Posts

উপন্যাস

বাসর ভেঙে

October 1, 2025

Humayun Kabir

302
View

 বাসর ভেঙে

হুমায়ূন কবীর

লিলি খুবই সুন্দরী এবং ধনি বাপের সন্তান ।হাবিব গরীব কিন্তু মেধাবী।হ্যাংলা-পাতলা চেহারা । সে হান্ড্রেড পার্সেন্ট নিশ্চিত লিলির সাথে কখনোই তার প্রেম হবে না। লিলি ইন্টারমিডিয়েট পড়লে কি হবে সে একেবার চরম ছটফটে উগ্র-অবুঝ কিশোরী। তার চরম ছটফটে স্বভাবকে হাবিব কিছুটা ভয়ও পায়।

ভয় পাওয়ারই কথা। লিলি বিকেলবেলা প্রাইভেট পড়ে বাড়ি আসে। হাবিব তখন লিলির ভাই রাকিবকে পড়ায়। লিলি উঠানে ঢুকেই চিৎকার করে- মা,ভাত আছে? যদি শোনে আজ ভাত নেই সাথেসাথে বই সহ ব্যাগটা টান দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে,সামনে যা পায় ছুড়তে থাকে,লাথি মারতে থাকে। শেষে কেডস পায়ে উঠানে দাপাতে থাকে। দাপায় আর কাঁদে।  অতিরিক্ত দাপাদাপির কারণে কয়েকদিন পরপর তার কেডস ছিঁড়ে যায়। বড়লোকের মেয়ে কেডস ছিড়তে পারলে বাপ খুশি হয়ে নতুন কেডস কিনে দেয়।

লিলির বাপ ছগির মুন্সির কানাইহাট বাজারে বিশাল মুদি দোকান। এছাড়া তার মাল ভর্তি বড়বড় তিনটি রাখি মালের আড়ত আছে। কানাইহাট বাজারের পাশেই বহিরমাঝি গ্রামে ইটের সলিং রাস্তার পূর্বপাশে চার বিঘা জমির উপর পাচিল ঘেরা লিলিদের এই বিশাল বাড়ি।রাস্তার সাথে ডাবল ফ্লাটের একতলা বাড়িটা ক্রিম কালারে মোড়ানো।বাড়ির উত্তরে উঠান তারপর কিছু গাছগাছালি ছাড়িয়ে গেলেই উত্তরের মাথায় পাচিলের ভিতর পুকুর।   জমিজমা টাকাপয়সার অভাব নেই। ওরা দুই ভাই, দুই বোন। বড় বোন মিলির বিয়ে হয়ে গেছে। ছোট ভাইটার বয়স ৪ বছর।

মাঝেমাঝে যখন লিলি অতিরিক্ত করে ফেলে তখন তার মা  পেছন থেকে এসে কিছু বুঝে ওঠার আগেই পায়ের স্যান্ডেল খুলে শপাশপ কয়েক বাড়ি বসিয়ে দেয়। কান্না থেমে যায় কিন্তু সে উঠানের মাঝে বাঁশের আড়াটা ধরে দাড়িয়েই থাকে।

সে বড়লোকের আদূরে মেয়ে। হাবিব প্রায় পিতৃহীন টিউশনি মাস্টার। পিতৃহীন মানে হাবিবের বাপ থেকেও নেই। ও টিউশনি করে নিজে চলে,বাড়ি মাকে কিছু পয়সা দেয়,নিজে  কানাইহাট বাজারে মেসে থেকে যশোর এম,এম কলেজে ইতিহাসে অনার্স পড়ে।

হাবিবের বাড়িতে মা ছাড়াও দুটো ছোট বোন আছে। বাপ সিদ্দিক মোল্লা পাঁচটি বিয়ে করেছে।বউরা যারযার বাপের বাড়ি থাকে।  পাঁচ ঘরে তার ১৭টা ছেলে-মেয়ে।  সে এক বউয়ের বাড়ি ৭০ দিন থাকে। হাবিবের মা যেহেতু স্বামির ভিটায় থাকে তাই তার ভাগে ৮৫ দিন। এই অতিরিক্ত ১৫ দিন নিয়ে অনেক যুদ্ধ হয়।

