাজাকার তৈরি হলো না।তিন পরিবার থেকে সিদ্ধান্ত নিয়েমুক্তিযুদ্ধে পাঠানো হলো আজিজ, মনাও আবেদকে। মুক্তিযুদ্ধ শেষ হলে গ্রামেএকটি স্কুল প্রতিষ্ঠার দরকার অনুভব করলেন তিন প্রবীণ। স্মৃতিচারণকরে বললেন, এতো তাদের যৌবনেরপ্রতিশ্রুতি । স্কুলের মূলউদ্যাক্তা হলেন হামিদ প্রফেসর।সঙ্গে তাঁর দুই বন্ধুওজড়িয়ে থাকলেন।  স্কুল, স্কুলের মাঠ এবং স্কুলেরখরচ মেটানোর জন্যে জমি দিলো তিনপরিবার। 

পরিবারপ্রধানদের বন্ধুত্ব ছড়ালো তাঁদের পরিবারে। তাঁরা হয়ে উঠলেন পরমাত্মীয়।ছেলে মেয়েরাও ভাইবোনের মত বড় হলো।দুই গ্রামের সীমান্তে জমি ছিল তিনপরিবারের । পারিবারিক জমিএকত্র করে সংগঠিত হলোরসুলপুর হাইস্কুল। শিক্ষার্থীদের সুবিধার কথা চিন্তা করেএকটি ছাত্রাবাসের ব্যবস্থাও রাখা হলো। আজিজলেখাপড়ায় নিয়মিত হলেও আবেদ ওমনা খেলাধুলায় বেশি জোর দিয়েছিলেন।বাবাদের মত নামডাক নাহলেও তারাও খারাপ খেলতেন না। যা হোকওই সময় পরিবারের সিদ্ধান্তেআজিজকে স্কুলের প্রধান শিক্ষক হিসাবে দায়িত্ব দেয়া হলো। গ্রামেরসবাই জানলো রসুলপুর স্কুলটির মূল শক্তি তিনপরিবার ঘিরে। 

সবইঠিক ঠাক ছিল ।এর মধ্যে বাবারা মারা গেলেন। কিন্তুসমস্যা শুরু হলো আরওকিছু দিন পর। ম্যানেজিংকমিটিতে প্রস্তাব আসলো স্কুলের হোস্টেলএবং খেলার মাঠের নাম কারও নামেনাম করণ করতে হবে।তাঁরা ছাত্রাবাসটি হামিদ মল্লিকের নামে নাম করণকরলেন।  গোলবাধলো খেলার মাঠের নামকরণ নিয়ে। নাম আসলো ছবেদআর শহীদের। দুই পরিবারই চাইলোযার যার পরিবার প্রধানেরনামে নাম হোক মাঠের।এননিয়ে দু’দলে ভাগহয়ে গেলো এতদিনে গায়েগায়ে লেগে থাকা দু’টি পরিবার।  দু’জনই কৃতীখেলোয়াড়। তাঁরা স্কুলের প্রতিষ্ঠাতাও। প্রত্যেকের যুক্তি এক জনের নামদিলে আরেকজনকে ছোট করা হবে।তাহলে কে ছোট হবেন? দু’জনইতো সমান ।

কমিটিরসেক্রেটারি হিসাবে আজিজ মল্লিক প্রস্তাবদিলেন, আমাদের লাইব্রেরির নাম রাখি ছবেদকাকার নামে, আর মাঠের নামদেই শহীদ কাকার নামে।অন্য দুই পরিবারের প্রতিনিধিরাআপত্তি করলেন। পরিচালনা পরিষদের আরেকজন প্রস্তাব দিলেন তাহলে উল্টো হোক। শহীদ সাহেবেরনামে লাইব্রেরি আর ছবেদ সাহেবেরনামে খেলার মাঠ ।  তখনো আপত্তি উঠলোজোরে সোরে। আবার আজিজ মল্লিকপ্রস্তাব দিলেন তাহলে খেলার মাঠটির নাম হোক ছবেদ-শাহেদ খেলার মাঠ। সেকথাও কেউশুনলো না। সমস্যা টাথেকেই গেলো। ভেঙে গেলো তিনপরিবাররের বন্ধুত্ব।  মুখদেখাদেখিও বন্ধ হলো ।

