Posts

গল্প

বিয়ে

October 3, 2025

ইহতেমাম ইলাহী

56
View

পাটের আঁশ পাক দিয়ে দিয়ে দড়ি বানাচ্ছেন আছিমত মিয়া। দড়ি পেঁচিয়ে রাখছেন বাঁশের বেতের একটা চারকোণা কাঠামোতে। প্রতি হাটবার তিনি এই দড়ি বিক্রি করেন। বেশি দাম পাওয়া যায় না অবশ্য। তবে মৌসুমের পাট বিক্রি করে দেয়ার পরও কিছু পাট রেখে দেন তিনি। সেগুলো দিয়ে দড়ি পাঁকিয়ে পাঁকিয়ে প্রতি হাটবার বিক্রি করে টুকটাক খরচ চালাতে হয়। পাটের দামের তুলনায় এই দড়ির দাম পাওয়া যায় প্রায় দ্বিগুন। 

সকালে এক পশলা বৃষ্টি হয়েছে। বাড়ির উঠান ভেজা। এবার গমের নতুন নাড়া (খড়) দিয়ে ঘরের চাল তোলা হয়েছে। বর্ষায় আরাম হচ্ছে। নাহলে চাল বেয়ে বেয়ে পানি পড়ে। এবার সেই সমস্যা নেই। 

আকাশে আবার মেঘ করেছে। গুড়ুম গুড়ুম আওয়াজ হচ্ছে। আবার বৃষ্টি হবে প্রায় নিশ্চিত। বৃষ্টি বাদলার দিনে দড়ি পাকানোর কাজ করতে খুব আরাম। ঠান্ডা ঠান্ডা আবহাওয়া। বৃষ্টির ছন্দে অতি দ্রুত হাত ঘুরতে থাকে আছিমত মিয়ার। গত ৪০ বছর ধরে দড়ি পাকাচ্ছেন তিনি। তার মত দ্রুত গতিতে দড়ি পাকাবে, এই রকম মরদ এই এলাকায় নেই! ভাবছে আছিমত মিয়া। তার ঠোটে মৃদু হাসি। পাশেই রান্নাঘর থেকে ধোঁয়া উটছে। তার স্ত্রী মনা বিবি ভাত বসিয়েছে। এরপর রান্না হবে শিং মাছ দিয়ে বেগুন। তার স্ত্রী এই তরকারি যে কীভাবে রান্না করে! স্বাদ হয় ভয়াবহ।

বাইরে কার যেন কথা শোনা যাচ্ছে। হেঁটে এই বাড়ির দিকে আসছে। কন্ঠ অপরিচিত লাগছে। কে হতে পারে? আছিমত মিয়া কান উৎকর্ন করে। শোনা যাচ্ছে, হ্যাঁ, এইটা বাড়ি, এইটা বাড়ি। 

বাড়ি দিয়ে যাকে ঢুকতে দেখা গেল, তাকে দেখে আছিমত মিয়ার চোখ প্রায় উল্টে গেল। বুক ধড়াস করে উঠল। লোক দুটির একজন চিৎকার করে বলল, আরে আছিমত মিয়া, আছো কেমন? 
ভালো, ভালো। আপনে কেমন?

আছিমত মিয়া লোক দুটির বসার জন্য একটা লম্বা বেঞ্চি এগিয়ে দেয়। এ ছাড়া বসতে দেয়ার মত আর কিছু নেই তার বাড়িতে। তার হাত কাঁপছে। আতঙ্কে তার শরীর প্রায় অসার হয়ে আসছে। সে ভেবে পাচ্ছে না– আকবর ডাকাত তার বাড়িতে কি উদ্দেশ্যে এলো। এই ভয়ানক ডাকাত সর্দার ধনী মানুষদের বাড়িতে হানা দেয় রাত্রি বেলা। লুটপাট চালায়। বাড়ির কেউ বেশি উচ্চবাচ্চ করলে গুলি চলে। বাড়ির কোনো মেয়ে সুন্দরী হলে সে হয় ধর্ষনের স্বীকার। 