লিলির হাতে একটা ঝাড়ু। ঝাড়ু হাতে  হাবিবের ঘরের দিকে এগিয়ে আসছে। তার চোখ-মুখ শক্ত। ঝাড়ু দিয়ে সে হাবিবকে মারবে নাকি? মারতেও পারে। বড়লোকের মেজাজি মেয়ে, বিশ্বাস করা যায়না। হাবিব কিছুটা জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে। লিলি অনুমতির অপেক্ষা না করেই ঘরে ঢুকে পড়েছে।

অবশ্য ঘর তো লিলিদের। নিজেদের ঘরে ঢুকতে সে বাইরের লোকের অনুমতি নেবে কেনো?

হাবিব তো বাইরের লোক।এবাড়িতে সে লিলির  ভাই, ক্লাস সিক্সে পড়া রাকিবকে প্রাইভেট পড়ায়।

রাকিব বাড়ি নেই। সে কোথায় গেছে? জিজ্ঞেস করতে পারলে হতো। লিলির কাছে জিজ্ঞেস করার সাহস তার নেই। লিলির মা'র কাছে জিজ্ঞেস করা যায়। সে খুব নরম মনের ভালো মানুষ।ওকে যত্ন করে। মাঝেমাঝে নাস্তা দেয়। লেখাপড়ার খোঁজখবর নেয়। তাকে দেখতে অনেকটা তার মায়ের মতো।হাবিবের ইচ্ছে করে তাকে খালা বলে ডাকতে। ডাকে না। সাহস পায় না। বলা যায় না, বড়লোকের বউ যদি মাইন্ড করে, যদি তার টিউশনিটা চলে যায়? তাই কাকী বলে ডাকে। অনেক কষ্ট করে টিউশনিগুলো ম্যানেজ করা। আজ-কাল ছাত্রের চেয়ে প্রাইভেট পড়ানো মাস্টারের সংখ্যা বেশি। এখন স্টুডেন্ট স্যারের পেছনে ঘোরে না। প্রাইভেট পড়ানো মাস্টাররা স্টুডেন্টের পেছনে পেছনে ধরনা দেয়।

প্রায় আধাঘন্টা হাবিব বসে আছে। রাকিবের কোনো খোজ নেই। বোঝা যাচ্ছে কাকী রান্নাঘরে।রান্নাঘরটা বিল্ডিংয়ের বাইরে উঠানের পূর্বপাশে।  সেখান থেকে মাঝেমাঝে থালাবাসনের ঠোকাঠুকির শব্দ আসছে। রাকিবের কোথাও কোনো দেখা নেই।

লিলি চুপচাপ ঘরে ঢুকে নিরবে ঘর ঝাড়ু দিচ্ছে। হাবিব একবার ভাবলো, রাকিবের কথাটা জিজ্ঞেস করি। কিন্তু পারলো না। অনেকদিন সে এই বাড়িতে প্রাইভেট পড়াচ্ছে কখনো লিলির সাথে ওর কথা হয়নি। কথা হবে কি ওকে দেখলেই হাবিবের মনে আতঙ্ক কাজ করে। আতঙ্কে প্রেমের ফুল গোপনে ফুটে গোপনে ঝরে যায়।

লিলি খুব যত্ন করে আস্তেআস্তে ঘর ঝাড়ু দিচ্ছে। সে জীবনে কখনোই ঘর ঝাড়ু দেয়নি। আর রাকিবের ঘর তো প্রশ্নই আসে না। প্রায় প্রায় রাকিবের সাথে ওর তুমুল গ্যাঞ্জাম বাঁধে। লিলি এক কিল দিলে রাকিব দুই কিল দিয়ে দৌড় দেয়। সে তাকে কিছুতেই দৌড়ে ধরতে পারে না। যার সাথে ছুরি কাটাকাটি। তার ঘর এতো যত্ন করে ঝাড়ু দিচ্ছে কেনো?

