“এই, ফুক অর্থ কীরে?”
সফর আলি আইডিয়েল স্কুলের ক্লাস নাইনের ক্লাস। টিফিন পিরিয়ডের শেষদিক। মেয়েদের সিটের কাছাকাছি দিকটায় সিয়াম, আশিক দাঁড়িয়ে। আমি ঠিক বুঝলাম না ফাহিমের প্রশ্নটা।
“ফুক আবার কী? বানান কর।"
নিশাতের মুখে কিছুটা হাসি সবসময়ই লেগে থাকতো। সম্ভবত, যাতে কখনোই ওর কোনো কথায় কেউ কষ্ট না পায়। নিশাত আমার দিকে দৃষ্টি ফেরায়। ওর দৃষ্টি এমনিতেও সবার দিকে যেত। ব্জিজ্ঞেশ করলো,
“এফ ইউ সি কে, ফুক। ফুক অর্থ কী?”
নিশাতের বয়ফ্রেন্ড ওকে চিরকুট দিয়েছে। সেখানে এই শব্দ। লেখা, “I want to fuck you.”
আমি ফাহিম আর আশিককে এর অর্থ জানালাম। ওদের মুখে চাপা কৌতুক। আশিক অঙ্গভঙ্গি করে বললো,
“ঐযে ইন্দুর যে গর্তে ঢুকে না? ফুক হইলো ঐডা।”
নিশাতের মুখ দেখে বোঝা গেল না ও বুঝেছে কিনা। একটা অকওয়ার্ড হাসি টেনে আনলো মুখে। হতে পারে এমন একটা হাসি, যার দ্বারা ও বোঝাতে চাচ্ছে যে ও কিছু বোঝে নাই। এবং হয়ত যার দ্বারা বোঝা যাচ্ছিলো যে আমরা বুঝেছি যে ও বুঝেছে।
*
নিশাত কালো। একদম শুকনা। চেহারায় ব্রন। ঐ বয়সে সবারই পালা করে উঠতো, কিন্তু ওর বেশি, দাগ দাগ হয়ে গিয়েছিলো। স্বভাবতই আমাদের ব্যাচের কেউই ওর প্রেমে পড়ি নাই, কিংবা নিদেনপক্ষে ভালোও লাগে নাই ওকে। তবে ওর রুচি ভালো ছিলো। আমি সামিয়াকে ভালোবাসতাম, ও দেবের ফ্যান ছিলো। সামিয়া খুব সুন্দর ছিলো, পড়াশোনাও ঠিকমতো করতো। ডেডলি কম্বো। সঙ্গে হারুন স্যারের প্রিয় হওয়ায় আমাদের মধ্যে ওর সামাজিক প্রভাব ভালোরকমের। ও এসব কখনো সচেতনভাবে প্রয়োগ করতো না। তবে ওর সৌন্দর্যের মতোই, ছড়িয়ে পড়তো। ওর প্রিয়ভাজন হওয়ার জন্য আমাকেও কিছুকালের জন্য দেব ফ্যান হতে হয়েছিলো। ক্লাসে মাঝে মাঝেই এসব নিয়ে আলাপ উঠত। আলাপের জন্য মুখিয়ে থাকতাম, কিংবা আমিই আলাপ শুরু করতাম। এতে করে সামিয়ার সঙ্গে কথপোকথনের একটা ক্ষেত্র তো তৈরি হতো। সেসব কথপোকথনে যদিও আমি শ্রোতাই হতাম বেশি। সামিয়ার দিকে চেয়ে থেকে মনে হতো অনন্তকাল কাটিয়ে দেয়া যায়। স্কুলড্রেসে ওকে এত সুন্দর লাগতো!