আকবর ডাকাত দিনে কারো বাড়ি আসা মানে, সতর্ক করে দেয়া। চাহিদামত নজরানা পাঠানোর নিশ্চুপ নির্দেশ। অথবা অন্তত তাদের দলের সবাইকে গরু খাসি দিয়ে দাওয়াত খাওয়াতে হবে। তাহলে সেই বাড়ি নিরাপদ। নাহলে, গজব নেমে আসে কয়েক রাতের মধ্যেই…

আছিমত মিয়া বলার মত কিছু পাচ্ছে না। আমতা আমতা করছে। সে বুঝতে পারছে না, তার মত নিম্নবিত্ত একটা মানুষের কাছে কী দরকার পড়ল এই ডাকাত সর্দারের। সে তড়িঘড়ি করে বলল, বাজি (বাবাজি) পান নিয়া আসি, পান। আপনেরা বসেন। 

আকবর ডাকাতের পাশে বসে আছে ছকু শেখ। কালো, বলশালী শরীর। চোখগুলো রক্তবর্ণ। দুজনই পান চিবাচ্ছে। আকবর ডাকাতের মুখ হাসি হাসি। আছিমত মিয়া হাত কচলাচ্ছে। 

    আছিমত!
    হ্যাঁ, বাজি। 
  তোমার ঘরে মেয়া কয়টা?
  তিন মেয়ার দুইটার বিয়া দিছি। ছোটটা বাড়িত থাকে। 
আছিমত মিয়ার হৃতপিন্ড গতি বেড়ে যাচ্ছে।  তার চেহারা রক্তবর্ণ। আজ তার হার্ট এটাকই বা হয় কি না, কে জানে!
    মেয়ার বিয়াশাদি দিবা না?
    হ্যাঁ, তা তো দিবার লাগবেই। 
    হ্যাঁ, বিয়া দাও। এই ছকুর সাথে বিয়া হবে। কি রে ছকু?

ছকু আছিমত মিয়ার দিকে তাকিয়ে দাঁত বের করে একটা হাসি দিল। ঘৃনায় আছিমত মিয়ার মুখে থুথু এসে পড়েছে। কিন্তু এদের সামনে সেই থুথু ফেলা যাবে না। 

আকবর ডাকাত আবার হাঁক পারে, তোমাগো কোনো অমত আছে? ডাকাইতের সাতেহ বিয়া দিবা না! হা হা। 
আছিমত কিছ বলে না। আকবর বলে, যদি কোনো নয় ছয় করার চেষ্টা নিছ, তয় তোমার মেয়ারে আমি তুইলা নিয়া যামু। কী? কথা কও না কেনে?
আছিমত মিয়া ঘোরের মধ্যে বলে, না না, আমার কোনো কথা নাই। আপনি যেইটা কইছেন… এইটাই। 

আকাশে মেঘ কালো হয়ে এসেছে। এই হয়ত বৃষ্টি আসবে। মেঘগুলো দেখাচ্ছে ভয়ঙ্কর। দুনিয়াটা কালো অন্ধকার হয়ে আসছে। আজ বড় দূর্যোগের দিন। আকবর ডাকাত চলে যাচ্ছে। আছিমত মিয়া যাচ্ছে পেছনে পেছনে। 

    আছিমত! তোমার ছোট মেয়াটা শুনছি সুন্দরী। এইজন্য ছকুর জইন্য পছন্দ। পরশু দিন সইন্ধ্যার পর বিয়া হইব। হ্যাজাকের ব্যাবস্থা রাইখবা। ছকু কাইল একসময় আসি তোমার মেয়ার জন্য কাপড় চোপড় দিয়া যাবে। বিয়া, নতুন কাপড় চোপড় লাইগব না? হা হা।