হাবিব অবাক হচ্ছে। ও ওদের ভাই-বোনের ভিতরকার এই অম্লমধুর সম্পর্কের বিষয়টা ভালোই জানে। কোনো একটা ব্যপার নিশ্চয়ই আছে। কিছুতেই কিছু মিলছে না। লিলির এখনকার এই শান্ত নত ভাব তার স্বভাবের সাথে যায় না। হাবিব কষ্ট করে সাহস সঞ্চয় করে লিলিকে প্রশ্ন করলো।

- রাকিব কোথায়?

- বাজারে, আব্বার জন্য ভাত নিয়ে গেছে।

- এখন কোন ওয়াক্তের ভাত?এখন তো বিকাল।

হাবিব জানে লিলির বাপ অন্যদিন দুপুরবেলা বাড়ি এসে ভাত খেয়ে বিশ্রাম নিয়ে বিকালে দোকান খোলে।সোমবার,শুক্রবার কানাইহাট বাজারে হাটবার। হাটবারে সারাদিন খুব বেচাকেনা হয়। বাড়ি আসার সুযোগ নেই।সোমবার  রাকিব ভাত দিয়ে এসে প্রাইভেট পড়ে। শুক্রবার তো প্রাইভেট বন্ধই থাকে। আজ সোমবার আজ তো তার ভাত দিয়ে চলে আসার কথা।  আসছে না কেন?

লিলির কাছে এতো কথা জিজ্ঞেস করার সাহস হাবিবের নেই।

কাকী রান্নাঘর থেকে ডাক দিলেন,মনি, ঘর ঝাড়ু দেওয়া হয়েছে? এদিকে আয়।

লিলি বাধ্য মেয়ের মতো চলে গেলো। একটু পর সে এক ট্রে নাস্তা নিয়ে হাজির হলো। আপেল,আঙুর,কলা,বিস্কুট,চানাচুর,কেক,নুডলস। মাঝেমাঝে কাকী নাস্তা দেয়। হয়তো দুটো কলা। কোনোদিন এক প্যাকেট বিস্কুট। এতো নাস্তা আর স্বয়ং লিলি?  হাবিব হিসাব মেলাতে পারছে না।

রাকিবের ঘরে একটা টেবিল,দুটো চেয়ার। একটা মাঝারি সাইজের খাটও আছে। দুটো চেয়ারের একটাতে রাকিব বসে একটাতে বসে হাবিব।

লিলি নাস্তার ট্রেটা টেবিলের উপর রেখে বললো,নেন নাস্তা করেন। আমি চা আনি।

-চা!

-হ্যা।

-এতো কেন?

-কিছু না।

কিছু না মানে অবশ্যই কিছু। কী সেটা?

অল্প কিছু নাস্তা করে হাবিব চায়ে চুমুক দিলো। লিলি পাশে দাড়িয়ে ছিলো। হাবিব বললো,বসো। কোনো আপত্তি না করে লিলি হাবিবের পাশের চেয়ারটাতে গা ঘেষে বসে পড়লো।

হাবিব একেরপর এক বিস্মিত হচ্ছে। আজ হচ্ছেটা কী? আকাশের চাঁদ নিজেই ধরা দেবে নাকি?

হাবিব গরীব হলেও চেহারাটা খুব সুন্দর। সবসময় পরিপাটি থাকে, পরিচ্ছন্ন পোশাক পরে। ছিপছিপে পাতলা তার ফিগার। মাথা ভর্তি ঘন চুল। দেখলে মনে হয় খুব বড়লোকের ছেলে। আসলে তো তা না। বহিরমাঝি গ্রাম থেকে ৯ কিলোমিটার দূরে হরিপুর গ্রামে  মাত্র তিনশতক জমির উপর একটা মাটির ঘর,রান্না ঘর আর একটা গোয়াল ঘর আছে ওদের।  সব গাদাগাদি ঘিঞ্জি পরিবেশ। ঐ সম্পত্তিটুকুর ভবিষ্যৎ অংশিদার অনেক। মোট ২২ জন।