সেসব আলাপেই একবার নিশাত জানায় ওর প্রিয় অ্যাক্টর রনবীর কাপুর। শুনে খুব খুশি হলাম, কিন্তু তা প্রকাশ করার আগেই সামিয়াসহ আরো কজনের তুমুল আপত্তি উঠলো। সামিয়ার বিরুদ্ধে যেয়ে নিশাতের পছন্দকে সম্মান দিতে পারলাম না। সামিয়া যেমন বলতো সর্বদা, তখনও বললো, “রনবীর একটা নায়ক হইলো! লুচ্চা আর ইম্যাচিওর।” অপিনিয়ন লিডারের টেক্সটবুক উদাহরণ। নিশাতের বক্তব্য একজনের সমর্থনও পেল না। শুধু মৌন সমর্থন পেয়েছিলো একজনের, আমার।
*
কলেজে উঠে নিশাত আর আমি আলাদা হয়ে গেলাম। ও এক কলেজে, আমরা ছেলেরা আরেক কলেজে। ফেসবুকে ওর দুঃখভারাক্রান্ত পোস্ট দেখতে দেখতে বিরক্তি এসে যায় অবস্থা।
একদিন সিয়ামের সঙ্গে বাসস্ট্যান্ডে কীভাবে কীভাবে যেন নিশাত প্রসঙ্গ উঠলো। ততদিনে সোলাইমান সুখনের বেশ কিছু ভিডিও দেখেছি।
“বুঝছস সিয়াম, একটা মানুষের তো কিছু না কিছু দিতে পারার থাকতে হয়। ওর না আছে সৌন্দর্য, না ও পড়াশোনায় ভালো, না অন্য কোনো দিক দিয়ে ও পোষায়ে দিতে পারবে। তবে কেন কেউ ওকে ভালোবাসবে বল?”
“হু, এইডাই তো বুঝতে হইব।”
*
ইউনিভার্সিটিতে পড়ি তখন। একদিন জানলাম নিশাতের ক্যান্সার। ঢাকার সড়ক তখন ফাকা ফাকা। মেয়েটার মা ছিলো না। বাবা আরেকটা বিয়ে করে। সৎমা কষ্ট দিত। ফেসবুকে ওর লেখা পড়তাম। ফেক আইডি থেকে নিজের পোস্টে কমেন্ট করতো, সেই কমেন্টের উত্তরও দিত। আমি বুঝতাম, বুঝতে দিব না কখনোই এমন ভাবতাম। স্কুলের শেষদিনে ও আমার দিকে কেমন করে যেন তাকাইছিলো। ওর তো বয়ফ্রেন্ড ছিলো, যে ওকে ফাক করতে চায়। তাহলে আমার দিকে ওভাবে তাকাবে কেন? ভুল দেখা, ভুল সংকেত। ভুলের দিকে পিছন ফিরে তাকাবার সময় আমার ছিলো না। জীবনের নানাবিধ জটিলতায় পূর্বকল্পিত পথ থেকে ক্রমশ অব্যর্থভাবে সরে যেতে থাকলাম, কাল ও বাস্তবতার হিসাবনিকাশ বেসামাল হাত থেকে ফেলে দিলাম, যেন একটা রহস্যময় নদীর মাঝে হারিয়ে গেল। নিশাতের কথা ভেবে সব যাত্রা-পথচলা অর্থহীন মনে হলো। কেন কেউ কেউ সারাজীবনে কিছুই পায় না, খালিহাতে ফিরে আসে?
*
নিশাত ক্যান্সার জয় করেছিলো। ওর সংসার আছে। স্বামী-স্ত্রী। আমি পড়াশোনার শেষ করে চাকরিতে ঢোকার চেষ্টা করে চলছি। আমার শরীর খারাপ। পেটে প্রচন্ড ব্যাথা। একটু নড়লেই কাতরানি ওঠে। ডাক্তার দেখানোর পর্ব বাদ দিতে চাই, কারণ টাকা নাই। মৃত্যুর প্রস্তুতিমূলক ভাবনা মাথায় আসা শুরু করেছে। সাদা টেবিলক্লথ দেয়া আমার টেবিলে। জানালায় সবুজ দেখা যায়। আকাশ ধূসর। ঘন্টা দুই আগে মায়ের জন্য শ্যাম্পু, সাবান আর কী যেন কিনে এনেছিলাম, মনে নাই। গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি পড়ছিলো। মা বাইরে থেকে বললেন, বিলে নাকি অনেক বক। সাদা সাদা বক। দেখার ইচ্ছা জাগলো মুহূর্তের তরে। তারপর উবে গেল।