কাল ঈদ হয়তো তাই কথাটা মনে পরে গেল । ২০১৫ সালের রোজার ঈদ এর চাঁদ রাতের ঘটনা । তখন আমি ইউসটন ষ্টেশন এ ওয়েস্ট কর্নওয়াল পেস্ট্রি শপ এ চাকরী করি , রাত্রিকালীন ম্যানেজার । বাহিরে তখন হাড় কাঁপানো ঠাণ্ডা । ৪০-৫০ মিনিট অন্তর অন্তর একজন দুজন খরিদ্দার আসছে । খুব বিরক্ত লাগছিল কারণ সারাদিন রোজা রেখে রাত্রিকালীন শিফট করতে হচ্ছে । ঐ দিকে বাংলাদেশে হয়তো ঈদের আমেজ শুরু হয়ে গেছে । স্টোরে বসে বসে রোজার ঈদ আসলে আগের রাত্রে কি করতাম তাই বসে বসে কল্পনা করছি । রাত তখন প্রায় ২.৪০ । হঠা ৎ দেখি একজন ভদ্র মহিলা হাতে কুকুরের বাঁধন নিয়ে আমার সামনে । খুব বেশি চিকন , উস্কখুস্ক চুল বাঁ হাতে বিয়ারের বোতল । বুঝলাম উনি বাড়িঘর হীন একজন যাযাবর । কাছে এসে বললেন ঈদ মুবারাক । আমি মৃদু হেসে জবাবে তাকে ধন্যবাদ জানালাম । Hey would you please give me a chicken choreo for my child ? বুঝলাম ভদ্রমহিলা তার কুকুরের জন্য খাবার চাচ্ছেন । বলে রাখা ভাল আমাদের স্টোরের সকল ব্রাঞ্চে বাসি খাবার গরীব দুঃখীদের দিয়ে দেয়া হত এবং কর্মরত অবস্থায় আমি নিজে নিজের জন্য ডিনার না করে রেখে দিতাম । কারণ আমাদের স্টোরে শূকরের বার্গার রান্না হত । তাই কখনও নিজের স্টোরের একমাত্র পানীয় জাতীয় দ্রব্যাদি ছাড়া কিছুই একপ্রকার স্পর্শ করতাম না । আমি নিজের খাবার সহ বেশ কিছু খাবার ভদ্র মহিলা কে দিয়ে দিলাম । সে খুব খুশি হয়েছিল । আমার হাতে হাত রেখে বলেছিল be careful my child .আমি বেশ অবাক হই । কেন আমাকে সতর্ক করলেন ? রাত ৪ টা বাজতেই আমার মনে হল স্টোর খোলা রাখার কোন মানে হয়না । চারিদিকে ভৌতিক পরিবেশ । Day shift manager আগেই বলেছিলেন কাস্টমার না থাকলে যেন তাড়াতাড়ি বাসায় চলে যাই । শপ বন্ধ করে ষ্টেশন ম্যানেজার কে চাবি দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বাস স্টপে এসে দাড়াই । গন্তব্য আপটন পার্ক । সেন্ট প্যানক্রাসের সামনে আমি । গায়ের ওভার কোট শীত মানছিল না । শরীরের কোষগুলো নিয়ম ভেঙ্গে জমাট বেঁধে যাচ্ছিল । ব্রিটিশ স্টাইল এ মাফলার টা জড়িয়ে হাতে হাত ঘষে গাঁ গরম করছি । বাস নাম্বার ৮ এলো । ড্রাইভার পরিচিত । একগাল হেসে মর্নিং বলে এক্সেলেতরে পা সিধিয়ে দিলেন । ১২ মিনিটের মাথায় আমি হোয়াইট চ্যাপেল । বাস থেকে নেমে এমন ঠাণ্ডা লাগলো ভাবি কি করা যায় । বেশ কিছুক্ষন হাঁটলাম । শীতে জমে গেলে একটাই উপায় , ১ বোতল ব্রান্ডি অথবা ভদকা খেলেই রক্ষে । দুইটা বাস স্টপ পেরোতেই দেখি একটা ওয়াইন শপ খোলা । ভেতরে গিয়েই মাঝারি সাইজের একটা Smirnoff নিলাম । দোকান থেকে বেরিয়েই ঢক ঢক করে গলাধকরন করি । হাফ শেষ করতে দেখি মাথাটা ঝিম ঝিম করছে । মাথা গরম হয়ে গেল । ঠাণ্ডা তখন অনুভব করা ভুলেই গেলাম । সব ভাল লাগে তখন । বাস এর জন্য বসে আছি । কিছুক্ষন বাদে একজন যুবক বাইক জ্যাকেট পরা মাথা ঢাকা আমার কাছে এসে বলে কিছুক্ষন আগে এক্সিডেন্ট হয়েছে বাস আসবেনা ১৫ নম্বর । তুমি কোথায় যাবে ? বললাম আপটন পার্ক । ও বলল চল আমিও ঐদিকে যাব । হাটি , যদি