লিলি টকটকে ফর্সা একটা মেয়ে। সে রূপসী, ছাত্রী হিসেবে মোটামুটি ।ধনী বাপের মেয়ে।  আভিজাত্য তার চোখেমুখে। সবসময় তার বেপরোয়া ভাব। সহজে যেকোনো প্রতিষ্ঠিত পরিবারে প্রতিষ্ঠিত ছেলের সাথে তার বিয়ে হতে পারে। সামনে তার আলোকিত ভবিষ্যৎ। কিন্তু আজকের ঘটনা বলে দিচ্ছে সে অন্ধকারের যাত্রী।

আজকে আর রাকিবকে পড়ানো হলো না। চলে আসার সময় কাকী বললো,তোমার আব্বাকে একদিন নিয়ে আসবে।

কথাটা শুনে হাবিবের মনটা খারাপ হয়ে গেলো। তার বাপ কোনোদিন আসবে না। তবু সে বললো,আচ্ছা।

ফিরতে সন্ধ্যা হয়েগেলো।  মেসে ফিরে সে বিপদে পড়ে গেলো।রিপন সাহেব বেগুন-ইলিশ মাছ বাজার করে রেখে গেছে।  এখন ইলিশ মাছ আর বেগুনের তরকারি রান্না করতে হবে। আজ তার রান্নার পালা। অথচ জীবনে অনেক চেষ্টা করেও হাবিব বেগুন সেদ্ধ করার উপায় বের করতে পারেনি।

অসেদ্ধ বেগুন খাওয়া যায় না। রিপন সাহেব তার প্রিয় অসেদ্ধ বেগুন দিয়ে কষ্ট করে  ভাত খেয়ে হাবিবের সাথে কষে ঝগড়া করে এখন বসেবসে সিগারেট টানছে। বকা খেয়ে হাবিব লিলিদের বাড়ি পাওয়া জামাই আদরের সাদ ভুলে গেছে। সেও এখন একটা সিগারেট ধরিয়ে নিজের বেডে বসেবসে টানছে ।

বেশ রাত হয়ে গেছে। হাবিব ভাত না খেয়ে মোবাইলে ফেসবুক চালাচ্ছে। রিপন সাহেব রাগি কণ্ঠেই বললো,এইযে, হাবিব ভাই, ভাত খাবে না?শুধু আমাকে কাঁচা বেগুন খাওয়ানো? তুমিও খাবে। খাও। কচকচ করে খাও, আমি দেখি।  

হাবিব কথার উত্তর না দিয়ে নিজের কাজ করতে লাগলো।

একটা অপরিচিত নাম্বার থেকে কল হচ্ছে। রিসিভ করতেই একটা মিষ্টি মেয়েলি কণ্ঠ জানতে চাইলো,কী করছেন?

-আমি?

-না,হাবিব ভাই।

-ও, লিলি?

-অনেক গার্লফ্রেন্ড আপনার,তাই না?

-না,তা না। মোবাইলে তোমার কণ্ঠ প্রথমে চিনতে পারিনি। এতদিন শুধু চিৎকার চেচামেচি শুনেছি আজই প্রথম এত মায়াবি মিষ্টি কণ্ঠ শুনছি তো। মেলাতে পারছিলাম না। ভাত খেয়েছো?

-হ্যা। আপনি?

-খাবো খাবো করছি। খিদে খুজে পাচ্ছি না। আজ তোমাদের বাড়ি এত নাস্তা করেছি খিদে পালিয়ে গেছে , তিনদিন আর তাকে পাওয়া যাবে না।

-আসবেন, না কিছু খিদে ম্যাসেজ করে দেবো?