ডাকাত দুটো চলে গেছে। তবে আছিমতের বাড়ি ফাঁকা নয়। পুরো পাড়ার মানুষ এসে ভিড় জমিয়েছে তার বাড়িতে। আছিমতের স্ত্রী জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছেন। তার  মাথায় পানি ঢালা হচ্ছে। আছিমত বেঞ্চিতে বসে আছে, তার দৃষ্টি পাথরের মত শক্ত হয়ে আছে। সে কারো কোনো প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে না। আঁধাআঁধি পাক দেয়া দড়িগুলো একদিকে পড়ে আছে। আছিমতের ছোট মেয়ে ফুলোকে জড়িয়ে ধরে আছে তার দাদি। মেয়েটা হালকা হালকা কাঁপছে। 

পাড়ার সব লোককে অবাক করে দিয়ে আছিমত একসময় বসা থেকে উঠল। তার হাঁটার ভঙ্গি আচ্ছন্নের মত। সে কুয়া পাড়ে যাচ্ছে। তার পিছু পিছু যাচ্ছে কয়েকজন। তাদের আশঙ্কা আছিমত কি কুয়ায় ঝাপ দিয়ে আত্মহত্যা করে বসে কি না। 

 

কিছুক্ষণ পরেই দেখা গেল, আছিমত কুয়া পাড়ে বসে ওজু করছে। তার চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে। লোকেরা বলে উঠল, আহারে, আহারে। আল্লাহ রক্ষা করো মওলা। 

আছিমত মিয়া দু’রাকাত নামাজ পড়ল। এরপরে ঘরের চৌকির উপরে কিবলামুখী হয়ে বসল । বাইরের মানুষেরা শুনতে পেল, আছিমত হাউমাউ করে কাঁদছে আর বলছে আল্লাহ, আল্লাহ। আছিমতের কান্না শুনে অনেকেই কেঁদে ফেলল। 

গল্পটা একাত্তরের মক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ের । দেশের আইনশৃঙ্খলা সেভাবে ফিরে আসে নি। যুদ্ধের সময়টাতেই অস্ত্র সংগ্রহ করেছিল আকবর ডাকাত গ্যাং। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই শুরু করেছিল ভয়ানক ডাকাতি। পুরো এলাকায় ছড়িয়ে দেয় ত্রাস। জনশ্রূতি আছে, আকবর ছিল ভয়ানক কালো জাদুকর। সে তার হাতের মাংস কেটে ভেতরে তাবিজ ঢুকিয়ে শেলাই করে দিয়েছে। এজন্য কেউ তাকে ধরতে পারে না। দারোগারা খুব একটা সাহস দেখায় না তাকে ধরার। আকবর ডাকাতের দল খুবই সাংঘাতিক। কোন সময় না আবার দারোগার পরিবারের কোনো ক্ষতি করে দেয়। তাছাড়া থানা এই এলাকা থেকে ১৫ কিলো দূরে। এত দূর থেকে পুলিশ এসে আকবর ডাকাতকে ধরে ফেলবে– এটা সহজ নয়।  

সন্ধ্যা গড়িয়ে এসেছে প্রায়। আছিমত মিয়া চৌকি থেকে নামছে না । কিবলার দিকে মুখ করে বসেই আছে। তার চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। অস্ফুট স্বরে বলছে, আল্লাহ, আল্লাহ। গ্রামের লোকেরা আছিমতকে শান্তনা দেয়ার কোনো ভাষা খুঁজে পাচ্ছে না। কয়েকজন তাকে খাওয়ানোর চেষ্টা করল। কিন্তু আছিমত খাবে না। আছিমতের স্ত্রী বিলাপের মত কেঁদে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে জ্ঞান হারাচ্ছে। ১৩ বছর বয়সী ফুলো মেয়াটার চোখ ভাবলেশহীন। চেহারা রক্তশূন্য। তাকে জোড় করে খাবার খাইয়ে দিচ্ছে এক দুঃসম্পর্কের ফুপু। 