ট্যাক্সি পাই শেয়ারে চলে যাব । রাজি হলাম । ছেলেটিকে বেশ ভাল লাগলো । ইতালিয়ান যুবক নাম রবার তো । অনেক কথা হল বলল , তুমি কি কখনও জুইশ কবরস্থানে ড্রিংক করেছ ? বলি না । ছেলেটি বলে চল কাল তোমার ঈদ ইচ্ছা করলে আজ আমরা একসঙ্গে জুইশ কবরস্থানে ড্রিংক করবো । আমার তখন adventure এর নেশায় পেয়ে বসেছে । ভাবলাম কি হয় দেখি । দুজনে আনুমানিক আধা ঘণ্টা হেঁটে বেথনাল গ্রিন এর পেছনে এক প্রকাণ্ড কাঠের দরজার সামনে এলাম । পাশেই বেথনাল গ্রিন চার্চ । দরজা দিয়ে ঢুকতেই গাঁ হিম হয়ে এল । সারি সারি কবর । এমন পুরাতন কবর কখনও দেখিনি । একটু ভয় হল কিন্তু ড্রিংকের বদলে বেশিক্ষন স্থায়ি হলনা ভয় । রবার তো আমার হাত ধরে ভেতরে টেনে নিয়ে যায় । প্রায় কতক্ষন হেঁটে ছি জানিনা । হয়তো তখন কবরস্থানের মাঝ বরাবর । ওর হাত ছিল ভয়ানক ঠাণ্ডা । একজনের কবরের পাশে গিয়ে রবার তো বসলো । দুইজনে ড্রিংক করছি । রবার তো বলছে সে একজন কে খুব বেশি ভালবাসে । ভেনিসে থাকে । আমি প্রশ্ন করি কি সমস্যা ? জবাবে বলে ফ্লরা কে খুব ভালবাসে কিন্তু কোনদিন সে ফ্লরা কে পাবেনা । আমি ভাবলাম হয়তো ফ্লরা অন্য কাউকে বিয়ে করেছে । একটু চুপ করে বলি তুমি ইতালি যাও গিয়ে ফ্লরা কে বোঝাও । হয়তো সেও তোমায় চায় । বলতে না বলতেই হাউমাউ করে চিৎকার । এমন অস্বাভাবিক চিৎকার বাপের জীবনে কখনও শুনিনি । প্রচণ্ড ভয় পেয়ে যাই । বলি রবার তো চল ফিরে যাই । কুয়াশা পরেছে । ২ হাত সামনেই সব অস্পষ্ট । কবরস্থান এর ভেতর আমি একা । রবার তো আমার হাত ধরে কবরের মধ্যে নিয়ে যাবার উপক্রম ।
এবার ভয় পাবার পালা । যে কবরে বসে আছি তা নিতান্তই নতুন । বড়জোর ২-৩ দিন এর পুরাতন । জ্যাকেটের হুড খুলতেই দেখি তিনটে মানুষের চোখের সমান এক একটি চোখ । মুখে রক্তের দাগ । বুঝলাম আমি হয়তো একটু পর ভয়তেই মারা যাব । প্রাণপণ ছুটতেই দেখি পা অবশ হয়ে আসছে । কিছুই চোখে দেখছিনা । কিসে যেন পা আটকে পরে গেলাম । বুঝলাম কেউ পা চেপে ধরেছে । টেনে নিচ্ছে কোথাও । বুঝে ফেলেছি কোনদিন আর পরিবার দেখা হবেনা । এমন পরিস্থিতিতে যেন কাউকে না পরতে হয় । ঠিক তখনই কেউ আমার হাত চেপে ধরল । আমার জ্ঞান হারিয়ে ফেলি ।
কতক্ষন ছিলাম জানিনা । কুকুরের ঘেউ ঘেউ শব্দে চেয়ে দেখি সেই ভদ্র মহিলা । বলি আপনি এখানে ? সে বলে বাসে যাচ্ছিলাম । দেখলাম তুমি হাঁটছ আর কেউ একজন তোমার হাত ধরে । জানালা দিয়ে দেখেই বুঝিছি মানুষটি অস্বাভাবিক । খুব দ্রুত হাঁটছিল । পরবর্তী বাস স্টপে নেমে যাই । তোমায় ফলো করতেই দেখি তুমি Brady street কবরস্থান এ ঢুকছ । বুঝলাম তুমি বিপদে । আমি তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে বাসায় নিয়ে পেট ভরে বাঙালি খাবার পরিবেশন করি ।
পরদিন গুগল এ সন্ধান করি । দা সান পত্রিকার খবরটি জেনেই ভয়ে ৭ দিন কাজে বের হইনি । জ্বর ছিল ৩ দিন একনাগারে । রবার তো নামে এক ইতালিয়ান যুবক বেশ কিছুদিন যাবত লাপাত্তা । কে বা কাহারা তার বাইক কেড়ে নিয়ে তাকে হত্যা করেছে । তার শেষ সমাধি Brady street cemetery (কবরস্থান ) ।।