প্রেম কার জীবনে কখন কীভাবে আসে কেউ বলতে পারে না। কারো জীবনে প্রেম একটার পর একটা ইট সাজিয়ে বিল্ডিং গড়ার মতো ধিরে ধিরে  গড়ে ওঠে। কারো জীবনে হঠাৎ ঝড়ের মতো হুড়মুড় করে আসে।

হাবিব হৃদপিণ্ডে হাতুড়ির শব্দ শুনতে পাচ্ছে। শরীরে আগুন ধরে গেছে। কানাইহাট বাজারের মেস থেকে বহিরমাঝি গ্রামে লিলিদের বাড়ি মাত্র এক কিলোমিটার। হেটে গেলে দশমিনিট লাগবে। সাইকেলে গেলে লাগবে বড়জোর পাঁচ মিনিট।

--আচ্ছা,আমি আসছি।

--সত্যি?

--হ্যা।

-একটা খুশির সংবাদ আছে।

-কী?

-আসেন। আসলে বলবো। বিকালেই বলতে চেয়েছিলাম। বলি,বলি করেও বলা হয়নি।

-এখন বলো।

-আসলে বলবো।

কথাট শোনার জন্য এখন হাবিবের মন প্রজপতির রঙিন ডানার মতো রঙে-রঙে ছটফট করছে।

লিলির সাথে কথা বলতে বলতেই আরেকটি কল আসলো। হাবিব বললো,লিলি কেটে দাও। আমার আব্বা কল করেছে।আব্বার সাথে কথা শেষ করে আমি আসছি।

অসেদ্ধ বেগুনের তরকারি খেয়ে রিপন সাহেবের মেজাজ বিগড়ে আছে। সে কটমট করে হাবিবের দিকে তাকিয়ে আছে। হাবিবের দীর্ঘমেয়াদি রসের আলাপে তার রাগ বেড়ে যাচ্ছে।ব্যাপার বুঝে  হাবিব রুম থেকে বের হয়ে গলির ভিতর দাড়িয়ে বাপের সেটে কল ব্যাক করলো।

মেসে দুটো-দুটো চারটি রুম।মাঝখানে গলি। গলির শেষ মাথায় বাথরুম আর টিউবওয়েল।

রাত বেশ হয়েছে কিন্তু সবগুলো রুমের দরজা খোলা, সবাই জেগে আছে। গলির ভিতর দাড়িয়ে কথা বললে যেকেউ নিষেধ করতে পারে। এয়ারফোন লাগিয়ে আস্তে কথা বললে হয়। কিন্তু তার বাপ আস্তে কথা বলেও না শোনেও না।

হাবিব বাথরুমের সামনে এলো। কিন্তু বাথরুমে কেউ একজন পটপট শব্দ করে প্রাকৃতিক কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। বিকট গন্ধ আসছে। বাধ্য হয়ে হাবিব কলপাড়ে সরে এলো। সেখানে সামনের রুমের রবিউল ভাই। রবিউলের ঘন প্রচ্ছাবের সমস্যা আছে।  বাথরুম বন্ধ পেয়ে রবিউল ভাই কলপাড়ে দাড়িয়ে চনচন করে ঝাড়ছে। রবিউল আজ ডিম সেদ্ধ খেয়েছে বোঝা যাচ্ছে। প্রচ্ছাব থেকে সেদ্ধ ডিমের গন্ধ আসছে।

মোবাইলের অপর প্রান্ত থেকে হাবিবের বাপ চিৎকার করে উঠলো,কিরে কথা বলছিস না কেন? তুই মেসে রাজার হালে জীবন কাটাচ্ছিস আর এদিকে আমার কী অবস্থা জানিস?

না। হবিব জানে না তার বাপের এখন কী অবস্থা। একবছর তার সাথে যোগাযোগ বন্ধ।গতবছর বাপ অসুস্থ হয়ে ছোট মা'র ওখানে ছিলো। হাবিব আর ওর মা দেখা করতে গিয়েছিলো। সেখানে প্রচণ্ড গ্যাঞ্জাম। সেই থেকে  কল করলেও বাপ ধরে না। অথচ আজ সে নিজে উপযাচক হয়ে কল করেছে। নিশ্চয় ব্যাপার গুরুতর।

-কি রে কথা বলছিস না কেন? আমার পাঁচশ টাকা টাকা লাগবে। এই নাম্বারে বিকাশ করে দে। তোর ছোট বোন মিনু অসুস্থ ওষুধ কিনতে হবে।

