একটা সময় ছিল মেয়ে দেখলেই হ্যাব্লার মত তাকিয়ে থাকতাম । একটু পর পর চুল হাত দিয়ে ঠিক করতাম । সুন্দরী দেখলে কথাই নেই । নিজেকে উত্তম কুমার মনে হত আর সে সুচিত্রা সেন কিন্তু আয়না ছিল জাত শত্রু । সামনে তাকালেই দেখতাম ভিলেন কালা কাবিলা দাড়িয়ে । জীবনে বহুত প্রেমে পরেছি কিন্তু দুখের বিষয় অধিকাংশ প্রেম ছিল একপাক্ষিক । আমি প্রেমে পরেছি কিন্তু মেয়েরা ভাই মনে করতো । অধিকাংশ সময় প্রখর রোদে ২ টাকার বাদাম কিনে নায়কের সঙ্গী হয়ে কাটাতে হয়েছে । আবার ওদের ঝগড়া হলে মেটানোর দায়িত্ব ও আমার ছিল । অনেকটা গরু ঘাস খায় কিন্তু গরুর দুধ খায় গৃহস্থ ।
পৌষ মাসের কোন এক সময় । বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে দিতে শেষে রাত প্রায় পৌনে ১১ টা । হোস্টেলে ফিরছি মহাম্মাদপুর তাজমহল রোড । ধানমণ্ডির এনাম র্যাংগস ভবন থেকে রিক্সা নিলাম । ২৭ এর রোড পার হয়ে লালমাটিয়ার ভেতর দিয়ে যেতে শুরু করি । বাহিরে বেশ ঠাণ্ডা তাই হিমেল কণাগুলো জ্যাকেটের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে হৃৎপিণ্ডে কড়া নেড়ে যায় । লালমাটিয়ায় যেতেই মহিলা কলেজের প্রবেশ পথের বেশ আগে রাস্তার আলোয় দেখি কোন অষ্টাদশী রমণী শাড়ি পরিহিতা হাত উঁচু করে দাড়িয়ে আছেন । হয়তো আমার রিক্সা দূর হতে শূন্য ভেবেছিলেন । কাছে যেতেই দেখি এমা ! এত রমণী নয় যেন সাক্ষাৎ পরী । একবার দেখেই প্রতিদিনের ন্যায় প্রেমে হাবুডুবু খাওয়ার মত অবস্থা । তখনই জানতাম এই হাবুডুবুতেই একদিন ডুবে যাব । রিক্সা আলা মামা কে বলে বসলাম দাঁরা । রিক্সা গিয়ে রমণীর পাশে দাঁড়াল । চারিদিকে শুনশান নীরবতা । জিজ্ঞেস করলাম কোথাও যাবেন ? অষ্টাদশী এক দৃষ্টে আমায় নিরিক্ষা করছে । গলায় চেন , হাতে জয় বাবা কালা পাগলার কালো টায়ারের ব্রেসলেট , চুল উস্কখুস্ক আবার গায়ে গতরে কাল । নির্ঘাত রমণী সেদিন আমায় ছিনতাইকারী ভেবেছিল । রমণী প্রশ্নের জবাবে বলে মিরপুর ১ এ । বললাম কিছু মনে করবেন না । আমিও মিরপুর ১ এ যাব । মনে মনে বলি আজ পাইছি । আমি তো প্রেমে পরিনি, প্রেম আমার উপরে পরেছে । আস্তে করে রমণীকে পাশে বসবার জায়গা করে দিলাম । রিক্সা ওয়ালা কে বলি মিরপুর এ যাও । রমণী পাশে বসতেই বুক ধক ধক শুরু হল । কি মিষ্টি সুগন্ধ তাঁর সহিত তথাপি আমার কাছেও ছিল সস্তা বিঁড়ির ভক ভক স্মেল । দুটোতে ককটেল হয়ে এমন অদ্ভুত একটা ঘ্রাণ তৈরি হল যেন পিছে কেউ আগরবাতি জ্বালিয়েছে ।
রিক্সা চলছে খুব ধীরে ধীরে অনেকটা ৮ মাসের পোয়াতি দৌড়ালে যা হয় । রিক্সা মহাম্মদপুর পৌঁছেতেই জিজ্ঞাসা করি কিসে পড়ছেন ? রমণী নির্বাক । কথার উত্তর নেই । বুঝলাম ভয়ে সেধে আছে । লজ্জা নারীর ভূষণ , পুরুষে আবার লজ্জা কি ? আবার কহিলাম , নামটা জানতে পারি ? রমণী কহিল সুতপা । অতি উদ্যমে বলি আমি সাব্বির । রমণী আর কথা বাড়াল না । বাম হাতে চুল ঠিক করলাম । মনে মনে ভাবতে লাগি ইশ , যদি এ যাত্রা কখনও শেষ না হয় । সুন্দরী বললে ভুল হবে এ যেন সুন্দরীর মা । রিক্সা আসাদগেট পার হয়ে টেকনিক্যাল অভিমুখী তখন । নিজ থেকে বলি গান শুনবেন ? আমার গলা সত্যি খুব একটা খারাপ নয় । বুকের ধুক ধুকানিতে মুখ থেকে অদ্ভুত বেমানান রোম্যান্টিক হীন গান বেড়িয়ে এল । " ইচুক দানা , বিচুক দানা , দানার উপর ত্যানা ইচুক দানা " । গান শেষ হতেই মেয়েটি শব্দ করে হেসে ওঠে । আমি তাকিয়েই থাকি । কি অদ্ভুত সুন্দর তার হাসি । ঝড় শেষে তীরে ফিরে মাঝির যে হাসি তার চেয়েও প্রানবন্ত ছিল সুতপার হাসি । প্রেমে পরে একটু একটু জলে ডুবে জল পান করছি তখন ।