রাত প্রায় বারো’টা। দুইটা নম্পো বাতি জ্বলছে। আছিমত মিয়ার বাড়ির পরিবেশটা কেমন আধিভৌতিক লাগছে। বাইরে তীব্র অন্ধকার। ব্যাঙ ডাকছে। মাঝে মাঝে হালকা বাতাস বয়ে যাচ্ছে। সবাই বলছে, আছিমতের মাথা মনে হয় খারাপ হয়ে গেছে। সে তার চৌকিতে এখনো বসে আছে। উঠার কোনো নাম নেই। সে কোনো দিকে মুখ ফেরাচ্ছে না। অস্ফুট স্বরে বলছে, আল্লাহ, আল্লাহ। তার চোখ দিয়ে পানি পড়ছে কি না, অন্ধকারে বোঝা যাচ্ছে না। হয়ত পড়ছে।

পাড়ার মানুষ এখনো আছিমতের বাড়িতে ভিড় করছে। বিপদের সময় প্রান্তিক গ্রামের এই মানুষগুলো একসাথে জড়ো হয়ে থাকতে পছন্দ করে। তবে কেউই আকবর ডাকাতের বিরুদ্ধে কিছু বলার বা করার সাহস পাচ্ছে না। কোনোভাবে যদি কোনোকথা এই ডাকাতের কানে পৌঁছে, তাহলেই সর্বনাশ হয়ে যাবে। 

কাঠমিস্ত্রী মজিবর মিয়া হঠাত এ বাড়িতে এসে ঢুকল। লোকেরা বলল, কি রে মজিবার! কোনঠে ছিলু? (কোথায় ছিলে?)

মজিবার হাঁফাচ্ছে। সে ঘরের আঙিনায় উঠে এসে বলল, হঠাৎ-পাড়ার রাস্তাত আকবর ডাকাইত ডাকাতি করিছে, মোর (আমার) চোখের সামনত। আজিদের গরুর গাড়ি ভরা ছিল ব্যাবসার মাল। গরু, গাড়ি সব ধরি নিয়া গেইছে। গুলির শব্দ শুনিছু। 

একজন বলল, তুই লুকি (লুকিয়ে) ছিলু কোনঠে? (কোথায়?)
মজিবার বলে, পাকুর গাছটার গোড়াত। 

সবাই হা হুতাশ করতে থাকে। কি দিন শুরু হলো, কি জামানা এল— এই নিয়ে সবাই আলোচনা করছে। মাঝে উঠে আছিমতের খবর নিতে ঘরে ঢুকল কেউ কেউ। আছিমত বসা থেকে এখন শুয়ে আছে। তবে কেবলার দিক থেকে মুখ ফেরায় নি। চোখের পানিতে তার চেহারা ভেজা। বিছানাও খানিকটা ভেজা। সে অস্ফুট স্বরে বলছে, আল্লাহ, আল্লাহ। 

বৃদ্ধ শতীবুল্লাহ জিজ্ঞেস করল, আরে আছিমত, বাউরে (বাবারে) । কি করিবু এলা? এমন করি কতক্ষণ থাকিবু। উঠিবু না? খাবু না?
আছিমত জবাব দেয়, আল্লাহ মোর কথা না শুনিলে মুই উঠিম না। এইঠে মরি যাম। (মরে যাব)। 
বৃদ্ধ শতীবুল্লাহ বলে উঠে, আরে, পাগলা রে!

