Posts

গল্প

ঘন্টা

October 3, 2025

ইহতেমাম ইলাহী

41
View

সাইকেল চালিয়ে বাড়িতে আসছি দোলাবাড়ি থেকে। আমাদের এদিকে ফসলের ক্ষেতকে দোলাবাড়ি বলে। দুষ্ট কিছু মানুষ দুপুরের দিকে ছাগল ঢুকিয়ে দেয় ধান ক্ষেতে। এই সময় মানুষ গোসল করে, নামাজ পরে। চারটা খেয়ে ঘুম দেয়। এই সুযোগটাই কাজে লাগায় ছাগলের মালিক। ক্ষেত খাইয়ে দেয়। আমাদের ধান ক্ষেত ঘুরে এলাম। চারপাশ ঘুরে দেখলাম, ছাগল নেই ।  এখন বোধয় দুপুর সারে বারোটা বাজে। তপ্ত রোদে ফতুয়া ভিজে গায়ের সাথে লেপ্টে আছে। সাইকেল দ্রুত চালাচ্ছি। বাড়ি গিয়েই গোসল দিব। এইত আর ১০০ মিটার হবে বাড়ি। গলাটা শুকিয়ে গেছে। এমন ঝাঁঝালো রোদ!
সাইকেল চালাতে চালাতেই হঠাৎ করে আমার হাঁপানির টান উঠে গেল। আমার এরকম হয় মাঝে মধ্যেই। ইনহেলার থেকে গ্যাস নিলেই আলহামদুলিল্লাহ ঠিক হয়ে যায়। কিন্ত, সাথে ইনহেলার নেই । বাড়ি গিয়ে গ্যাস নিলেই হবে। সাইকেল একটা গর্তের উপর দিয়ে উঠে গেল। খেয়াল করি নি। বেশ ধাক্কা লাগল শরীরে ! কাশতে লাগলাম আমি। উফ! বুক কেমন যেন চেপে আসছে। 

কিভাবে বাড়ি এসে পৌঁছালাম হুঁস নেই। সাইকেল ফেলে আমার মেয়েকে ডাক দিলাম।       
  আসমা। 
  আসি, বাবা। 
  আয়রে  মা। ইনহেলার টা নিয়ে আয়। 

আসমা আমার দিকে তাকিয়ে দৌড়ে এল। আমি বারান্দার পিলার ধরে দাঁড়িয়ে আছি। মেয়েটা চিৎকার করে উঠল। আমার শরীরের খিঁচুনি দেখে সে মনে হয় ভয় পেয়ে গেছে। মেয়ের  মা’ও দৌড়ে এল। ইনহেলার হাতে নিয়ে মুখে নিব। পারলাম না। শরীর দুলতে লাগল। আমি পড়ে গেলাম। মেয়ের মা ইনহেলার  মুখে দিয়ে পাম্প করে অনেকগুলো গ্যাস ভরে দিল। আমি চোখে অন্ধকার দেখতে পাচ্ছি । পুরো শরীর কাঁপছে। চোখের সামনের অন্ধকার আরও গাঢ় হচ্ছে। পৃথিবীটা দুলছে মনে হয়। ভীষন এই দুলুনি। কতক্ষণ সময় গেল জানি না। অনেক মানুষের চিৎকারের শব্দ শুনতে পাচ্ছি। আশপাশের বাড়ি থেকে অনেকই বোধয় দৌড়ে আসছে। সেই দৌড়ানোর শব্দ পাচ্ছি। আমি শ্বাস নিতে পারছি না। কানও মনে হয় বন্ধ হয়ে যাচ্ছে । আমার চারদিক অন্ধকার আর শব্দহীন হয়ে যাচ্ছে । আমার খুব পিপাসা পেয়েছে। রোদ থেকে এসে পানি  খাই নি। গলা শুকিয়ে কাঠ। পিপাসার কথা কাউকে বলতেও পারছি না। সেই বোধ আমার নেই। সামান্য একটু পানি মুখে ঢেলে দিয়ে কেউ যদি গলাটা  ভিজিয়ে দিত! সামান্য একটু পানি ! তবে আমি এখন পানির থেকেও অক্সিজেনের প্রয়োজন বেশি অনুভব করছি। শ্বাস নিতে পারছি না। বুক চেপে যাচ্ছে। আহ, সারা শরীরে ভীষন কষ্ট । আমি কি আজ মারা যাব? আল্লাহ, আল্লাহ। আল্লাহ, রক্ষা করো আল্লাহ। আমি  নিঃশব্দ আর্তনাদ করছি । কেউ না শুনলেও আল্লাহ নিশ্চয়ই শুনতে পাচ্ছেন। 