- ছোটমা’র মেয়ে ঐ মিনু গত বছর আমার মা’র মাথা ফাটিয়ে দিয়েছিলো। মনে নেই তোমার? ও আর ওর মা,ভাই,বোন সবাই মিলে আমাকে আর মাকে মেরেছিলো। তুমি ভুললেও আমি তো ভুলে যায়নি। আজ একবছর তুমি বাড়ি আসো না, খোজ নাও না। ছোট মা'র বাড়ি থাকো। আমরা বেঁচে আছি না মরে গেছি খোজ নিয়েছো? আর এখন মাসের শেষ আমার পকেটে মাত্র একশ টাকা আছে। এখন কেউ ধারও দেবে না। আমি কোথায় পাঁচশ টাকা পাবো? মা আজ এক সপ্তা জ্বরে পড়ে আছে। টাকা অভাবে ভালো ডাক্তার দেখাতে পারছি না। তোমাকে কোথা থেকে টাকা  দেবো?

-দিবি না?

-না থাকলে কোথা থেকে দেবো?

-ঠিক আছে আগামীকাল বাড়ি যেয়ে সবকটার ঘাড় ধরে বের করে দেবো। তুই তোর মা -বোন নিয়ে কোথায় থাকিস দেখবো?

রাগে গজগজ করতে করতে সিদ্দিক মোল্লা ফোন রেখে দিলো। হাবিব চিন্তায় পড়ে গেলো। তার বাপের পাঁচ বউ। একজনের উপর কঠিন কঠোরতা সে দেখালে দেখাতেও পারে।

পরেরদিন পড়াতে যেয়ে হাবিব দেখলো রুমে রাকিব নেই। রাকিবের চেয়ারে লিলি বসে আছে। তার হাতে প্রেমের উপন্যাস -দেবদাস।

-কী ব্যাপার তুমি? রাকিব কই?

-ও মেজো খালার বাড়ি গেছে খালাকে আনতে। কাল আসবে। আপনি কাল আসলেন না কেন?

-আব্বার সাথে কথা বলতে বলতে অনেক রাত হয়ে গিয়েছিলো, মেসের গেটেও তালা মারা হয়ে গিয়েছিলো। তা ভালো সংবাদটা কী শুনি।

-আপনি আমার বড় দুলাভাইয়ের কাছে একটা সিভি দিয়েছিলেন না?

-হ্যা।

-চাকরিটা হবে।

-সত্যি?

-হ্যা। বড় দুলাভাই কাল আসবে। আপনি কাল বিকেলে অবশ্যই আসবেন। আর হ্যা আব্বাকে আসতে বলবেন।

-আমার আব্বা? কেন?

-জানি না। মা বলেছে।

আষাঢ় -শ্রাবণে ভরা পূর্ণিমার চাঁদ ঝট করে জ্বলে উঠে চারিদিক খুশির প্লাবনে ভাসিয়ে আবার টুপ করে মেঘের আড়ালে লুকিয়ে পৃথিবীকে মৃত্যুর মতো অন্ধকারে ঢেকে ফেলে। হাবিবেরও সেই দশা । ওর আশার আকাশ এখন আশংকা মেঘের আড়ালে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে।

আই,এ পাশ করে হাবিব বিভিন্ন চাকরির চেষ্টা করে যাচ্ছে। হচ্ছে না। একটা চাকরিই পারে ওর জীবনে একটু সুখের পরশ দিতে। চাকরিটা হলে সে একটা বাসা নেবে। বাসায় মা থাকবে, বোন দুটো থাকবে। আর থাকবে লিলি। ছিমছাম পরিপাটি দুটো বাথরুম থাকবে। ওর মা সেখানে পরিষ্কার পরিছন্ন পানিতে গোসল করবে। সারাজীবন ধরে ওর মা,বোনেরা বাড়ির পাশের প্রায় পুজে পরিণত হওয়া দূষিত ময়লা পানির পুকুরে গোসল করে।

