মাস খানেক আগের ঘটনা । সন্ধ্যে হয়ে ৬,৪৫ বাজে। হোয়াট স app এ ছোটবোনের কল । আমার একমাত্র ভাগ্নে মিঃ মিখাইল বেভান আমায় দেখেই কেঁদে ফেলল । দীর্ঘ দুই মাস তার মামাকে দেখেনা । মামা আয় মামা আয় বলতে বলতেই রাজ্যের কান্না জুড়ে দেয় । এত টুকু শিশু অথচ মামার প্রতি ওর ভালবাসায় মুগ্ধ হয়ে সাত পাঁচ না ভেবেই রও না হই । ও যখন আমার কোলে ঘুমায় তখন সত্যি মনে হয় পৃথিবীর সব থেকে বড় ভালবাসা মামা ভাগ্নের টান । এ যেন সৃষ্টিকর্তা নিজেই দিয়ে দিয়েছেন ।
বাসা থেকে রিক্সা যোগে গাবতলী । গাবতলি এসেই বুঝতে পারি দূরপাল্লার পরিবহন বন্ধ । ধন্যবাদ মাননীয় সরকারকে যারা অতীব বুদ্ধিমান , বুদ্ধি খাঁটিয়ে দূরপাল্লার পরিবহণ বন্ধ করেছে যাতে করোনা সরকারের সহিত নির্বাচনে হেরে যায় , অপরদিকে যাদের নিজস্ব পরিবহণ আছে তারা বাহিরে পদার্পণ করিলেও ক্ষতি নেই । সরকারের ধারণা করোনা টাকাওয়ালাদের সমীহ করে চলেন । সে যাক আমার গন্তব্য রাজবাড়ী ।
টার্মিনালে ঢুকতেই লুঙ্গিপরা ভুঁড়িওয়ালা একজন সুম কুস্তীগির আমার সামনে হাজির । আমি নিশ্চিত বিশালদেহি লোকটা জাপানে জন্মালে কুস্তি করে বেশ নাম কামাতেন । ৫ টাঁকার পান চিবাতে চিবাতে ভক ভক করে বিড়ি টানছিলেন । কাছে আসা মাত্রই গু কালারের দাঁত বের করে কহিলেন কৈ যাবেন ? বললাম পা টু রিয়া ঘাট । সময় নাই শেষ বাস । উইঠা পরেন । ভাড়া ২০০ । দুই সিটে একজন ? লক ডাউন এ সাহস কইরা গাড়ি চালাইতাছি আপনাগো মুখের দিকে তাকাইয়া । দুই সিটে একজন পোষাইব ? যুক্তিটা ফেলে দেবার নয় । মুচকি হেসেই গাড়ীর ভেতরে প্রবেশ করিলাম । শেষের দিকে সিটে বসিবামাত্রই কিছুক্ষন পর একজন যুবক আলট্রা মডার্ন হুন্দাই চেয়ার কোচ আমার পাশের সিটে বসলেন । শরীরের জড়ি বসানো চকচকে শার্ট , মাথার চুল লালচে , বাম কানে দুল , দুই হাতে দুইটা শিকল টাইপের ব্রেসলেট , প্যান্ট পায়ের গোড়ালি থেকে ১০ আঙ্গুল উপরে পরিহিত এবং মুখে মাস্ক নেই । শরীরে মেয়েদের পারফিউমের গন্ধ । মনে হইলো সালারে ধইরা চুমাই । যুবকটি দেশি না বিদেশি বুঝতে বেশ দেরি হল । আরও দেরি হল বুঝতে , সে কি মিঃ না মিসেস ?
ভদ্রভাবে কহিলাম , ভাই মাস্ক পরেন নি ? মেয়েলি কণ্ঠে যুবকটি বলে , কি যে বলেন না আঙ্কেল , মাস্ক পরলেই আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যায় । মাথা ঘুরতে শুরু করে । বমি বমি আসে । মনে মনে ভাবি সালার হিজড়ারাও আজকাল আমায় আঙ্কেল বলা শুরু করছে । মাস্ক না পরায় যতটা বিরক্ত হয়েছি তার চে ঢের বিরক্ত হয়েছি আঙ্কেল বলায় । যুবকটি মানিকগঞ্জ এ নেমে যায় । দেড় ঘণ্টা কচ্ছপের মত ঘাড় খোলসের মধ্যে ঢুকিয়ে বসে ছিলাম ।
যথারীতি ফেরী ঘাঁটে এসে ফেরীতে চরে বসি । রাত ১০.