ক্যাম্পাস- প্রেম
হুমায়ূন কবীর
মোবাঃ ০১৭৫০৯১৬৯৮৬
তুমি চলে গোছো। এখনো সমস্ত ঘরে তোমার শরীরের ঘ্রাণ ছড়িয়ে আছে। আমি জল পদ্মের ঘ্রাণ পাচ্ছি, তোমার শরীরের ঘ্রাণ। মনে হচ্ছে এইতো তুমি, আমার পাশে মাথার কাছে দাঁড়িয়ে আছ। ঘাড় ঘোরালেই দেখতে পাব। আশায় বুক বেধে বার বার ঘাড় ঘোরাচ্ছি আর বার বার বিফল হচ্ছি। তুমি নেই তুমি চলে গেছো। টেবিলের উপর ফুল গুলি পড়ে আছে।
আজ আমার সেই সমস্ত দিনগুলির কথা বার বার মনে পড়ে যাচ্ছে। আর কষ্টের নুনা জলে চোখে ভিজে যাচ্ছে। এই তো সেদিনের কথা। হাত বাড়ালেই ছুয়ে দেখা যায়। অথচ দেখতে দেখতে কতগুলো বছর কেটে গেছে। তুমি আজ ঢাকা ভারসিটির 'ল' ডিপার্টমেন্টের স্টুডেন্ট। তোমার সামনে উজ্জ্বল তারকা খচিত দিন। আর আমার চারপাশ অন্ধকার, শুধু অন্ধকার। কেন তুমি আমাকে এভাবে কাঁদালে?
আমার সামনে এখন এম, এম কলেজের সেই সুখ স্মৃতিময় দিনগুলি। সেই সুখ স্মৃতি যেন এসিড। প্রচন্ড তৃষ্ণা নিয়ে যত পান করছি ততো জ্বলছি। দেহমন জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে। তবু সেই দিন গুলিই এখন আমার একমাত্র সম্বল। কেন তুমি আমার জীবনে এসেছিলে রাশমিন?
এই তো সেদিন তোমাকে একনজর দেখার জন্য সারারাত আল্লাহকে ডাকতাম। কখন সকাল হবে। এম, এম কলেজের ক্যাম্পাস সরব হবে। তুমি ক্লাস করতে আসবে। তোমাকে এক নজর দেখতে পাব। আর কিছু নয় শুধু চোখ দু'টি। যে চোখ কোন কথা না বলেও হাজারও কথা বলে প্রতিনিয়ত। শুনেছি টাইম মেশিন নামে কি বস্তু বিজ্ঞানিদের মাথায় আছে। টাইম মেশিনে চড়ে নাকি ইচ্ছে মাফিক অতীত বা ভবিষ্যতে চলে যাওয়া যায়। যদি একটা সত্যিকারে টাইম মেশিন পেতাম তবে তাতে চড়ে ফিরে যেতাম কয়েক বছর অতীতে। এম, এম কলেজের ক্যাম্পাসে যেখানে, তোমার আমার প্রথম দেখা, প্রথম পরিচয় প্রেম এবং অতঃপর-
মনে আছে তোমার সেই প্রথম পরিচয়ের দিনটির কথা? মনে পড়লে শত দুঃখের ভিতর হেসে উঠি। তোমাকে তুই বলে সম্বোধ করেছিলাম। তুমি সাথে সাথে প্রতিবাদ করে বলেছিলে, "দেখেন, তুই বলা আমি পছন্দ করি না। এটা কোন ধরনের ভদ্রতা?" আমি বিস্মিত হয়েছিলাম। কারণ, আমি একজন ছাত্র নেতা, আর রজনীতিতে সিনিয়াররা জুনিয়রদের তুই বলে সম্মোধন করে। এবং এভাবেই পরস্পরের কাছে আসে। সম্পর্ক আরো গাঢ় হয়। কিন্তু রাজনৈতিক কালচার আর কলেজ কালচার এক নাও হতে পারে। এক না হলেও কেউ প্রতিবাদ করে না। রাশমিন করেছিল কারণ তার সাহসের অভাব ছিল না। আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি ছিল না।