এই ভিন্ন মত একসময় পর্যবসিতহলো শত্রুতায়। মূল শত্রুতা দাঁড়ালোমনা আর আবেদের। যেহেতুতারা প্রভাবশালী পরিবার তাই তাদের সঙ্গেভাগ হলো পুরো দুইগ্রামের মানুষ। এক জন আরেকজনের বিরোধিতা করার সাংস্কৃতিতে চলেগেলো। ভাল না মন্দবিষয় নয়। বিরোধিতা করতেহবে। বিরোধিতার স্বার্থে বিরোধিতা যাকে বলে। এরমধ্যে নির্বাচন এমনকী খেলাধুলাও আসলো। দুই বন্ধুর দুইক্লাবের খেলা পড়লে কোনকথা নেই মারামারি হবেই।যদিও আজিজের পরিবারের সঙ্গে আলাদা আলাদাভাবে সবার যোগাযোগ থাকলোকিন্তু অস্বস্তি কাটলো না। এভাবেই পারহলো ৪০ বছর। এরইমধ্যেআজিজ স্কুল থেকে অবসর নিলেন। তার শেষ দিনেরঅনুষ্ঠানেও যোগ দিলেন নাদুই বন্ধু। কারণ আর কিছুনয়, তাঁরা একজন আরেকজনের মুখোমুখিহতে চাননা।

বাড়িরসবাইহুড়মুড়িয়ে ঢুকলো বৈঠক ঘরে। এরমধ্যে আবেদ ও মনারপরিবারের সবাই চলে এসছে।তারাও ঢুকলো। তিন বন্ধু পাশাপাশিবসেছেন। ছেলেরা ছবি তুলছে, সেলফিতুলছে। এই মধ্যরাতে হৈহৈ কাণ্ড রীতিমত। আজিজ সবাইকে থামালেন।ঘরের চার দিকের সোফায়সবাই বসেছেন । বাড়ির মেয়েরাওচলে এসেছে। কথা বলা শুরুকরলেন আবেদ। বুচ্ছ শফিক, সব দোষ তোমারবাপের। আজকে যে সহজকথাটা তোমরা নাটকে বললা, এই কথা কিন্তুনতুন না। সেই প্রথমথেকে আছে। কিন্তু বুঝায়াকইতে পারে নাই। আমিআর মনা মাঠ ঘাটেরমানুষ। হয় কাজ করিনা হয় খেলি। তোমারবাপরে তো সমাজ আররাষ্ট্র নিয়ে ভাবার দায়িত্বদিয়া গেছে তোমাগো দাদারা।মনা আপত্তি করলো । সবদায় অরে দিয়া লাভনাই আবেদ। আমরা সহজ কইরাক্যান বুঝলাম না? আজিজ কোনকথাই বললেন না।

আবারকথা বললেন আবেদ। রফিকের কাছে একখান প্রশ্নআছে। রফিক খুব বিনয়েরসঙ্গে বললনে জ্বী চাচা বলেন।এই রকম একটা প্লানতোমরা কবে করলা। তোমারবাপ তো এইটার মধ্যশুরু থেকে আছে না? বললেন রফিক । চাচাআমি গুছিয়ে নাটকটা লিখে দিয়েছি ।কিন্তু প্রথম চিন্তাটা দিয়েছিল লেখা ও পড়া।লেখা পড়া শফিকের যমজছেলে। ওরা এবছর এসএসসিদিয়েছি। মামা আমার কথাওবল । রিমি ওপাশথেকে হাত তুললো। হ্যাঁহ্যাঁ ঠিক, যখন প্লানটাহয় রিমিও অনেক সহায়তা করেছ।রিমি ফারজানার মেয়ে। এবার নাইনে। বাকিটালেখা পড়া বলুক।

লেখাপড়া দাঁড়িয়ে গেলো। দু’জনেই মিটিমিটি হাসছে। মনা বললনে দাদুরাবসে বসে বল। তুইআগে বল, বললো পড়া।লেখা শুরু করলো, গতঈদে আমরা এলাম। ঈদেরপর দিন ক্রিকেট খেলাছিল। আমরা চাচ্চুর নেতৃত্বেমাঠে গেলাম। হঠাৎ একটা আউটদেয়া নিয়ে ঝগড়া শুরুহয়ে গেলো। একসময় দেখি শত শতলোক লাঠি শোটা নিয়েমাঠের দিকে আসছে ।কারো কারো হাতে ধারালোঅস্ত্র। চাচ্চু আমাদের নিয়ে কোন রকমবাড়ি এলেন। তুই থাম, শুরুকরলো পড়া। ফেরার পথেদেখলাম, একটি মুদি দোকানেরদরজা ভাঙা হচ্ছে ।বিদ্যুতের খুঁটি ধরে নাড়িয়ে দিচ্ছে।একদল দেখলাম শশার ক্ষেতে শশাভরছে বস্তায়, কচি গাছ উপড়েফেলছে। বাসায় ফিরে চাচ্চুকে যখনজিজ্ঞাসা করলাম, ঝগড়া খেলার মাঠে।কিন্তু দোকান ভাঙছে কেন? বিদ্যুতের খুঁটিরকী দোষ? কৃষকের কষ্টেরফসল কেন নষ্ট হবে? এর মধ্যে খবর এল মাঠেরসংঘর্ষে ১০ জন আহত।এদের মধ্যে একটা ছেলের আজীবনেরমত দৃষ্টি হারানোর আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।