হাবিবের ইচ্ছে চাকরি হলে আস্তে আস্তে পয়সা জমিয়ে লিলিদের মতো অনেক জায়গা নিয়ে গ্রামে সবুজ সুন্দর একটা বাড়ি বানাবে ও।এছাড়া লিলিকে নিয়েও কতো হাজার স্বপ্ন যে ওর আছে!  লিলির মুখ থেকে চাকরির কথা শুনে ওর সমস্ত স্বপ্নেরা আনন্দে একসাথে নেচে উঠলো। কিন্তু এর ভিতর আবার আব্বা কেনো? ওর আব্বা কোনোদিন আসবে না। আব্বা এখন আর ওদের নেই। এখন সে ছোট মা আর তার ছেলেমেয়ের। হাবিবের আব্বা থেকেও নেই। কী করে সে আব্বাকে আনবে? আর চাকরি হবে তার। আব্বাকে দিয়ে এরা কী করবে?

পরেরদিন দুলাভাই এলো। জানাগেলো চাকরিটা অফিসিয়াল। হাবিবের যেহেতু কম্পিউটার জানা আছে তাই চাকরিটা হবে। যে কোম্পানিতে দুলাভাই বড়ো অফিসার, চাকরিটা সেই কোম্পানিতেই। দুলাভাই এর সুপারিশে হচ্ছে। কিন্তু তার আগে হাবিবের বাপকে আনতে হবে।

দেখতে দেখতে দুই সপ্তা চলেগেলো হাবিব আনি আনি  করেও তার বাপকে আনতে পারলো না।

সেদিন বিকেলবেলা রাকিব তাড়াতাড়ি পড়া শেষ করে বাজারে চলেগেলো। হাবিব উঠতে যাচ্ছিলো। লিলি এসে বললো,বসেন।

-কেন?

-মা নাস্তা তৈরি করছে। আপনাকে বসতে বলেছে।

কথগুলো বলতে যেয়ে লিলির গলা বারবার কেঁপে উঠছিল। হাবিব দেখলো লিলির চোখ দুটো কান্নার অশ্রুতে টলমল করছে।

হাবিব বললো, বসো।

লিলি বাধ্য মেয়ের মতো তার পাশে বসলো। তারপর কান্না জড়ানো কণ্ঠে বললো,আপনি আব্বাকে আনছেন না কেন?

-আচ্ছা, আমার চাকরির সাথে আব্বার আসার সম্পর্ক কী?

-আপনি বোঝেন নি?

-না। তুমি একটু বুঝিয়ে বলো।

-বুঝিয়ে বলবো? আপনি এতোদিন আমাদের বাড়ি আসছেন আমাকে দেখছেন তবু কিছু বোঝেন নি? কেন আমি মা’কে ধরে, দুলাভাইকে ধরে আপনার জন্য চাকরিটার ব্যবস্থা করেছি। মা'র কাছে কেঁদে কেটে আব্বাকে পর্যন্ত রাজি করিয়ে ফেলেছি। আর আপনি আজ বলছেন বুঝিয়ে বলতে হবে? আপনাদের বাড়ির পেছনের ফজলি আমগাছটাতে আমি গলায়দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করবো তাই আপনার আব্বাকে আসতে বলেছি। তার অনুমতি নেবো। এইবার বুঝেছেন?

কথাগুলো বলতে বলতে লিলি হাউমাউ করে কেঁদে ফেললো। কাঁদতে কাঁদতেই সে উঠে চলেগেলো।

হাবিব অনড়  পিলারে পরিণত হয়েছে। তার মাথার উপর অসংখ্য ছাদের চাপ। এতো চাপ সে নিতে পারছে না। সে ভেবেছিলো, তার ভালোবাসা একপাক্ষিক। কিন্তু একি! লিলি তো বহু আগেই রিতিমতো মরে বসে আছে আর ও মাত্র মরার প্রস্তুতি নিচ্ছে। তার বাড়ির পিছনের ফজলি আমগাছটা দাদা লাগিয়েছিলো। সেই আমগাছটার খোজ যে রাখে সে নিশ্চয় আরো অনেক খোজখবরই রাখে। সব জেনে বুঝেও লিলি তাকে ভালোবাসে? শুধু যে ভালোবাসা তাতো না সে মনেমনে ঘর বাঁধার সমস্ত প্রস্তুতিও সম্পন্ন করে ফেলেছে। সত্যি লিলির কোনো জবাব নেই। আর ও একটা ছেলে হয়ে শুধু মনেমনে ভালোবেসে বসে আছে আর কিছু না। লিলির ভালোবাসার শক্তির কাছে হাবিবের প্রেম নিতান্ত ছেলেমানুষী।