মনে পড়ছে। সকাল নয়টা কি দশটা হবে। সকালের নাস্তা সেরে দ্বিতীয় রাউন্ডের ঘুম ঘুমাচ্ছিলাম। এম, এম কলেজের শহীদ আসাদ হল তখন প্রায় একরকম ফাঁকা। আমার ৩০১ নম্বর রুমে শুধু মাত্র আমি একা আছি। আর সবাই ক্যাম্পাসে, কেননা -এখন ভর্তি পরীক্ষার মৌসুম চলছে। কত জায়গা থেকে কত রকম ছেলেমেয়ে আসতে শুরু করেছে। কত রকম পোশাক আশাক তাদের। কত রকম স্টাইল। ছাত্র-ছাত্রী অভিভাবকে ক্যাম্পাস এখন জম-জমাট। সূচ ফেলার জায়গা পর্যন্ত নেই। যেন ক্যাম্পাসে মেলা বসেছে। উৎসব উৎসব পরিবেশ। ভর্তি পরীক্ষার জন্য যারা ফর্ম তুলতে আসছে, সেই সমস্ত তরুন-তরুনীদের দৃষ্টি আকর্ষন বা শোডাউনের জন্য প্রতিটা রাজনৈতিক দল বা সাংস্কৃতিক সংগঠন বিভিন্ন রকম আনুষ্ঠানিকতার আয়োজন করেছে। আমার দল ও পিছিয়ে নেই। আমি অন্যান্য বার সক্রিয় অংশগ্রহণ করি কিন্তু এবার ভাল লাগছে না। আমরা যে সমস্ত ছেলে-মেয়েদের ফর্ম তোলা থেকে শুরু করে ফর্ম জমা দেয়া পর্যন্ত প্রতিটা স্টেপে যেভাবে হেল্প করি, অথচ দু'দিন পর সেই সমস্ত ছেলে-মেয়ে ক্যাম্পাসে ভর্তি হয়ে সামান্য কৃতজ্ঞতা পর্যন্ত প্রকাশ করে না। এগুলো গায়ে সয়ে গেছে, কিন্তু মাধুরীর কথা মনে পড়লে ঘৃনায় মনটা কুকড়ে আসে, ইচ্ছে হয় না কাউকে হেল্প করি। তারপরও যাই, তারপরও হেল্প করি।
কিন্তু আজ মনটা আমার একদম ভাল নেই, সকাল বেলা পুকুরে গোসল করতে গিয়ে দেখি - পুকুর পাড়ে গাছের শিকড়ের উপর মাধুরি বসে আছে একটি ছেলের কাধে মাথা রেখে। মেজাজটাই খারাপ হয়ে গেছে। গোসল না করে পুকুর থেকে উঠে এসে হলের বাথরুমে গোসল করেছি, সেই থেকে মনটা খারাপঃ বারবার ঘুমাবার চেষ্টা করেছি কিন্তু ঘুম আসছে না, শেষে ঘুমের বড়ি খেয়ে ঘুমাচ্ছি।
# # # #
তুষার, এই তুষার, ষাড়ের মত চিল্লাতে চিলাতে দরজা টরজা হুড়মুড় করে ঠেলে তৌফিক রুমে প্রবেশ করলো যেন বাইরে সিডর শুরু হয়েছে আর ও দৌড়ে পালিয়ে এসে আমাকে সর্তক হতে বলেছে। এটা ওর স্বভাব।
তাকিয়ে দেখি তার হাতে পানির গ্লাস, মুখে রাজ্য বিজয়ের হাসি।
তৌফিক রুমে ঢুকে তার চির-পরিচিত ক্যাবলা ক্যালাস মার্কা হাসি দিয়ে বলল, কিরে শালার পাগল, বাংলার বাউল, এখন সকাল দশটার সময় শুয়ে আছিস কেন? আমি রেগে বললাম- ঘুমাচ্ছি, ডিস্টার্ব করিস না, যেখানে যাচ্ছিস সেখানে যা।
, যেন আমার রুমে কেউ আসেনি এমনি অবহেলায় পাশ ফিরে কাত হয়ে শুলাম। হঠাৎ কানের ভিতর তরল কিছু গড়িয়ে পড়ল যেন পৃথিবীটা তরল হয়ে কানের ভিতর ঢুকে গেছে। আমি লাফ দিয়ে বিছানা ছেড়ে ফ্লোরের উপর পড়লাম। তৌফিক অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে দৌড়ে রুমের এক কোণায় আশ্রায় নিল।
"হারামজাদা কানে পানি দিলি কেন রে?' রাগে চিৎকার করে উঠলাম তৌফিক ঘরে দরজায় লাগানো হুক এক হাতে ধরে হাসতে হাসতে বলল,শালা গালাগালি করিস না, পিটিয়ে আলু ভর্তা বানাবো কিন্তু। "
কি আর করা নিরস্ত্র হতে হল, হারামজাদার কথা বলা যায় না -হুকটা মাথায় বসিয়ে দিতে পারে। শালার যে গাট্টাগোট্টাশরীর। বললাম, দে পানির গ্লাস দে।"
তৌফিক পানির গ্লাস এগিয়ে দিতে দিতে বলল, "নে এবার ভাল করে ঘুমা।"
ঘুমানো তো দূরের কথা কানের পানি বের করার জন্য আরো পানি দিয়ে নাচানাচি করে তবে কানের পানি বের করতে হল। নাচানাচি করে ক্লান্ত হয়ে বেডে বসে সিগারেট ধরালাম। "নে সিগারেট খাবি?"
