পরিনিতা
শক্তিশেল বুকে পরিবার সময় লক্ষণের মুখের ভাব নিশ্চয়ই খুব খারাপ হইয়া গিয়াছিল, কিন্তু গুরুচরণের চেহারাটা বোধ করি তার চেয়েও মন্দ দেখাইলো যখন প্রত্যুষেই অন্তপুর হইতে সংবাদ পৌঁছিল গৃহিণী এইমাত্র নির্বিঘ্নে পঞ্চম কন্যার জন্ম দান করিয়াছেন।
গুরুচরণ ৬০ টাকা বেতনের ব্যাংকের কেরানি। সুতরাং দেহেটিও যেমন ঠিকা গাড়ির ঘোরার মত শুষ্ক শীর্ণ, চোখেমুখেও তেমনি তাহাদেরই মত একটা নিষ্কাম নির্ভিকার নির্লিপ্ত ভাব।
তথাপি এই ভয়ংকর শুভ সংবাদের আজ তাহার হাতের হুকাটা হাতেই রহিল , তিনি জীর্ণ পৈত্রিক তাকিয়াটা ঠেস দিয়া বসিলেন। একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলিবারও আর তাহার জোর রাহিল না।
শুভ সংবাদ বহিয়া আমিয়া ছিল তাহার তৃতীয় কন্যা দশমবর্ষীয়া বলিল বাবা চলো না দেখবে।
গুরুচরণ মেয়ের মুখের দিকে চাহিয়া বলিলেন মা এক গ্লাস জল আনত খাই ।
মেয়ে জল আনিতে গেল সে চলিয়ে গেলে গুরু চরণের সর্বাগ্রে মনে পরল সুতিকাগৃহের রকমারি খরচের কথা।
তারপরে ভিড়ের দিনে স্টেশনে গাড়ি আসিলে দোর খোলাপাইলে থার্ড ক্লাসের যাত্রীরা পোটলা পুটলি লইয়া পাগলের মত যেভাবে লোকজনকে দলিত পৃষ্ট করিয়া ঝাপাইয়া আসিতে থাকে তেমনি মারমার শব্দ করিয়া তাহার মগজের মধ্যে দুশ্চিন্তা রাশি হুহু করিয়া ঢুকিতে লাগিল গত বৎসর তাহার দ্বিতীয় কন্যার শুভ বিবাহে বউবাজেরর এই দ্বিতল ভদ্রাসন টুকু বাধা পরীয়াছে এবং তাহারও ছয় মাসের সুদ বাকি। দুর্গাপূজার আর মাসখানেক মাত্র বিলম্ব আজ মেজমেয়ের ওখানে তত্ত্ব পাঠাইতে হইবে ।
অফিসে কাল রাত্রি আটটা পর্যন্ত ডেবিট ক্রেডিট মিলে নাই আজ বেলা বারোটার মধ্যে বিলাতে হিসাব পাঠাইতে হইবে ,তকাল বড় সাহেব হুকুম জারি করিয়াছেন ময়লা পত্র পরিয়া কেহ অফিসে ঢুকিতে পারিবে না ফাইন হইবে । অথচ গত সপ্তাহ হইতে রজকের সন্ধান মিলিতেছে না সংসারের অর্ধেক কাপড়চোপড় লইয়া সে বোধ করি নিরুদ্দেশ। গুরু চরণ আর ঠেস দিয়ে থাকিতেও পারিলেন না হুকাটা উঁচু করিয়া ধরিয়া পড়িলেন । মনে মনে বলিলেন ভগবান এই কলিকাতা শহরে প্রতিদিন কত লোক গাড়ি-ঘোড়া চাপা পরিয়া অপঘাতে মরে তারা কি আমার চেয়েও তোমার পায়ে বেশি অপরাধী? দয়াময় তোমার দয়ায় একটা মোটর গাড়ি যদি বুকের উপর দিয়া চলিয়া যায় ।অন্যকালী জল আনিয়া বলিল বাবা ওঠো জল এনেছি।
গুরুচরণ উঠিয়া সমস্তটুকু এক নিঃশ্বাসে পান করিয়ে ফেলিয়া বলিলেন আহ জামা গেলাসটা নিয়ে যা,
সে চলিয়া গেলে গুরু চরণ আবার শুইয়া পরিলেন।
ললিতা ঘরে ঢুকিয়ে বলিল মামা চা এনেছি ওঠো।
চায়ের নামে গুরুচরণ আর একবার উঠিয়া বসিলেন । ললিতার মুখের পানে চাহিয়া তাহার অর্ধেক জ্বালা যেন নিভিয়ে গেল বলিলেন সারারাত জেগে আছিস মা আয় আমার কাছে এসে একবার বোস।
ললিতা স্ব লজ্জাসে কাছে বসিয়ে বলিল আমি রাত্তিরে জাগিনি মামা।
এই চিহ্নশীর্ণ গুরু ভারগ্রস্ত অকাল বৃদ্ধ মাতুলের হৃদয়ের প্রচ্ছন্ন সুগভীর ব্যথাটা তার চেয়ে বেশি এ সংসারে আর কেহ অনুভব করিতো না গুরুচরন বলিলেন তা হোক আমার কাছে আয়।
ললিতা কাছে আসিয়া বশিতেই গুরুচরণ তাহার মাথায় হাত দিয়া সহসা বলিয়া উঠিলেন আমার এই মা টিকে যদি রাজার ঘরে দিতে পারতো তবেই জানতাম একটা কাজ করলুম ললিতা মাথা হেট করিয়া চা ঢালিতে লাগিল, তিনি বলিতে লাগলেন হ্যা মা তোর দুঃখী মামার ঘরে এসে দিনরাত্রি খাটতে হয় না?
ললিতা মাথা নারিয়া বলিল দিবারাত্রি খাটতে হবে কেন মামা? সবাই কাজ করে আমিও করি এইবার গুরুচরণ হাসিলেন চা খাইতে খাইতে বলিলেন হ্যাঁ ললিতা আজকে রান্নাবান্নার কি হবে মা
ললিতা মুখ তুলিয়া বলিল কেন মামা আমি রাধবো যে !
গুরুচরন বিস্ময় প্রকাশ করিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন তুই রাধবি কি মা রাধতে কি তুই জানিস?
জানি মামা আমি মামিমার কাছে সব শিখে নিয়েছি গুরুচরণ চায়ের বাটিটা নামাইয়া ধরিয়া বলিলেন সত্যি?
সত্যি মামিমা দেখিয়ে দেন আমি কতদিন রাঁধি যে বলিয়া মুখ নিচু করিল । তাহার আনত মাথার উপর হাত রাখিয়া গুরুচরণ নিঃশব্দে আশীর্বাদ করিলেন তাহার একটা গুরুতর দুর্ভাবনা দূর হইল।
এই ঘরটি গলির উপরেই। চা পান করিতে করিতে জানালার বাহিরে দৃষ্টি পড়ায় গুরুচরণ চেচাইয়া ডাকিয়া উঠিলেন,,,,,,