আমি এখন কোথায় বুঝতে পারছি না। ফ্যান ঘোড়ার শব্দ শুনতে পাচ্ছি। সম্ভবত আধশোয়া হয়ে আছি বা কেউ আমাকে ধরে রেখেছে।  আমার বুক উঠানামা করছে কি না বুঝতে পারছি না। আমার শরীর নিথর। আশপাশে যদি কেউ থাকে, তারা অন্তত তাই ভাবছে। কিন্তু, ভেতরে আমি তো জেগে আছি। হ্যাঁ, প্রাণপন জেগে আছি। আমার ফুসফুস অক্সিজেন নেয়ার জন্য পাগল হয়ে আছে। আমার শ্বাসনালী সংকুচিত হয়ে এক পাশ আরেক পাশের সাথে মিলেই গেছে মনে হয় । ফুসফুস অক্সিজেন পাচ্ছে না, শরীরের কোষগুলোতে অক্সিজেন যাচ্ছে না। আমি চাচ্ছি প্রবল চিৎকার করে উঠে বসতে, নাক মুখ খুলে বুক ভরে শ্বাস নিতে। কিন্তু প্রাণপণ চেষ্টা করেও আমি আমার চোখ দুটিই খুলতে পারছি না। আমার অন্তরাত্মা উন্মাদ হয়ে গেছে মুক্ত বাতাসে শ্বাস নিতে। মনে হচ্ছে এই কষ্টের চেয়ে মৃত্যু স্বস্তির। মৃত্যুতে অন্তরাত্মা মুক্তি পাবে। আমি শ্বাস পাচ্ছি না, আমি শ্বাস পাচ্ছি না। আমি ক্লান্ত হয়ে গেছি। আমি কি লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ… পড়ব? পড়াই মনে হয় উচিত হবে। বেঁচে থাকার আশা কি আছে? আমি কাঁদছি। আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি– আমার চোখের কোণা দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে। কিন্তু এটা কীভাবে সম্ভব? আমি তো চোখ বুজে আছি। এই অবস্থায় তো চোখের পানি দেখা সম্ভব নয়। আচ্ছা, আমাকে কি হাসপাতালে নেয়া হয় নি? হাসপাতালে নেয়া হলে তো নাকে অক্সিজেন দিত? আমি শান্তি পেতাম। একটা বড় শ্বাস নেয়ার শান্তি। আর কিছু না। আর কিছু না। আল্লাহ, আল্লাহ। 

আমার চেতনা কমে যাচ্ছে। আর কিছু ভাবতে পারছি না। জগতটা ধূসর লাগছে। মনে হলো আমার মেয়েটা দৌড়ে এল। আহ, প্রিয় মুখ। প্রিয় মুখটা ফিকে হয়ে আসছে। আরেকটু দেখি। আরেকটু। আর কিছু দেখছি না। মনে হয় বুকের উপর ১০ মণের পাথর চাপা দেয়া। এই পাথরের ওজন বাড়ছে ধীরে ধীরে। কষ্ট, কষ্ট। অকল্পনীয় কষ্ট। আহ। লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ। 


চারপাশে কাউকে দেখতে পাচ্ছি না। সাদা ধোঁয়ার মত মনে হচ্ছে সবকিছু । আবছা দৃষ্টিতে দেখছি। শরীরের কষ্ট আর নেই। মনে হচ্ছে শূন্যে ভাসছি। মরে যাওয়ার পরে কি এমন লাগে? কানে কার কথা যেন ভেসে আসছে? কে কথা বলছে? আমার মত মৃত কেউ? আমার দৃষ্টি ঘোলাটে হয়ে গেল। গাঢ় ধুসর দেখছি। কুয়াশা কুয়াশা। ঠান্ডা ঠান্ডা লাগছে। 