"না"
তৌফিক সিগারেট খায় না, তবুও যখনই আমি সিগারেট ধরাই তখনই ওকে অফার করি। ও যথারিতি প্রত্যাখ্যান করে। ধুমপানের সময় পাশে কেউ থাকলে অফার করা ভদ্রতা। এটা আমাদের কালচারের অংশ। তৌফিক ধুমপান করে না, প্রত্যাখ্যান করে।
তৌফিক আমার বাল্যবন্ধু। হাইস্কুল লাইফ থেকে দু'জন একসাথে এক স্কুলে লেখা পড়া করেছি। মাঝখানে দু'জন দুই কলেজে পড়লেও এখন একই কলেজে পড়ি। আমাদের সাবজেক্ট আলাদা। ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানে, আমি বাংলাতে।
তৌফিকের সিগারেট না খাওয়ার পিছনে একটা ইতিহাস আছে। ওদের পরিবার এলাকার খুব প্রভাবশালী এবং পলিটিকস-এর সাথে সক্রিয় ভাবে জড়িত। ওর বাপ-চাচারা একেক জন একেক দল করে। যে দলই ক্ষমতায় থাকুক না কেন, ওদের প্রভাব থাকে। যাকে বলে ব্যালান্স রাজনীতি। রাজনীতির কারনে তৌফিকের বাপ-চাচাদের এলাকার জনগনের সাথে ব্যপক ভাবে মিশতে হয়। আর জনগনের সাথে মেশার প্রথম স্টেজই যেন সিগারেট। এটাও আমাদের কালচারেরই একটা অংশ। ফলে তৌফিকের বাপ চাচারা সবাই ধুমপান করে। তৌফিক করে না। ওর মেঝ চাচা লিমনের করুন পরিনতি দেখে তৌফিক ভুলেও ধুমপান সামগ্রী ছুয়েও দেখে না। ওর মেঝ চাচা এক সময় এলাকার হিরো ছিলো। সে এক সময় বিড়ি- সিগারেট খেত। পরে হেরোইন খেতো।
বর্তমান হেরোইন সেবন করে করে রাস্তার পাগলে পরিণত হয়েছে। চাচার এই করুন পরিনতি দেখে তৌফিক বিড়ি-সিগারেটের নাম মুখেও নিতে চায়না, কিন্তু আমি ছাড়তে পারি না। সিগারেট আমার নিত্য সঙ্গী। এ না হলে আমি চলতে পারিনা। আর তাছাড়া, একা থাকার সময় যখন টেনশন হয়, তখন দারুন বন্ধুর কাজ করে। এই ভালোবন্ধুকে বিকল্প না পেয়ে কি ভাবে ত্যাগ করি?ক্লাস থ্রি থেকে ধুমপানের অভ্যেস ভিতরে ঢুকে গেছে। তবে আজো সিগারেটের ভিতর সীমাবদ্ধ আছে। অন্য কোন নেশাদ্রব্য ছুয়েও দেখিনি, দেখার ইচ্ছেও নেই।
আজ তৌফিক পরেছে ব্লু কালার-এর প্যান্ট এবং হোয়াইট কালারের শার্ট। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে এসেও তৌফিক ওর স্কুল কলেজের পোশাকি স্টাইল ত্যাগ করতে পারেনি। কলেজ লাইফে ক্যানটনমেন্ট কলেজে পড়েছে তো। মগজটা রীতিমত ধোলায় হয়ে গেছে। দীর্ঘদিনের পোষা পাখির মত অবস্থা। খাচার দুয়ার খুলে দিলেও আর যুক্ত আকাশে ফিরতে চায়না। খাচাটাই তাকে স্বাদীনতার সুখ দেয়।
আমি পরেছি জিন্সের প্যান্ট, চামড়ার চটি, কলার ওয়ালা ক্রীম কালারের গেনজি। এই ধরণের পোশাক পরতে আমার ভালো লাগে। বিশেষ করে হাফ হাতা গেনজি, জিন্সের প্যান্ট আর পাতলা চটি পায়ে থাকলে মনে হয় উড়ছি। খুব হালকা হালকা লাগে।
দু'জন হাটতে হাটতে ক্যামপাসের ভিড়ের স্রোত ঠেলতে ঠেলতে অবশেষে তিন তলায় আমার বাংলা ডিপাটমেন্টে পৌঁছে গেলাম। ১১৫ নম্বর রুমে অনেক ছেলে-মেয়ে বসে বসে ফর্ম ফিলাপ করছে।
# # # #
"আরে আঙ্কেল?"
