Posts

গল্প

নানা বাড়ির ভয়

October 5, 2025

choto bivuti

188
View

তখন ক্লাস এইট এ । সবেমাত্র বৃত্তি পরীক্ষা শেষ হয়েছে । ক্লাস ৯ এ ভর্তির অপেক্ষায় । ১৯৯৬ সালের ডিসেম্বর মাস । বাহিরে কনকনে ঠাণ্ডা । বাবা সরকারী কর্মচারী হবার দরুন চাকরীর কর্মস্থল ছিল যশোরের বাঘাড় পাড়া থানা । মা কিছুতেই আর বাবার পিছু পিছু বাসা বদলাতে রাজি নন । অগত্যা আমাদের তল্পি তল্পা সহ কিছুদিনের জন্য নানার বাড়ীতে আশ্রয় ।

নানার বাড়িটি ছিল পাকিস্তান পিরিয়ডের দোতলা টিন শেড বাড়ি । নিচতলা তিন কক্ষ বিশিষ্ট আর মাঝের কক্ষের ভেতর থেকে একটা কাঠের সিঁড়ি দোতলায় উঠে গেছে । দোতলায় একটি মাত্র কক্ষ বারান্দা সহ । দোতলা আর নিচতলার মাঝের কক্ষ একটি কাঠের পাটাতন দিয়ে আলাদা করা অর্থাৎ নিচতলার মাঝের কক্ষ থেকে উপর তলায় যেতে কাঠের সিঁড়ি বেয়ে কাঠের পাটাতন এর তালা খুলে উপর তলায় যেতে হত । উপর তলায় কেউ থাকেন না । ছোট মামার বর্ণনা অনুযায়ী কে যেন প্রায় প্রায় দোতলা থেকে মাঝ রাতে সাদা কাপড় পরে নিচে নেমে মামার বুকের উপর দাড়িয়ে যায় । মামার বিছানাটি ছিল কাঠের সিঁড়ির পাশে । এমন ঘটনা বারংবার ঘটায় নানি নিচতলা আর উপরতলার মাঝে কাঠের পাটাতন দিয়ে তালা দিয়ে দেন ।

মা খালাদের মুখে শোনা আমাদের নানার বাড়ীতে ছিল পরীর বসবাস । অনেকেই দেখেছেন ঠিক রাত তিনটা বাজলেই বাড়ীর উঠোনে ঝন ঝন শব্দ । নানা বাড়ীর চার পাশে তিন নানার ঘর । মাঝখানে বিশাল উঠান আর সমস্ত উঠান ছায়ায় পরিপূর্ণ থাকতো ৪০ বছরের পুরনো আম গাছে । গাছটি এতই বড় ছিল যে এর বেড় পাওয়া যেত না । গাছটির বেশ কিছু ডালপালা দোতলা ঘরের জানালা দিয়ে প্রবেশ করত । নানা বাড়ীর উঠানের অপর পাশে ছিল রান্না ঘর আর রান্না ঘরের পিছনেই ছিল পাকা বাথ্রুম । নানা বাড়ীর প্রবেশ পথের ডান পাশে ছিল আরেকটি তিন কক্ষ বিশিষ্ট টিন শেড ঘর । সে ঘরেই সাময়িক বসবাস আমাদের । রান্না ঘর আর আমাদের থাকার যায়গার মাঝখানে ছিল টিউব ওয়েল । সেখান থেকে পানি নিয়ে প্রয়োজনীয় কাজ সারতে হত । এবার আসল কথায় আসা যাক ।