এই তো রোগী চোখ খুলে আছে! আলহামদুলিল্লাহ। 
স্পষ্ট শুনতে পেলাম। মানে কী? আমি মরে যাই নি? সাদা এপ্রন পরে একটা মাঝবয়সী মানুষ এগিয়ে আসছে। তার মুখ হাসি হাসি। হ্যাঁ! আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। লোকটা মনে হয় ডাক্তার। আমার চোখ পরীক্ষা করছে। আমি তার হাতের স্পর্শ পেলাম। এইতো বাম চোখটা দেখছে এখন। আল্লাহু আকবার। আমি তাহলে মরি নি। হাতের নাড়ি দেখে লোকটা চলে গেল। এখন আমি একা। এটা মনে হয় হাসপাতালের কোনো রুম। এটা আমাদের উপজেলা হাসপাতাল? আমাদের বাড়ি থেকে ৪ কিলোমিটার দূরেই। আমার স্ত্রী ও মেয়ের গলা শুনতে পাচ্ছি। এইতো তারা ঘরে ঢুকছে। দুজনই কাঁদো কাঁদো স্বরে কী যেন বলছে! তারা এসে বসল আমার দু দিকে। দুজন দুটো হাত ধরে থাকল। আমার মনে হলো– জীবন কত আনন্দের! এর প্রতিটা মুহুর্ত কত ঐশ্বর্য্যময়! আমি আমার স্ত্রী কন্যাকে বলতে চাইলাম– তোমরা আল্লাহর প্রশংসা করো!  মুখ খুলতে চাইলাম। পারলাম না। দেখি– দুজনেই আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি হাসলাম। এই হাসি মনে হয় আমার চেহারায় ফুটে উঠল না। 


আমি এখন বেশ ভালো আছি। উপজেলা হাসপাতাল থেকে আমাকে জেলা হাসপাতালে নেয়া হয়েছে। এখান থেকে আজ রিলিজ দেবে। আলহামদুলিল্লাহ, খেতে পারছি। অক্সিজেন সিলিন্ডার ছাড়াই শ্বাস নিতে পারছি। আত্মীয় স্বজন আমাকে ঘিরে আছে। তাদের পাশেই উপজেলা ডিউটি ডক্টরকেও দেখতে পেলাম। আশ্চর্য্য ! উনি কেন এখানে?

  বদরুল, আমাদের ডাক্তার সাব যা করছে! তোমার নিজের ভাই  হলে যা করত, তাই করছে। আজকে দেখতে আসছে তোমাকে। 
আমার মামাত ভাই আনাস বলল। 

  আসসালামু আলাইকুম, ডাক্তার সাহেব!
  ওয়া আলাইকুমুস সালাম! এখন কেমন বোধ করছেন?
    আলহামদুলিল্লাহ ভালো। 
  আপনাকে যখন হাসপাতালে নেয়া হলো, ইমার্জেন্সি সিচুয়েশন। অক্সিজেন সিলিন্ডারও দেখি কাজ করছে না। আমার মাথা খারাপের মত হয়ে গেল। একজনকে সেটা ঠিক করতে দিয়ে দ্রুত কিছু থেরাপি দিলাম। আল্লাহর ইচ্ছায়, সিলিন্ডার, মাস্ক ঠিক হলো। মাস্ক পরানোর পরেও আপনার শ্বাস ঠিক হচ্ছিল না। হাত পা কিছুটা স্টিফ হয়ে যাচ্ছিল। আল্লাহর দয়া, আপনার হায়াত ফিরে পেয়েছেন। হাসপাতালের দায়িত্ব ছিল আমার, আর অক্সিজেন সিলিন্ডার নষ্ট। আপনার হায়াত মৃত্যু অবস্থা। নিজের মধ্যে একটা অপরাধবোধ কাজ করছিল।একটা কাজে এসছি সদরে। ভাবলাম দেখে যাই আপনাকে । 

আমি বললাম, আলহামদুলিল্লাহ। আপনার অনেক শুকরিয়া। 
ডাক্তার দ্রুত বিদায় নিয়ে চলে গেলেন। 
আনাস বলল, বদরুল ভাই। ডাক্তার সাহেবরে দাওয়াত দেওন লাগবে বাড়িতে। তারে আমি আগে থেকে চিনি। খুবই ভালো ডাক্তার। এখনকার যুগে এমন ভালো ডাক্তার পাওয়া মুশকিল। 
আমি বললাম, ওনার বাড়ি কোথায়? 
    বাড়ি ঘোড়াঘাটে। এলাকারই মানুষ । 


 

দু’ সপ্তাহ পর। আজ বাড়িতে ফকির মিসকিন খাওয়ানো হবে। আল্লাহ আমার জীবন ফিরিয়ে দিয়েছেন এই উপলক্ষে।  খাসি জবেহ দেয়া হয়েছে। পাড়া, প্রতিবেশি, আত্মীয় স্বজন অনেকেই আসবে। দুপুর বারোটা পেরিয়ে গেছে । রান্না বসানো হয়েছে আগেই । বাবুর্চি ডেকে বলল,  বদরুল ভাই, খাসিটা নধর। কচি খাসি। মাংস হবে নরম। খেতে এত মজা হবে! মুখে দিলেই গলে যাবে। একজনই এক কেজি নামায় দিতে পারবে! হা হা। 
      ভালো করে রাঁধো!  শ’দেড়েক মানুষ হবে। মাংস কম পড়বে নাকি?
      গরুর মাংস ২০ কেজি, খাসির মাংস ২০ কেজি। কম পড়ত না, ইন শা আল্লাহ। 
      ইন শা আল্লাহ। 