কে আমাকে আঙ্কেল বলে ডাকে? তাকিয়ে দেখি আমার এক দূর সম্পর্কের আত্মীয় সে আমার সম্পকে চাচা হয়। সে প্রায় আমার সমবয়সী। সে আমাকে আঙ্কেল ডাকে, আমিও তাকে আঙ্কেল ডাকি। আঙ্কেলটি তার বোনের ফর্ম ফিলাপ করছে। মেয়েটি আমাকে দেখেই হেসে কুশল বিনীময় করল। আঙ্কেলটি আমার হাত ধরে টেনে তার বোনের পাশে বসিয়ে দিল।
"আঙ্কেল, আপনি এতক্ষন কোথায় ছিলেন? আমরা কি এসব বুঝি?"
আমি মনে মনে বললাম, "শালার পাগল, এই সামান্য ফর্মটাই যদি না বোঝ, তবে তোমার মত ছেলের মাস্টার্স পড়ে লাত টা কি? খামাখা দেশের অর্থের অপচয়"।
আমার আঙ্কেল আবার ইতিহাসে মাস্টার্স পড়ে। অথচ দেখ তার অবস্থা। সে আবার বলতে লাগল, 'আপনার হেস্টেলে গিয়ে দুই দিন বলে এসেছি। আর আপনি এখন আসছেন? নেন দেখেন পুরণ করা হয়েছে কি না?
আমি কিছুক্ষন ফর্ম পূরন করা বাদ দিয়ে আঙ্কেলের বোন কে পূরন করতে লাগলাম। আঙ্কেলের বোনতো আন্টি তাকে অন্য নজরে দেখা পাপ। জীবনে কত আন্টি, আপাকে দেখেছি ওয়াইফ হতে। এ এখন আন্টি, খানিক বাদে সে ডার্লিং হবেনা তার কোন নিশ্চয়তা আছে? আন্টি সম্পর্ক তো দূরের, তার উপর দূর সম্পর্কের। আর ওয়াইফ হলে তো আর কোন দূরই থাকে না। এর চেয়ে নিকটতম আর কেউ হয় নাকি? অতএব অন্য চোখে
দেখলে পাপ হবে কেন? সওয়াবই তো হওয়ার কথা। দূরকে নিকট করার স্পৃহার ভিতর পাপ থাকবে কেন?
সে তো পুন্যেরকাজ! অপাতোতো কিছু পুন্য সঞ্চয় করি, পরে কর্ম ফিলাপ করা যাবে। আমার আজ মনে হচ্ছে, এই আন্টিটিকে, ঠিক আগে যা দেখেছি, তার চেয়ে আরো অনেক সুন্দরী হয়েছে। আর যুবতী সুন্দরী মাত্রই যুবক ছেলের আপনজন। যার চেয়ে আপন আর এ বয়সে কেউ নেই। তবু এক সময় এই আপন অবলোকন বাদ দিয়ে, ফর্ম পুরনের দিকে মনোযোগদিতে হলো।
আমি যখন আন্টিকে করছি, তৌফিক তখন গ্রামের একটি মেয়েকে হেলপ করছে। মেয়েটিকে একনজর দেখলাম। মেয়েটিও আমার দিকে এক নজর তাকালো। কি অপূর্ব সুন্দর দু'টি চোখ তার। চোখ দু'টি কালো বোরখার ফাঁকে যেন কচি সবুজ ঘাস, আকশের উপর আকাশ। আমার হৃদয় যেন শূন্য মরুভূমি। জীবনে অনেক সুন্দরী মেয়ে দেখেছি। সুন্দর চোখও কম দেখিনি। আফসোস। শরীর যেন থরথর করে কাঁপছে। বুকের মাঝে চিকন সুখের ব্যথা অনুভূত হচ্ছে। কীভাবে এর সাথে পরিচিত হব? বুকের ভিতর যখন ঝড় শুরু হয়েছে, তখন এলো সেই মাহেন্দ্রক্ষন। তৌফিক ডাক দিলো, এই তুষার এদিকে আয়।" আমি এগিয়ে গেলাম। তৌফিক বলল, "পরিচিত হ. একে চিনিস? ও হচ্ছে রাশমিন।"