মাসুদ রানা সিরিজের গল্প পরতে পরতে অনেক রাত হয়ে গেল । বইটি আগের দিন রহমানিয়া লাইব্রেরী থেকে চুরি করে এনেছিলাম । তিন কক্ষের প্রথম কক্ষে তিন বোন , মাঝের কক্ষে মা আর শেষ কক্ষে ছিল আমার বসবাস ।বাবা প্রতি বৃহস্পতিবার বাড়ীতে আসেন । ঘড়ি ছিলনা তাই সময়ের হিসাব রাখিনাই । মাঝ রাত হবে হয়তো । আমার রুম থেকে মা এর রুমে গেলাম । পেটে প্রচুর ব্যাথা করছিল । চানাচুর খেতে খেতে বই পড়ার অভ্যাস ছিল । মা অঘোরে ঘুমোচ্ছে । সারাদিন অনেক খাঁটা খাটনি করে । খুব মায়া লাগলো । দুবার ডাক দেবার পর সারা না পেয়ে কাঠের দরজা খুলে বাহিরে এলাম । পঢ়নে হাফ প্যান্ট আর টি শার্ট । উঠান ছিল অন্ধকারাচ্ছন্ন কারণ উঠানের সুইস ছিল নানুর কক্ষে । বারান্দা থেকে বদনা নিয়ে কল পাড়ায় গেলাম পানি আনতে । জানতাম মাঝে মাঝে বাথ্রুম এর বালতিতে পানি থাকেনা । দশ গজ দূরে কল পাড়া । লোহার হাতলে চাপ দিলাম । ক্যাচ ক্যাচ করে শব্দ করে উঠল । হাতলে তিন চাপ দিতেই পুরো বদনা কানায় কানায় পরিপূর্ণ হয়ে উঠল । হঠাৎ কল পাড়ার টিনের দরজায় ঠক ঠক ঠক । রক্ত তৎক্ষণাৎ হিম হয়ে এল । শরীরের পশম দাড়িয়ে গেছে । কে বলতে গিয়ে বুঝলাম গলা দিয়ে কথা বের হচ্ছেনা । ঘুট ঘুটে অন্ধকার । কিছুক্ষন বোবার মত দাড়িয়ে রইলাম ।

আয়াতুল কুরসি তখনও মুখস্ত হয়নি । ভয়ে অজ্ঞ্যান হবার অবস্থা । ৫ মিনিট পর কিছুটা সাহস ফিরে এল । ভাবলাম বাতাসে এমন হয়েছে । দরজা খুলে দেখি কেউ নেই । মাথার উপর ছিল কুল বড়ই এর গাছ । হাল্কা চাঁদের আলোয় বাথ্রুমের দিকে এগিয়ে গেলাম । বাথরুমের টিনের দরজার পাশে ছিল সুইস । টিপ দিয়ে আলো জালালাম । ভয় কেটে গেল । জরুরী কাজে তখন ব্যাস্ত । কিছু সময় না যেতেই অন্ধকার হয়ে গেল । ভেতরটা অসম্ভব অন্ধকার । আবার শব্দ ঠক ঠক ঠক । ভয়তে বাথ্রুম করা বেমালুম ভুলে গেলাম । বাহিরে চাঁদের আলো ছিল । কিন্তু দরজার ফাঁক দিয়ে বাহিরে কিছুই দেখা যায়না । মা বলে ডাক দিলাম কিন্তু নিজের কণ্ঠ শুনে নিজেই অবাক । দর দর করে ঘামছি । বুঝলাম কিছু একটা হচ্ছে বাহিরে । আবার শব্দ ঠক ঠক ঠক । চুপটি মেরে থাকলাম কিছুক্ষণ । কোনমতে নিজেকে পরিষ্কার করে প্যান্ট পরিধান করলাম । কি করি ? ভয়তে অবস্থা অবর্ণনীয় । দরজার শেকল টা আস্তে খুলতেই ঝি ঝি পোকার ডাক । দূর থেকে পোষা কুকুরটা আমার দিকে তাকিয়ে গর গর করছে । বামে তাকিয়ে দেখি এ কি ! লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ । লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ । চাঁদের আলোয় স্পষ্ট দেখলাম । শাড়ি পরা কে যেন কল পাড়ায় কুল বড়ই গাছের উপর বসা । উল্টো দিকে মুখ ঘোরানো । কাঁধ হতে সাদা শারি মাটি ছুঁয়ে আছে । হাতের বদনা মাটিতে পরে গেল ।

চোখ মেলতেই দেখি নিজের খাটে শোয়া । মাথায় পানি ঢালছেন মা । গায়ে অনেক জ্বর । নানু সূরা পড়ছে , বড়আপা সূরা পড়ে মাথায় ফুঁ দিচ্ছেন । সুস্থ হবার পর শুনেছিলাম ছোট খালা আমায় কল পাড়ে পেয়েছিলেন আযানের পর পর ।

Comments

    Please login to post comment. Login