আজ দিনটা আলোকজ্জ্বল। আকাশে মেঘ নেই। ডাকাত ছকু শেখের মন মেজাজ খুবই ভালো। আগামীকাল তার বিবাহ। কাপড় চোপড় কিনতে হবে। কিন্তু এখন যাওয়া যাচ্ছে না। দবির উদ্দীন মাস্টারের বাড়িতে আজ দুপুরে দাওয়াত। কয়েকদিন আগে সর্দার আকবরের পক্ষ থেকে শূন্য পাতার চিঠি পৌঁছেছে দবির মাস্টারের বাড়িতে। তাতেই কাজ হয়েছে! দবির মাস্টার সবাইকে দাওয়াত করেছে। খাসি, মুরগী, হাঁস সব একসাথে খাওয়া হবে। দবির মাস্টারের দীঘিতে আজদাহা সাইজের মাছ আছে। সেই মাছও রান্না হবে। 

 

দবির মাস্টারের আঙিনায় জনা পনের মানুষ পাটি পেতে বসেছে। তাদের খাবার  দেয়া হচ্ছে। দবির মাস্টার নিজে বেড়ে খাওয়াচ্ছে। বড় বড় কাঁসার প্লেটে খাবার দেয়া হচ্ছে। মাটির হাড়িতে গরুর মাংস, খাসির মাংস। প্লেট ভর্তি করে মাংস দেয়া হচ্ছে ডাকাতদলের প্রতিটা সদস্যের উদ্দেশ্য। ডাকাতদের শাহী ভোজ হচ্ছে আজ। 

 

প্লেটের পর প্লেট মাংস সাবাড় হয়ে যাচ্ছে। একেকটা মানুষ এত মাংস কীভাবে খেতে পারে কে জানে। ডাকাতদের শরীরে অবশ্য বল দরকার। অল্প স্বল্প খেলে হবে? 

নিঃশব্দে খাওয়া চলছে। হঠাত করে সবাই শুনতে পেল– ওহ! মরি গেইনু রে! বিকট চিৎকার।

সবাই ফিরে তাকাল চিৎকারের দিকে । তাজি ডাকাতের পেট দিয়ে বের হয়ে আছে একটা টেউর (মাছ মারার ট্যাঁটা)। পিঠের দিক থেকে কেউ একজন সজোরে আঘাত হেনেছে! 

এরপর অতি দ্রুত কিছু ঘটনা ঘটে গেল।  ভালোমত কিছু বুঝে উঠার আগেই ভোজনরত ডাকাতদলটি জনা ত্রিশেক মানুষের আক্রমণের শিকার হলো।  তাদের হাতে টেউড়, হাশুয়া দা (রামদার মত লম্বা, মাথাটা ভেতরে বাঁকানো), লাঠিশোটা । চোখের সামনেই ৫/৬ জন ডাকাতের রক্তে খাবার প্লেট, চাটাই ভেসে গেল। 

ডাকাতদের পাশেই তাদের বন্দুক। সব পুরাতন আমলের । লোড করা, তাক করা, ফায়ার করা বেশ সময়সাপেক্ষ। এত সময় নেই কারো হাতে। তীব্র হামলার সম্মুখীন হয়ছে তারা। ডাকাতদল বুঝতে পেরেছে, জীবন বাঁচাতে হলে ছুটে পালাতে হবে। এছাড়া উপায় নেই। 

ঐ ডাকাইত, ডাকাইত, ধরো, ধরো, ধরো।   পুরো গ্রামের শোরগোল ছড়িয়ে গেল। ৭/৮ জন মানুষকে তাড়া করছে প্রায় দুই’শর মত মানুষ। সবার হাতেই কোনো না কোনো হাতিয়ার বা লাঠি। আজ ডাকাতদের রক্ষা নেই। আধা ঘন্টার মধ্যে প্রায় সবাই গনপিটুনিতে নিহত হল। ছকু শেখ দৌঁড়ানোর পথ না পেয়ে একটা কুয়ায় লাফিয়ে পড়েছে। তাকে কুয়ার উপর থেকে জনা পঞ্চাশেক মানুষ বাঁশ দিয়ে খোঁচাচ্ছে। মানুষগুলোর মধ্যে তীব্র আক্রোশ। দুর্ধর্ষ ডাকাত, খুনি ও ধর্ষক ছকু শেখ প্রান বাঁচানোর জন্য আঁকুতি করার চেষ্টা করছে। লম্বা লম্বা বাঁশের তীব্র খোঁচা খেয়ে তার শরীরের অনেক জায়গা এফোঁর ওফোর হয়ে গেছে। সে বাঁচবে বলে মনে হয় না। গ্রামবাসী মানুষগুলোর ইচ্ছে নেই ছকু ডাকাত বেঁচে থাকুক। 