এবারকথা বললো রিমি। আমিওএকটু বলি ভাইয়া। সবাইহেসে উঠে হ্যাঁ হ্যাঁবলো। ছোট মামা তখনআমাদের বললেন, যখন কোন ঝগড়াহয় তখন সেখানে আরকেটিসুযোগ সন্ধানী পক্ষ থাকে। সুযোগবুঝে তারা নিজেদের পকেটভরার চেষ্টা করে। আমরা সবাইতখন বললাম, এই কথাটা গ্রামেরমানুষ জানে না? চাচ্চুবললেন সবাই আলাদা আলাদাভাবে জানে। কিন্তু সবাই একসঙ্গে বোঝেনা। যে কারণে কোনসমস্যা হলে সমাধানের কথাচিন্তা না করে দু’দলে ভাগ হয়েযায়। যার যার দলেরচিন্তা আরকেজনের  ওপরচাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে। আর এইসুযোগ সন্ধানী গ্রুপটা চেষ্টা করে কোন ভাবেইযেন সবাই একত্র নাহয়। তারা দুই গ্রুপকেউস্কানি দিতে থাকে।  যে কারণে খেলারমাঠের নামকরণ নিয়ে বিরোধটা বছরেরপর বছর জমে আছে।আজ ক্রিকেট খেলা নিয়ে যেঝগড়াটা দেখলি সেটাও ওই বিরোধেরই ধারাবাহিকতা।

আবারপড়া শুরু করলো। আমরাতখন চাচ্চুকে জিজ্ঞাসা করলাম এর কোন সমাধাননেই? চাচ্চু বললেন, আমি আশা হারাইনা।  আমারমনে হয় আবেদ চাচাআর মনা চাচার সঙ্গেআরেকবার কথা বলা যেতেপারে। তাদের আরকেবার বলা যেতে পারেতোমরা দুই দাদুর নামেখেলার মাঠের প্রস্তাবটি মেনে নাও। লেখাইতখন বলেছিল চাচ্চু দাদু নিশ্চয়ই এইপ্রস্তাব তাদের অনেকবার দিয়েছে। তারা মানেননি। এখনএমনি এমনি বললে মানবেনা। তাদের এই না মানারপ্রভাবে কী ক্ষতি হচ্ছে, সেটা বলে তার পরপ্রস্তাব টি দিতে হবে।  এবাররিমি বেশ গম্ভীর হয়েবললো, তখন আমি মামাকেবলেছিলাম আমার মনে হয়না সাধারণ ভাবে বললে আবেদদাদু আর মনা দাদুকথা শুনবে। তাছাড়া গ্রামের মানুষকেও বুঝতে হবে এই সমস্যারসমাধান হওয়া দরকার।

এসময়চাচ্চু বললেন, একটা উপায় আছে।যদি একটু ঢং করেবলা যায়। তাহলে সবাইশুনবে। তখন পড়া বললো, নেচে গেয়ে বলতে বলছো ? চাচ্চু বললেন নেচে গেয়ে, আবারশুধু নেচে গেয়েও নয়।সঙ্গে কথা যুক্ত করতেহবে। চাচ্চু তুমি কী নাটেকেরকথা বলছো? চাচ্চু বললেন, ঠিক তাই ।বললেন, বাড়ি বাড়ি গিয়েগান শোনানো সহজ কাজ নয়।সময়ও লাগবে বেশি। সবাইকে ডেকে যদি নাটকেরমত করে একটা গল্পবলা যায় এবং সমাধানদেয়া যায়। তাহলে বোধহয় কিছু একটা হতেপারে। সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্ন করলাম নাটকটার একটা পাণ্ডুলিপি লাগবে।ক’টা চরিত্র সেসবওঠিক করতে হবে ।জিজ্ঞেস করেছিলাম, চাচ্চু এবার কী হবে?