ডাক্তার সাহেবকে একবার কল দিই। দেখি উনি বের হয়েছেন কি না। ডাক্তার সাহেবকে দাওয়াত দেয়া হয়েছে তার পুরো পরিবার সহ। তার সাথে কথা বলেই দাওয়াতের তারিখ ঠিক করেছি । আজ তার ছুটির দিন পড়েছে । আমি বলেছিলাম, গাড়ি পাঠিয়ে দিয়ে নিয়ে আসব । কিন্তু তিনি না করলেন। নিজে থেকে আসবেন বলেছেন।  
রিং হচ্ছে। ওপাশ থেকে ধরল না । আরেকবার দিই । ব্যস্ত মনে হয়। এবার না ধরলে এখন আর কল দেয়া যাবে না। মানী লোককে বিরক্ত করা ঠিক না। নিজের মত যখন খুশি আসুক। 

বাবুর্চি আবার ডাক দিল, বদরুল ভাই, রোস্ট টা খাইয়া দেখেন কেমুন হইছে!
আসি। 
হাকিম বাবুর্চির এই এক সমস্যা। ক্ষনে ক্ষনে ডেকে কথা শোনাবে। তবে রান্নায় ফার্স্ট ক্লাস । রোস্ট ভালো হয়েছে।  রাস্তায় মিশুকের আওয়াজ শোনা গেল। এইতো, আসমার মামারা এসেছে বোধয় । 
আত্মীয় স্বজন আসতে শুরু করবে ধীরে ধীরে । বাবুর্চিকে বললাম, যুহরের নামাজের পরপরই খানা লাগানো যাবে না? 
ইন শা আল্লাহ যাবে।
ইন শা আল্লাহ, আমি আসমার মামার সাথে দেখা করে আসি। মাংসের ঘ্রাণ ভালোই ছড়িয়েছে দেখি!
  হ্যাঁ! মশলা বেছে বেছে কিনছি বদরুল ভাই!

ফোন বেজে উঠল। ডাক্তার সাহেব কল দিয়েছেন, আলহামদুলিল্লাহ। তার জন্যই অপেক্ষা!
    আসসালামু আলাইকুম, ডাক্তার সাব। আপনি কোথায়? 
  ওয়া আলাইকুমুস সালাম! আমি ডাক্তার না। তার চাচাতো ভাই। ভাইজান মারা গেছেন কিছুক্ষণ আগে! আপনি কে বলছেন?

একটা কমবয়সী ছেলের কন্ঠ। কী বলে এই ছেলে? দুষ্টুমি করছে নাকি? 

  এই, কী বলেন আপনি ভাই?
হ্যাঁ। ডাক্তার ভাই মারা গেছে। বাজার থেকে আসার পরে হার্ট এটাক করছে। সুন্দর মানুষটা হঠাৎ করে নাই হয়ে গেল…

ছেলেটা এবার সত্যি কেঁদে ফেলল। আশ্চর্য্য, সেই কান্নায় মৃত্যুর শোক আমি স্পষ্ট বুঝতে পারলাম! 
হ্যালো। হ্যালো।

ভাইজান মারা গেছে। রাখি। 
ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রজীঊন। আমার মুখ থেকে অস্ফুট উচ্চারণ হল।

 

ফোন পাঞ্জাবির পকেটে রেখে দিলাম। কিন্তু আমি কী শুনলাম!  ডাক্তার সাহেব মারা গেছেন?  মোবাইল বের করে ঘড়ি দেখলাম, সারে বারোটা বাজে। ঐদিনও তো ছিল ভর দুপুর! যেদিন আমার ঘটনা ঘটতে যাচ্ছিল । আজ ডাক্তারের ঘটনা ঘটে গেল? এই ডাক্তার আমার মুমূর্ষু অবস্থায় চিকিৎসা করিয়েছেন! হায় আল্লাহ! আমার মাথা কেমন শূন্য হয়ে যাচ্ছে । নিজেকে অনুভূতিহীন লাগছে। শরীর দুলতে শুরু করেছে হঠাৎ। ঠিক সেইদিনের মত। কে যেন আমাকে ডাকছে, আমি স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি না। মনে হয় হাকিম বাবুর্চি চিৎকার করল, বদরুল ভাই, বদরুল ভাই। দৌঁড়ে আসছে সে। 



 

Comments

    Please login to post comment. Login