আজাদ আলি ও রেহানা বেগম। দুই সন্তানের মা।তাদের এক ছেলে ছোটবেলায় পানিতে ডুবে মারা গিয়েছিল। সেই শোকে আজও তারা শোকাহত। পুকুরে ভেসে থাকা সেই লাশের স্মৃতি এখনো তাদের হৃদয় গাথা রয়েছে।
বর্তমানে তাদের একমাত্র মেয়ে কায়লা। কয়লার প্রতি তার বাবা ও মা খুবই যত্নশীল। সেই ছেলে হারানোর অভিজ্ঞতা থেকেই কয়লার প্রতি তারা এতটা carefull.
অন্যদিকে বেলাল সাহেবের একমাত্র ছেলে আলভি। জন্মের পরেই তার মামারা গিয়েছেন। মা বলে আজও ডাকতে পারেনি সে। শেষ সম্বল বাবা।
কায়লা এক নতুন স্কুলের ক্লাস নাইনে সবেমাত্র ভর্তি হয়েছে। যেখানে আগে থেকেই লেখাপড়া চলছিল আলভীর কায়লা।কায়লা আজ প্রথমবার ক্লাসে এসেছে।তার নতুন বন্ধু মিলি।
দুই বান্ধবী রাস্তার উদ্দেশ্যে হেঁটে চলেছে। পথিমধ্যে তাদের পথ আটকে ফুল হাতে হাঁটু গেরে বসেছে আলভী।হাতে ফুল ও মুখে বলছে
I love you please accept me.
কাইলা কিছুটা দ্বিধায় পড়ে গেছে চিন্তা করে থমকে যায়। যে মা বাবা তার প্রতি এত যত্নশীল কিভাবে তাদের হেয় করবে। কায়লা আলভীকে sorry বলে তার পাশ কাটিয়ে চলে যায়।
রাত বাজে ১০টা। আজাদ ও রেহানা ঘুমিয়ে গেছেন। কায়লার চোখে ঘুম নেই। আজকের এই ঘটনার কথা সে ভেবেই চলেছে। ছেলেটি কে, কেমন, কি করে ইত্যাদি কথা তার মাথায় ঘুরছিল।
পরদিন স্কুলে যাওয়ায় আবার ওই একই ঘটনা। আলভির এই আকুল আবেদন দেখে এইবার কায়লা তার proposal গ্রহণ করে।
দুজনের মধ্যে সম্পর্ক ধীরে ধীরে গভীর হতে থাকে। তাদের জীবন সুন্দরই ছিল। আমরা দেখতে পাই তিন বছর পরের কায়লাকে যে কিনা এ বছর ssc পরীক্ষা দিয়েছে।
একদা আলভী ও কায়লার মাঝে তুমুল ঝগড়া ও তর্ক বিতর্কের সৃষ্টি হয়। যার মূল কারণ আলভীর behaviour. সে এই তিন বছরে শুধুমাত্র কায়লাই নয় বরং আরো চারটি মেয়ের সাথে চিট করেছে। যা একেবারেই অবিশ্বাস্য। যার ফলে দুজনের সম্পর্কে ফাটল ধরে। এতে কায়লাও মানসিকভাবে আহত হয়।সে একেবারেই ভেঙে পড়েছিল। দেখা যায়- mentality র সমস্যা দেখা দিয়েছে কায়লার।
এদারা বুঝা যায় একটা মানুষের মন কতটা নরম হতে পারে। যা কিনা একবার ভাঙলে আর জোড়া লাগানো সম্ভব নয়।
এই ঘটনা কয়লার মস্তিষ্কেও আঘাত হানে। সেইসাথে বদলে দেয় কায়লার জীবন। এতে শুধুমাত্র কায়লাই নয় তার মা-বাবাও গভীরভাবে শোকাহত। এক সন্তানকে হারিয়ে আরেক সন্তানকেও যেন হারাতে বসেছেন তারা।
অন্যদিকে দেখা যায় কায়লার অস্বাভাবিক আচরণ। hospitale - এ বসে একটা খাতায় কিছু লিখতে লিখতে হঠাৎ অতীতের স্মৃতি মনে পড়ায় থমকে যায় কায়লা। মৃত্যু মৃত্যু বলে চিৎকার করতে শুরু করে। যা শুনে বাইরে থেকে দৌড়ে আসে রাফেজ হোসেন। উচ্চ পদের ডাক্তারের এক সরকারি। কায়লাকে বুকে জড়িয়ে ধরে শান্তনা দিচ্ছেন। বারবার বলছেন তোমার অতীতকে মুছে ফেলো। ভুলে যাও পেছনের অন্ধকার।
ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে গেল কায়লা। রাফেজকে জড়িয়ে ধরে অঝোরে চোখের পানি ফেলে কায়লা।
যার কষ্ট কিছুটা রাফেজও কিছুটা অনুভব করছিল।
রাফেজের মা ছাড়া এ দুনিয়ায় আপন বলতে কেউ নেই। আজ কয়লার মা-বাবার আসার কথা ছিল।তন্মধ্যে কায়লার বাড়ি থেকে খবর আসে কায়লার বাবা-মা পথিমধ্যে road accident - এ মারা গিয়েছে। এ যেন কালার জীবনের আরও বড় এক ধাক্কা। কায়লা এ কথা সহ্য করতে পারবে না বলে রাফেজ তাকে জানায়নি এই খবর।
কায়লার দেখাশোনার জন্য রাফেজ তাকে তার সঙ্গে বাসায় নিয়ে যায়।যা দেখে তার মা আনন্দে প্রফুল্লিত। কায়লার ঘুমানো, ওষুধ খাওয়া, খাবার খাওয়া সব নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি নিত্যদিনই তাকে নিয়ে নির্জন স্থানে ঘুরতে যাওয়া যেন রাফেজের daily রুটিন।
কায়লা যেন তার জীবনের এক নতুন অধ্যায় শুরু করতে চলেছিল।
কায়লার মন থেকে তার মা-বাবা ও সেই ঘৃণিত অতীত সব মুছে গিয়েছিল।
কিছু দিনেই সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে ওঠে কায়লা।
অসুস্থ অবস্থায় রাফেজের মা কায়লাকে আদর করে ডাকতেন তিসা।
যার ফলে কায়লা তার পূর্ব নামও ভুলে গিয়েছিল।
কিছু বছর পর দেখা যায় রাফেজ ও তিসা এক সুখি দম্পতি।তাদের এক মেয়েও রয়েছে। তার নাম নিসা।
আজ হঠাৎ করেই নিসা তার মার কাছে তার নানার নাম অর্থাৎ তিসার বাবার নাম জিজ্ঞেস করামাত্রই তিসার চোখের সামনে তার অতীতের স্মৃতি বিজড়িত কিছু দৃশ্য ভেসে ওঠে।
আমরা বুঝতে পারি তার এনজাইটি এ্যাটাক এসেছে।
তিসার অবস্থা বুঝে ওঠার আগেই রাফেজের কোলে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে তিসা ওরফে কায়লা।
তিলে তিলে শেষ হয় তার জীবন ও কাহিনী। অন্যদিকে নিসার ছিল শ্বাসকষ্টের সমস্যা তখন তারও শ্বাসকষ্ট বাড়তে থাকে যার ফলে এক পাশে সেও মৃত অবস্থায় পড়ে থাকে।
কিছুদিন আগে রাফেজের মাও মারা গিয়েছিলেন।
বর্তমানে রাফেজ সর্বস্বান্ত হয়ে তার কোলের ওপর স্ত্রী ও সন্তানকে নিয়ে বসে আছে।
আবার দেখা যায় কিছু বছর পরের দৃশ্য।
রাফেজও তার অতীতকে ভুলে গিয়ে নতুন করে তার জীবন শুরু করেছে।
সে আবার বিয়ে করেছে এবং তার আরেকটি মেয়ে হয়েছে। তার স্ত্রীর নাম রিনা।
ও মেয়ের নাম দাসিয়া।
১৪ বছরের এক তরুণী দাসিয়া। কষ্ট যেন তার জীবন সঙ্গী। মুখে হাসি যেন বাসি হয়ে গেছে। কষ্ট আর দুঃখ যেন বিধাতার কাছ থেকে চেয়ে এনেছিল সে। দাসিয়া ও তার মারিনি তাদের মাঝে সম্পর্ক এমন যেমন হয় এক সৎ মা ও মেয়ের মধ্যে। দাসিয়া তার মায়ের চোখের বালি। দু চার বেলা না খেয়ে থাকা বাড়ি থেকে পালানো এমনকি আত্মহত্যার মতো প্রাণহানির চেষ্টা করেছিল সে। আপনজনদের চক্ষুষল হিসেবে দিন কাটিয়েছে দাসিয়া।
তা তো পালানো থেকে আমরা বুঝতে পারি, যে তার মধ্যে কি পরিমান মানবিক অস্বস্তি কাজ করে।