৪০ । ফেরীর ভেতরে কফি খেয়ে শরীর টাকে বেশ চাঙ্গা করে ফেলি । ওপারে এসে দেখি কেউ নাই । শুন শান নীরব । ঘাঁটে একটি মাত্র মাহিন্দ্র ( ছোট টে ম্পু ) । ড্রাইভার গলা ফাটিয়ে মার্কেটিং করেই যাচ্ছেন , ঐ রাজবাড়ী রাজবাড়ী রাজবাড়ী । ভদ্র ছেলের মত চুপ করে মাহিন্দ্র এর পেছনের সিটে গিয়ে বসি । প্যাসেঞ্জার বলতে আমি আর একজন বয়স্ক চাচা । ২০ মিনিটের অধিক চেঁচিয়েও ড্রাইভার সাহেব আর কোন কাস্ট মার যোগার করতে পারেন নি । গাড়ি ছাড়তে আরও ৮ জন লাগবে । অগত্যা ড্রাইভার বললেন শর্ট কাট গ্রামের ভেতর দিয়ে যাবেন । শর্ট কাট বলতে খুব ভাল করেই রাস্তা টাকে চিনি । দুই গোরস্থান এর মাঝ দিয়ে যেতে হয় । সময় ১ ঘণ্টার কম নয় । পাশেই পদ্মার শ শ শব্দ । শরীরটা ভয় ভয় এর অগ্রিম সঙ্কেত দিয়ে জানান দিলো । গাড়ি চলছে ভ্রম ভ্রম ভ্রম । কাঁটা খালির মোর আসতেই বয়স্ক চাচা নেমে গেলেন । গাড়ি আবার চলছে । ঘুটঘুটে নিকষ অন্ধকার । গারীর হেড লাইটের আলোয় যা দেখা যায় ।
মিনিট যেতে না যেতেই ড্রাইভার গাড়ি থামিয়ে বললেন ভাই সামনে আসেন । আমি বলি কেন ? তিনি বলেন সমস্যা আছে । সামনে বসেন । আমি পেছনের সিট থেকে নেমে ড্রাইভারের পাশের সিটে বসি । ফোনের ঘড়িতে বাজে রাত ১২.২০ । ভাঙ্গা চরা রাস্তা । বেশ ভয় করতে লাগলো । কবরস্থান বেশ সামনে । ড্রাইভার হঠা ৎ বলে বসেন ভাই একটু পর যাই ঘটুক শুধু আয়াতুল কুরসি পড়বেন । আমি বলি কিসের সমস্যা ? উনি জবাবে কিছু বলেন নি । বলতে বলতেই উনি গাড়ি দাঁর করালেন । হেড লাইটের আলোয় দেখি একজন শাদা শাড়ি পরিহিতা কম বয়েসি মেয়ে দাঁড়িয়ে । বুকের ভেতর যন্ত্রণা শুরু । শ্বাস ওঠানামা করছে অনবরত । আলোয় মেয়েটির চোখ দেখেই আমার অবস্থা কাহিল । শাদা পাথরের ভেতর আগুন জলছে । ভয়ে মাথা নুইয়ে ফেলি । ঐ চোখে চোখ রাখার সাহস আমার হয়নি । ভূত প্রেতে বিশ্বাস চিরদিন ছিল কিন্তু এমন ভাবে আমায় ধরা দেবে বুঝিনি । ভয়ে আয়াতুল কুরসির বদলে সুরা ফালাক পরতে শুরু করলাম । ভুলে রোজা রাখার দোয়াও আওড়ালাম । গাড়ী থামতেই বুঝলাম মেয়েটি চড়ে বসেছে । গাড়ি হঠা ৎ এমন ভারী হয়ে গেল যেন পেছনে ২০ জন বসেছে । পেছনে কান্নার শব্দ । ড্রাইভার বললেন আল্লাহ্র দোঁহাই পেছনে তাকায়েন না । আমি তাকালাম না । গাড়ি আস্তে আস্তে চলছে । কুকুর রাগলে যেমন করে তেমন শব্দ পেছনে । আমি পেছনে তাকানো ভুলে গেছি । একটু পর বুঝতে পাড়ি মেয়েটি গাড়ির ছাঁদে উঠে পরেছে । ধুম ধাম আওয়াজ । পারলে গাড়ি উল্টে দেয় । আমি চোখ বোজার চেষ্টা করি । বাম পাশের বাঁশ ঝোপ থেকে হঠা ৎ কুঞ্চী এসে বাঁ হাতে ধুম ধাম পেটাতে লাগলো তবুও ওপরের হোল্ডার ছারিনি । বাঁ হাত রক্তে লাল হয়ে এল । আর ড্রাইভারের ডান হাত । তবুও সে স্টিয়ারিং ছাড়েন নি । মার খেতে খেতে কবরস্থান এ আসতেই লাফ দিয়ে গাড়ী থেকে ২০ জন নেমে গেলেন । ড্রাইভারের সে কি ছুট । ৩৫ মিনিটের মাথায় এক টানে রাজবাড়ী । নিঃশ্বাস জোরে জোরে পরছিল । মনে হল শুন্যে ভেসে আছি । গাড়ী থেকে নেমেই সিগারেট ধরাই । ড্রাইভারকে সিগারেট দিয়ে দিয়াশলাই দিয়ে আগুন ধরিয়ে দেই । জিজ্ঞাসা করি ঘটনা কি ?
ড্রাইভারের মুখে শোনা । ৫ বছর আগে কোন এক পূর্ণিমায় এক মাহিন্দ্র এক্সিডেন্ট করেছিল ঠিক ঐ জায়গায় , ঐ সময় । এক্সিডেন্ট এ মারা পরে এক নতুন বৌ । সবে মাত্র তাদের বাসর শেষ করেছিল । ঢাকা থেকে এসেছিল বর বৌ । ওদের বাড়ি ছিল উরাকান্দা নামক গ্রামে । মেয়েটিকে ঐ কবরস্থানে দাফন করা হয়েছিল । রাত হলে এখনও অনেক মাহিন্দ্র ড্রাইভার এমন বিপদের সম্মুখীন হন ।