রিমিবললো মামা আমাদের বললনেধৈর্য ধর বয়েস এন্ডগার্লস, একটা সুন্দর কিছুকরতে হলে সময় লাগবে।আমরা আগামী ঈদ পর্যন্ত সময়নেবো।  এরমধ্যে ফোনে আমি তোদেরসঙ্গে কথা বলে নিচ্ছি।আর আমরা এনয়ে এখনইবাড়ির কারো সঙ্গে শেয়ারকরবো না। আগামী ঈদেযেদিন তোরা আসবি সেদিনেইআলোচনা করে ফেলবো। আলোচনানা করলে হবে না।পড়া বললো তোমরা অনেকেইজানো না, চাচ্চু কিন্তুথিয়েটার করতো। সেই অভিজ্ঞতা এখনকাজে লাগালো।

তারপর এইবার আইসা তোমরা প্রিপারেশননিলা। এবার তোমরা আইছোকবে ? ঈদের একদিন আগে।তাইলে সময় পাইছো তিনদিন । এরমধ্যে গানবানলা কখন ? সুর দিলা কখন? আর ডায়ালগ মুখস্ত করলা কখন? জিজ্ঞেসকরলেন আবেদ। পড়া সঙ্গে বলেউঠলো আমাদের দাদুইতো সব শুনে তোমাদেরতিন জনের ডায়ালগগুলো লিখেদিল। আর দোহাররের সুরতো জারির সুর। এতো আমরাসবাই জানি, শুধু কথাগুলো চাচ্চুবদলে দিয়েছে। তোমাদের দাদু যে এরমধ্যে আছে, সে তোমরানা কইলেও বুঝতাম। আমাগো গত ৪০ বছরেরযত গোপন কথা সেতো তোমগো জানার কথা না। রিমিবললো শুধু কী দাদু ? নাটকের শেষ চার লাইন, মানে সুরে সুরে যেখানেতোমাদের দু’জনের কাছেআমরা আবেদন জানালাম, সেই চার লাইনেরসুর করে দিয়েছেন বড়মামা। আর মা সবারপোশাক ঠিক করেছে। মেকআপওদিয়েছে।

যাউকগাভাল হইছে। আমরা এখন আমাদেরসিদ্ধান্ত জানাবো। তার আগে নাটকেরগান শুনবো। ডাকো ওই মাইয়াডারে।আহা কী যে সুন্দরগাইছে। এই মাইডা কেডা ? এরে তো আগে দেখিনাই। আজিজ বললেন দেখবাকেমনে। দরকার না হলে বাড়িতেআস তোমরা ? এইডা আমার আরেকটামেয়ে। এখন ওই আমাদেরদেখাশোনা করে। রফিকের কলেজেডিগ্রি পড়ছে। আলেয়া গুটি গুটি পায়েসামনে এগিয়ে আসে। ওর পেছনপেছন এসে দাঁড়ায় তিনদোহার, পড়া লেখা ওরিমি। ধর মা  শুরু থেকে ধর।বললেন আবেদ । ওঘর থেকে হামোনিয়াম চলেএলো। রিট চাপলেন শফিক।রফিক ধরলেন তবলা।

শোনশোন গ্রামের মানুষ শোন দিয়া মন

সুন্দরদু’টি গ্রমের কথাকরিব বর্নণ।

দোহার-আহা বেশ বেশবেশ

পলাশপুর-রসুলপুর গ্রাম দু’টি খুবকাছে

খেয়েপরে সব মানুষ শান্তিলইয়া বাঁচে

ক্ষেতভরা ধান আছে, দিঘিভরা জল

পুকুরভরা মাছ আছে, গাছেভরা ফল

দোহার-আহা বেশ বেশবেশ

 এক গ্রামে স্কুলআছে, কলেজ আরেক গ্রামে

প্রতিবছর বহু শিশু, শিক্ষিতহইয়া নামে

গ্রামথেকে পোলা মাইয়া বাইরেপড়তে যায়

ছুটিপাইলে দেরি নেই, গ্রামেরদিকে ধায়

দোহার-আহা বেশ বেশবেশ

এই গ্রামে ভাল খেলার মানুষছিল দু’টি

তাদেরকথা দেশ খ্যাত, ছবেদ-শহীদ জু’টি

চর্চাআছে, ক্লাব আছে, অনুশীলন কঠোর

সারাদেশেনাম করে, প্রতি বছরবছর

দোহার-আহা বেশ বেশবেশ

 এতোগেলো ভাল কথা, শোনদিয়া মন

এবারএকটা কষ্টের কথা করিব বর্নণ।

দোহার- আহা কী সেই কষ্ট ? বল বল

সুস্থথাকতে সবল থাকতে খেলারমাঠ লাগে

তেমনএকটি খেলার মাঠ আছে দুইগ্রামের মধ্যভাগে

এই মাঠে তৈরি হইছেহাজার জয়ের খবর

আবারএই মাঠে জমে আছেকষ্টের ৪০ বছর

দোহার- আহা, তার পর পর ?