রিক্সা চলছে টেকনিক্যাল পার হয়ে মিরপুর ১ এর দিকে । রাত প্রায় ১৩ টা , অর্থাৎ ১ টা । প্রেম ভিখারি ছিলাম কিন্তু চরিত্র তখনও জলাঞ্জলি দেইনি । নিশ্চুপ নিভৃতে রিক্সা চলছে ধীরে ধীরে । মিরপুর ১ পার হতেই মেয়েটি আমার হাত ধরে বলে বামে । আমি রিক্সা মামা কে বলি মামা বাঁয়ে যাও । তিনি বাঁয়ে নিলেন । কি অদ্ভুত মেয়েটার হাত ছিল বরফের মত ঠাণ্ডা । বরফ হাতে লাগলে যেমন মিষ্টি ছ্যাঁক লাগে ঠিক তেমনি ছ্যাঁক লাগলো । রিক্সা তখন মাজার রোডে । একটু যেতেই মেয়েটি বলে ডানে । আমি সংগে সঙ্গে রিক্সা ওয়ালা কে বলি ডানে । রিক্সা ডানে গিয়ে কিছুদূর যেতেই মেয়েটি বলে দাড়াও । আমি রিক্সাকে দাঁড়াতে বলি । মেয়েটি আমার হাত ধরে রিক্সা থেকে নামে , আমায় নামায় । মেয়েটি আমার বাঁ হাতে ধরে টানতে টানতে সামনে নিয়ে যায় । অন্ধকারে সামনে কিছুই চোখে পড়েনা । কিছুদূর যেতেই দেখি প্রশস্ত এক বর ইটের তৈরি গেট । একটু দ্বিধায় পড়লাম । দূরের রাস্তার মধ্যে চলমান ট্রাকের ক্ষীণ আলোয় দেখি গেটে লিখা " আস সালামু আলাইকুম ইয়া আহ্লাল কবুর" । বুঝতে বাকি রইলনা আমি কোথায় ? মায়েটির পা এ তাকিয়ে দেখি সেটি সম্পূর্ণ মাটির উপর শুন্যে ভাসছে । আমার বাঁ হাতের অর্ধেক তখন কবরস্তানের ভেতর । কি বিভৎস তাহার মুখ ! চোখ ছিল অনেকটা রক্তে মাখা কিন্তু কপালে মাত্র একটা । দেখেই মূর্ছা যাই । আর কিছু মনে নেই ।
কে যেন গায়ে পানি ছিটা দিল । চোখ মেলতেই দেখি রিক্সা ওয়ালা মামা । ও মামা , মামা কি হয়েছে বলুন তো ? আমি উঠে বসলাম চুপ করে আছি । আপনাকে দেখলাম কবরস্থানের দিকে যেতে । যাবার কথা তাজমহল রোডে কিন্তু এলেন বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে । তাও কিছু বললাম না । কিন্তু ভাড়া না দিয়ে কবরস্থানে যাচ্ছেন দেখে ডাকলাম কিন্তু শুনলেন না। শেষে আপনার ডান হাত ধরে টানতেই বেহুঁশ হলেন । কি হয়েছে বলুন তো ? বলি মামা তুমি কি আমার সাথে কাউকে আসতে দেখনি ? তিনি বললেন কৈ নাতো ? কিন্তু আপনি লালমাটিয়ায় রিক্সা থামার পরেই দেখি আপনার ওজন বেশ বেড়ে গেছে । আমি বললাম , মামা তাজমহল রোডে চল । নিজের দিকে তাকিয়ে বুঝলাম ঘেমে নেয়ে উঠেছি । প্রেম করার সাধ জন্মের মত উবে গিয়েছিল সেদিন ।
পরদিন প্রথম আলোর প্রথম পাতায় শেষদিকে এক খবর নজর কারল । ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাস্ত্রবিজ্ঞান বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র সাব্বির খন্দকার জেল খানায় নিহত । মহিলা কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী সুতপা আহমেদকে সেদিন তার বন্ধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সাব্বির খন্দকার তাকে কলেজের মুখে সবার সম্মুখে রিক্সা থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয় । মাথায় গুরুতর আঘাতে তৎক্ষণাৎ সুতপা নিহত এবং তার লাশ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে । সেই থেকে সাব্বির পুলিশ হেফাজতে কিন্তু কে বা কাহারা তাকে ঘাড় মটকে মেড়ে ফেলে । লাশের আশে পাশে কেউ ছিলনা । ঘটনাটি তদন্ত সাপেক্ষ্য ।