বাসর ভেঙে, পর্ব ২
হুমায়ূন কবীর
হাবিব বসে নেই। সে সরকারি, বেসরকারি অনেক জায়গায় চাকরির দরখস্ত করে রেখেছে। কোনোকোনো জায়গায় ভালো পরীক্ষা হয়েছে। অবশ্য সরকারি চাকরির আশা ও করে না। তার জন্য লোকজন আর অনেক টাকা দরকার। সেসব তো ওর নেই। তাই সরকারি চাকরির আশা ও করে না। তবু দরখস্ত করে। যেকোনো একটা চাকরি হলেই সে লিলির বাপের মুখের দিকে তাকিয় নিজের ভালবাসা বিসর্জন দেবে না। তার অমতে নিজেরা বিয়ে করবে।
লিলি বলেছে, এতো চেষ্টা করেও যখন তোমার বাপকে আনতে পারলাম না চলো বাপ-বাপ বাদ থাক। নিজেরা বিয়ে করে ফেলি।
হাবিব বলেছে,একটু সময় দাও। আমার যেকোনো একটা চাকরি হবেই।
কয়েক মাসের ভিতর হাবিবের অনার্স ফাইনাল পরীক্ষা হয়ে গেলো। লিলির ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষাও শেষ।
রেজাল্ট দিলে দেখা গেলো হাবিব প্রথম শ্রেণী আর লিলি ফেল।
এই ফেল শেষ পর্যন্ত এক চরম পরিণতি ডেকে আনলো।
লিলির বাপ আগেই ছেলে দেখে রেখেছিলো। ছেলে প্রাইমারির টিচার। রেজাল্টের বিশ দিনের ভিতর বিয়ের আয়োজন কম্পিলিট।
শেষে উপায় অন্ত না পেয়ে লিলি আর হাবিব পালিয়ে গেলো। কিন্তু তাতে কোনো লাভ হলো না। লিলির বাপ লোক লাগিয়ে টাকা খরচ করে জানতে পারলো তারা হাবিবদের বাড়িতেই আছে ।সেখানেই বিয়ের আয়োজন চলছে। লিলির বাপ হাবিবের বাপকে জানালো।
সিদ্দিক মোল্লা প্রায় দুইবছর বাড়ি যায় না।বউ,ছেলে-মেয়ের কোনো খোজ নেয় না। এইবার সে মহৎ কাজ করার জন্য বাড়ি এলো। লিলির বাপের পক্ষ নিলো। ছগির মুন্সির সাথে অনেক সাঙ্গপাঙ্গ ছিলো। তাদের লাগলো না। ছগির মুন্সি একাই একশ।
হাবিব আর লিলি ঘরের ভিতর একে অপরকে কঠিন ভাবে জড়িয়ে ধরে দাড়িয়ে ছিলো।হাবিবের পরনে ছিলো শেরওয়ানি, বিয়ের টোপর। লিলি পরেছিলো লাল বেনারশি। বিয়ের সমস্ত আনুষ্ঠানিকতা শেষে তারা এখন আইনিভাবে,ধর্মীয়ভাবে স্বামী -স্ত্রী। বিয়ের ফিলাপ করা ফর্মটা লিলি মুঠির ভিতর শক্ত করে ধরে রেখেছে। ঘরের ভিতর যখন অনেক লোক ঢুকে পড়লো তখনো তারা একটুও ভয় পেলো না, লজ্জা পেলো না। সবাই সেই পবিত্র দৃশ্য দেখে পিছিয়ে এলো। সবার মন গলে গেলো।এমনকি ছগির মুন্সীর ভাড়াকরা অস্ত্রধারী মাস্তানরা পর্যন্ত থমকে গেলো এদের পবিত্র ভালোবাসর অটুট বন্ধন দেখে। তাদের মনও গলে গেলো। গললো না শুধু ছগির মুন্সি আর সিদ্দিক মোল্লার মন। তাদের শরীরে আজ অসুর শক্তি ভর করেছে। ওরা দুইজন মেরে, টেনে হিচড়ে যুগলবন্দী বিছিন্ন করে ফেললো।
মারতে-মারতে,টানতে-টানতে লিলিকে গাড়ির দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। লিলি গগনবিদারী চিৎকার করে কাঁদছে। হাবিবকে ঘরের ভিতর রেখে ছিদ্দিক মোল্লা বাইরের থেকে তালা দিয়ে দিয়েছে।
অনেক রাতে হাবিব ঘর থেকে বের হতে পারলো। উঠানে দেখলো কিছু ছেড়া কাগজ পড়ে আছে। কুড়িয়ে নিয়ে

দেখলো সেগুলো আসলে ওদের বিয়ের ফিলাপ করা ফর্ম। এতো টুকরো করা হয়েছে যে, ওগুলো আর জোড়া দেওয়া সম্ভব না। সেগুলো বুকে জড়িয়ে ধরে হাবি উঠানের মাঝে বসে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো।
হাবিবের কান্না দেখে ওর বোন দুটো এসে, পাশে বসে কাঁদতে লাগলো। শেষে ওর মা-ও এসে কাঁদতে লাগলো।
কান্না থামিয়ে হাবিব উঠে গোয়ালঘরে গেলো। একটা গরুর দড়ি নিয়ে বাড়ির পিছনে আমগাছের দিকে ছুটে গেলো। এই ফজলি আমগাছটাতে একদিন লিলি গলায়দড়ি দিয়ে মরতে চেয়েছিলো। আজ ও নিজে মরবে।
হাবিব আমগাছে উঠতে যাবে ছোট বোন দুটো এসে পা জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো। মা এসে কাঁদতে কাঁদতে বললো, তুই একা মরবি কেন? আয় আমরা সবাই এক দড়িতে মরি। ওরা চারজন ফজলি আমগাছটার তলায় দাড়িয়ে গলা জড়াজড়ি করে কাঁদতে লাগলো
ওদের সেই কান্না দেখে গাছটাও যেনো কেঁদে উঠলো। কয়েক ফোটা পানি টপটপ করে ঝরে পড়লো।