এতো যে ভালোবাসে তার কাছে সবকিছু পরিষ্কার করে না বললে সে ভুল বুঝে আরো বেশি কষ্ট পাবে। লিলিকে ডেকে সব বলতে হবে।

অনেকক্ষণ অপেক্ষার পরও লিলি এলো না। এইবার হাবিব যাওয়ার জন্য উঠে দাড়ালো। তখন  ট্রে ভর্তি নাস্তা নিয়ে কাকী আসলো। পেছনে পেছনে লিলিও আসলো। নাস্তা টেবিলের উপর রেখে কাকী সরাসরি জানতে চাইলো,লিলি কাঁদছে কেনো? তুমি ওকে কী বলেছো?

কাকীর সরাসরি এইরকম প্রশ্নে হাবিব কিছুটা ভয় পেলো। ভয়ে মুখটা ছোটো হয়ে গেলো। লিলি বিষয়টা বুঝে বললো, মা,স্যারের কোনো দোষ নেই। সব দোষ আমার।

এখন ভয়পেয়ে চুপ করে থাকা আর বেইমানি করা একই কথা। হাবিব মুখ খুলতে বাধ্য হলো।  তার পরিবারের সাথে বাপের সম্পর্ক এবং অন্যান্য সমস্ত বিষয় বুঝিয়ে বললো। সব শুনে কাকী বললো,লিলির কান্নাকাটি দেখে আমি ওর বাপকে অনেক বুঝিয়েছি। শেষে সে তোমার আর লিলির বিয়ের ব্যাপারে রাজি হয়েছে। কিন্তু তোমার বাপের সাথে লিলির বাপ কথা বলতে চায়। কালকেও আমাকে বলেছে কই, হাবিবের বাপ আসলো কই?

লিলি বললো,সামান্য পাঁচশ টাকার জন্য আপনি বাপের সাথে ঝগড়া করেছেন? মা, স্যারের এইমাসের টাকার সাথে একমাসের এডভান্স দিয়ে দাও।

মা উঠে টাকা আনতে গেলো। শিউলি বললো,আপনি কিন্তু আব্বাকে আজই টাকাটা দেবেন। তাকে রাজি করিয়ে দুই একদিনের ভিতর নিয়ে আসবেন। বলা যায় না। আমার আব্বার মন আবার কখন ঘুরে যায়।

মেসে ফিরে হাবিব ওর বাপের সেটে কল দিলো। মোবাইল ব্যস্ত দেখাচ্ছে। চতুর্থ বার মোবাইল রিসিভ হলো। হাবিব সালাম দিয়ে শেষে বললো,আব্বা,টাকা ম্যানেজ হয়েছে। পাঁচশ পাঠাবো না ছয়শ?

-তোর একটাকাও লাগবে না। মিনু সকালে মারা গেছে। আছরের পর মাটি হয়েছে। তোর জন্যে মিনু মরেছে। কাল আমি লোকজন নিয়ে আসবো। আমার বাড়ি আমি ভেঙে ফেলবো। তোরা আমার বাড়ি ছেড়ে দিবি।

হাবিব সারারাত কান্নাকাটি করলো।কাঁদতে কাঁদতে সে ভোরের দিকে ঘুমিয়ে পড়েছিলো ৭টার সময় লিলির কলে তার ঘুম ভাঙলো। সব শুনে লিলিও কাঁদতে লাগলো।

লিলির বাপ স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে –হাবিবের বাপ না আসলে কিছুই হবে না।

Comments

    Please login to post comment. Login