কাজের চাপে তার বাবা রাফেজ হোসেনও তাকে সময় দিতে পারত না।
সে নিজেকে অবহেলিত মনে করত। সে তার জীবনে একদিন প্রাণ খোলা হাসি এসেছে এমন অভিজ্ঞতা বোধহয় তার নেই। দাসিয়া ছিল খুব নম্র ভদ্র স্বভাবের। যার আচরণ বিস্ময়কর।
মায়ের প্রতি চরম ক্ষোভ ও ঘৃণা জন্মেছিল তার মনে। যা থেকে সে তার প্রাণহানির চেষ্টাও করেছিল। সে তার মায়ের ঘৃণিত আচরণের কথা মনে করলে দু এক সময় অস্বাভাবিক আচরণ করতো,বলতো সকলেই তার সাথে ব্রেকআপ করেছে কেউ তার সাথে কথা বলবে না। এ থেকে বোঝা যায় দাসিয়ার মায়ের প্রভাব তার মস্তিষ্ককেও প্রতিফলিত করেছে।
একদা তার মায়ের সাথে তুমুল ঝগড়া হওয়ায় দাসিয়া নিজের উপর থেকে বিশ্বাস হারিয়ে ফেলে। অস্বাভাবিক আচরণ শুরু করে এবং সেই সঙ্গে বলে তার মায়ের জীবন থেকে সে কাটা উপড়ে ফেলবে। দাসিয়া এ উক্তি দ্বারা নিজেকেই কাটা বোঝাতে চেয়েছে। পরদিন সকালে দাসিয়াকে দেখা যায় এক ফার্মেসিতে যেখানে সে উকুন মারার জন্য ওষুধ ক্রয় করতে গিয়েছিল।
বিদ্যালয়ে যাওয়ার সময় সে ওই ওষুধ বের করে সম্পূর্ণ সেবন করে। সঙ্গে সঙ্গে তার কাশি ও বমি ভাব হচ্ছিল। দাসিয়া মনে করে সে হয়তো বা আজ মুক্তি পাবে তার মায়ের কাছ থেকে, সবার কাছ থেকে। দাসিয়া ক্লাসে মনোযোগ দিতে পারছিল না। অবাক করা বিষয় সে প্রায় দু থেকে তিন ঘন্টার মধ্যে সুস্থ হয়ে গিয়েছিল। দাসিয়া মনে মনে বলে আগে তো শুধু তার মার তার সাথে ব্রেকআপ করেছিলো কিন্তু এখন বোধহয় ওই ওষুধ ও তার সাথে ব্রেকআপ করেছে। ওই কথা ভাবতে ভাবতেই ক্লাসে লুটিয়ে পড়ে দাসিয়া। অজ্ঞাত অবস্থাতেই তাকে বাড়ি আনা হয়। বাড়িতে এনে তাকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে দাসিয়ার মা তার ঘরে চলে যায়। সুস্থ হতে দেখা যায় তার মায়ের কিছু কথা সে আবারো মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে।
রাত বাজে দশটা। দেখা যায় দাসিয়ার বাবা দাসিয়ার রুমে বসে অঝোরে চোখের পানি ফেলছেন। কান্নার মূল উদ্দেশ্য দাসিয়া। পাশে দাঁড়িয়ে সব ঘুরে ঘুরে দেখছিলেন দাসিয়ার মা। তার মনে ভাবে লেশমাত্র নেই।
দেখা যায় ঘরের দরজা ভাঙ্গা ফ্যানের সাথে একটি দড়ি, তার সাথে ঝুলছিল দাসিয়া। হাত মুঠ করা। মুঠো খোলার চেষ্টা করলেন দাসিয়ার বাবা। মুঠোতে ছিল একটি কাগজ যাতে সুন্দর সাবলীল ভাষায় বাবার উদ্দেশ্যে লেখা কিছু কথা।
বাবা পড়তে আরম্ভ করলেন :
বাবা,
আমি জানি এই মুহূর্তে চিঠিটি তোমার হাতে এবং তুমিই চিঠিটি পড়ছো। আমার এই মৃত্যুর কারণ আমি নিজে।
অন্য কাউকে আমি এর জন্য দায়ী করতে চাই না। যদি সম্ভব হয় এ লাশটুকু নিয়ে মাটিতে এক অন্ধকার কবরে রেখে এসো। ও বিশেষ সতর্কতা “ এ লাশ ও এর কবরকে যেন মিসেস রিনা বেগমের হাত স্পর্শ না করে”।
ইতি,
তোমার আদরের,
মৃত দাসিয়া।