শান্তিরমানুষ ভয় থাকে, কাইজ্জালাগে কখন

কারেনিয়ে হাসপাতালে, ছুটতে হবে এখন

ভয়েথাকে গরিব মানুষ, ছোটদোকানদার

ভয়েথাকে কৃষক সকল, এবারকপাল পুড়বে কার

 দোহার – কী বল ! কীবল এই কষ্ট ৪০বছরের ? শিগগিরই বল ? গ্রামের মানুষএত কিছু করতে পারলো, ৪০ বছরে একটা খেলারমাঠের সমস্যার সমাধান করতে পারলো না ?  আসোএবার আমরাই সমাধান করবো। আমরা তো শিল্পী।আমাদের কথা সবাই শুনবে। 

গায়েন- কী বলো শিল্পীরা, তোমরাসমাধান করবা ? গ্রামের মানুষ তোমাদের মাথায় নিয়ে নাচবে ?

দোহার- নাচা গানা পরে হবে।আগে গল্পটাতো শুনি

গয়েন- তাহলে শোন… (গল্পের মত করে বলে)

গ্রামেখুব সুন্দর সম্পর্কের তিনটি পরিবার ছিল …পরিবার প্রধানদেরমধ্যে যেমন বন্ধুত্ব ছিলতেমনই বন্ধুত্ব তৈরি হলো তাদেরসন্তানদের…

সবাইহাত তালি দিয়ে উঠলো।

আবেদবললেন, থাম থাম থাম। এর পরের গল্পআমাদের জানা। আমরাই সব ঘটিয়েছি ।আবার একটু আগে নাটকদেখে আমাদের সব মনে পড়েছে।এখন শেষ চার লাইনগেয়ে শেষ করো ।ক্ষুধা লাগছে। রাইত দুইটা বাজেখেয়াল আছে?

আলেয়াবললো ঠিক আছে ঠিকআছে। আমরা ধরে নিচ্ছিআমার গল্প বলা অর্থাৎনাটক শেষ। পড়া লেখাআর রিমি সবগুলো চরিত্রেঅভিনয় করে পুরো গল্পটাবলে ফেলেছে। এখন আমরা শেষকরবো।

সঙ্গেসঙ্গে মূল গায়েন পেছনেদাঁড়ালো। সামনে আসলো তিন শিল্পী।লেখা পড়া রিমি।

ছবেদগাজী, শহীদ কাজি দশেরসেরা

একইনামে মাঠ না হলেতাদের মনে রাখবে কেবা ?

যদিএকই গ্রামের দুই বন্ধু, একইমাঠে বাঁচে?

সমস্যাকী? এই প্রশ্ন আবেদআর মনু দাদুর কাছে ?

চারজনই হাত ধরে মাথানিচু করলো।  সবাইহাত তালি দিল আরেকদফা। দাঁড়িয়ে পড়লেন মনু আর আবেদ।খুব অপরাধী গলায় প্রথমে মনুবললেন। আমরা আসলে এতদিনভুল করছি। খুব সাধারণ বিষয়বুঝতে চাইনি। আবেদ বললেন, চাইলেনানা জনরে দোষ দেয়াযায়। কিন্তু দোষ আসলে আমগো।এখন তোমাদের সামনে কথা দিচ্ছি মাঠেরনাম হবে ছবেদ-শহীদখেলার মাঠ। আজিজ তুমিব্যবস্থা কর। ঈদের ছুটিশেষ হলেই কথা বলবাহেড মাস্টারের সঙ্গে।

আজিজউঠে এসে দুই বন্ধুকেজড়িয়ে ধরলেন। তার পর বললেনআর এই অস্বস্তিকর বিষয়নিয়ে আর কথা নয়।আলেয়া, আমাদের তিন বুড়ারে খাবারদাও। আর সবাই হাতেহাতে নিয়ে নিক। রাতবাজে তিনটা। খাওয়া দাওয়ার পর এখন আরবাড়ি যাওয়ার দরকার নেই। এইখানে যেযেমনে পার, শুয়ে পড়।তিন বন্ধুর যাওয়া দেখছেন সবাই। দীর্ঘ দিন পর একটাঅস্বস্তি কাটিয়ে উঠে তারা যেনমুহূর্তেই তারুণ্যে পা রাখলেন। 

palashahasan3@gmail.com

Comments

    Please login to post comment. Login