শত শত মানুষের ঘেঁড়াও ভেদ করে কীভাবে যেন আকবর ডাকাত বের হয়ে গেছে। শুধু তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। লোকটা বোঁধয় সত্যিই জাদুকর, ভাবছে অনেকে। লোকে বলে– বিপদে পড়লে সে মাছির আকৃতি নিয়ে উড়ে যেতে পারে। গ্রামে কত অদ্ভুত কথাই না প্রচলিত থাকে, এসব কিছুর কি কোনো বাস্তবতা থাকে ?

মজিবার মিস্ত্রী ছুটছে আছিমত মিয়ার বাড়িতে। সে রীতিমত দৌঁড়াচ্ছে। আছিমত মিয়ার মরো মরো অবস্থা। সে খাদ্য পানি খিছুই গ্রহণ করছে না। কেবলামুখী হয়ে এখনো শুয়ে আছে। তার চোখ মুখ রক্তশূন্য হয়ে গেছে। 
  আছিমত দা! আছিমত দা!
একজন চেঁচিয়ে বলল, কী হইছে রে?

মজিবার হাঁফাতে হাঁফাতে বলে, আকবার ডাকাইতের দলের সোবাকে (সবাইকে) মারি ফেলাইছে। সর্দারপাড়ার দবির মাস্টারের বাড়িত দাওয়াত দিয়া, ডাকেয়া (ডেকে) টেউর দিয়া হানি (হেনে) মারিছে। 

মজিবার মিস্ত্রীর কথা শুনে সবাই হা, হা করে উঠল। তারা নিজেদের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না। ইতিমধ্যে আরও ৩/৪ জন লোক দৌঁড়ে এলো এই বাড়িতে। সবাই একই কথা বলছে, আকবর ডাকাতের দলের সবাই নিহত হয়েছে। 

আছিমত মিয়া সব কিছু শুনল। হঠাত সে জোড়ে– আল্লাহ বলে চিৎকার করে উঠল। এরপর জ্ঞান হারিয়ে ফেলল। বাড়ির লোকেরা তার কাছে ব্যাস্ত হয়ে দৌঁড়ে গেল। বৃদ্ধ শতীবুল্লাহ বলল, ডাক্তার ডাকি আন। স্যালাইন দিবার লাগবে। গতকাইল থাকি দানাপানি কিছুই মুখে দেয় নাই আছিমত।

কয়েকমাস পরের কথা। হাজার খানেক মানুষ মিলে একটি নিথর শরীরকে নদীতে চুবাচ্ছে। ঘন্টা খানেক পেরিয়ে গেছে । কিন্তু গ্রামবাসীর ক্ষোভ যেন কমছেই না নিথর দেহটার উপর। কারণ সেটা আকবর ডাকাতে মৃতদেহ। থানায় দুই দিন ভরা মারের পর পুলিশরা যখন বুঝতে পেরেছে আকবার ডাকাত মৃত, তখন ঝামেলা এড়াতে তার মৃত দেহটাই ছেড়ে দিয়েছে বিক্ষুব্ধ জনতার হাতে । থানা থেকে রিপোর্ট করা হবে– দুর্ধর্ষ খুনি ও ডাকাত আকবর জনতার গনপিটুনির স্বীকার হয়েছে। গনপিটুনির পর ঘন্টার পর ঘন্টা তাকে নদীর পানিতে চুবানো হয়। পরে নদী থেকে পুলিশ তার লাশ উদ্ধার করে।  

Comments

    Please login to post comment. Login