Posts

চিন্তা

আহমদ রফিক: অমূল্য নিধি বর্তমানে!

October 6, 2025

ফারদিন ফেরদৌস

87
View

মননশীল, রুচিবোধসম্পন্ন ও সহজ মানুষের সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে এইদেশে। উগ্রবাদের ঝোপঝাড়ে রয়ে যাচ্ছে কেবল প্রতিক্রিয়াশীলতার বিশৃঙ্খল আনাগোনা। আমরা এই ভেদ জানি বা না জানি, মরলে সব মিশে যাবে সর্বংসহা মৃত্তিকায়। মহাত্মা লালন ফকির তাঁর কালামে নিত্য বস্তু খাঁটি করতে মানুষের চরণ দুটি ভজবার আকুতি জানিয়ে বলেছেন, সহজ মানুষ ভজে দেখনারে মন দিব্যজ্ঞানে, পাবিরে অমূল্য নিধি বর্তমানে।

আহমদ রফিক ছিলেন তেমনি একজন সহজ মানুষ। যিনি নির্দ্বিধায় আমাদের সময়কার অমূল্য নিধি ছিলেন। দেশাত্মবোধ, সাহিত্য ও শেকড়ের সংস্কৃতি নিয়ে তাঁর গবেষণালব্ধ পাঠ যুগ থেকে যুগান্তরের পাথেয় হয়ে রবে রসাস্বাদনকারীর প্রাণে। যদিওবা তিনি চিরকালের জন্য অসীম ও অনন্ত মহাকালে তাঁর পদচিহ্ন আঁকলেন।

প্রথম আলো লিখেছে, 'আহমদ রফিকের জন্ম ১৯২৯ সালের ১২ সেপ্টেম্বর ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। তিনি রাজধানীর নিউ ইস্কাটনে একটি ভাড়া বাসায় থাকতেন। আহমদ রফিকের স্ত্রী মারা গেছেন ২০০৬ সালে। তিনি নিঃসন্তান।'

নাগরিক কবি শামসুর রাহমানকে নিয়ে 'নিঃসঙ্গ শেরপা: শামসুর রাহমান' শিরোনামে একটি গ্রন্থ প্রণয়ন করেছিলেন প্রথাবিরোধী লেখক হুমায়ুন আজাদ। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও স্বাধিকারে প্রেরণা হয়ে উঠা 'স্বাধীনতা তুমি পিতার কোমল জায়নামাজের উদার জমিন' পঙ্ক্তিমালার অমর কবি শামসুর রাহমানকে সঙ্গ দিতে পারে এমন কেউ খুব বেশি নেই এই বাঙলাভূমে।

প্রায় অভিন্ন জীবনোপলব্ধির অনন্য অভিধা লেখক, ভাষাসংগ্রামী ও রবীন্দ্রগবেষক আহমদ রফিকও যেন আরেক নিঃসঙ্গ শেরপা। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর উদাহরণতুল্য নিঃসঙ্গ মানুষ ছিলেন। ঠিক তেমন মানুষ রবিঠাকুরের জীবন ও কর্মের গবেষণায় ব্যাপৃত আহমদ রফিকও যেন ওই নিঃসঙ্গতারই গান গেয়েছেন আমৃত্যু। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে তাঁর ঈর্ষাকাতরদের কদর্য আক্রমণ সইতে হয়েছে। পারিবারিকভাবে অকালে স্বজন বিয়োগের যাতনাও সইতে হয়েছে ঢের। তেমনিভাবে স্ত্রীবিয়োগের পর নিঃসন্তান আহমদ রফিককেও ভীষণভাবে একাকীত্ব বরণ করতে হয়েছে। ঠিক এইখানে রবিঠাকুরের নিঃসঙ্গতা যেন পূর্ণকালীন লেখক আহমদ রফিকের একাকীত্বে এসে লীন হয়ে গেছে।

সমাজ-সংস্কৃতি ও রাজনীতির চৌকষ পর্যবেক্ষক আহমদ রফিক ভাষা আন্দোলন ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিষয়ে বিস্তর গবেষণা করেছেন। তাঁর কবিতা, প্রবন্ধ, ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস, গবেষণা মিলিয়ে লিখিত ও সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা শতাধিক। রবীন্দ্রবিশেষজ্ঞ হিসেবে তিনি দুই বাংলায় অগ্রগণ্য। একুশে পদক, বাংলা একাডেমি পুরস্কারসহ বহু পুরস্কার ও পদক পেয়েছেন আহমদ রফিক।

নিঃসঙ্গতা ও অনেকের অবহেলা সত্ত্বেও জীবন ও মানুষের প্রতি কখনো কোনো অভিযোগ জিইয়ে রাখতেন না তিনি। চলৎশক্তিহীন অবস্থাতেও অপেক্ষা করেছেন, কেউ পাশে বসুক, দুদণ্ড কথা বলুক। জীবনের শেষবেলায় চোখের ক্ষীণদৃষ্টি সত্ত্বেও মনের আলোতে ইতিহাস, সাহিত্য ও রাজনীতির নবতর বয়ান দিতে পারতেন অনর্গল। কিন্তু কথা শোনাবার মানুষের জন্য তাঁর অপেক্ষাটাই কেবল দীর্ঘায়িতই হয়েছে। পরিবার ও স্বজনহীন মানুষটি সমমনা মানুষদের কাছে উপেক্ষিত হয়েছেন।

গবেষক আহমদ রফিকের ৯৭তম জন্মদিন ছিল ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৫। এইদিন প্রথম আলোয় পরিবেশিত নিবন্ধ থেকে জানা যায়, 'বছর তিনেক থেকে তাঁর নিঃসঙ্গতা দুর্বিষহ হয়ে উঠেছিল। মাস ছয়েক আগেও নিকটজনদের অনুরোধ করেছেন ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁকে নিয়ে একটা ফাউন্ডেশন করার। এত বড় সুরস্রষ্টার বাড়ি-স্মৃতি ধ্বংস হয়ে যাবে, মানতে পারেননি। তাঁকে নিয়ে বলার সময় অশ্রুসজল হয়েছেন বারবার।'

নিঃসঙ্গ আহমদ রফিকের নিয়মিত খোঁজখবর যিনি রাখতেন, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ইসমাইল সাদী ওই জন্মদিনে প্রথম আলোতে লিখেছিলেন, 'চিকিৎসার ঘাটতি না পড়লেও ১০ দিন হলো সংজ্ঞাহীন অবস্থায় চিকিৎসাধীন। তিনি নিঃসন্তান। তবে একজন মানুষ কতটা স্বজনহীন হতে পারেন, হতে পারেন কতটা নিঃসঙ্গ, তা তাঁকে না দেখলে উপলব্ধি করা যাবে না। এই জুলাই মাসের আগেও তিনি কেবল সঙ্গ চেয়েছেন, কথা বলতে চেয়েছেন। কখনো যত্ন বা নিজস্ব চাহিদার জন্য উদ্গ্রীব ছিলেন না। চেয়েছেন কেউ একটু কথা বলুক, সময় দিক। এখন তিনি সংজ্ঞাহীন অবস্থায় এসবের ঊর্ধ্বে।'

একসময়ের রাজনীতিক, পরে পুরোদস্তুর লেখক আহমদ রফিক ২০২২ সালের ১২ সেপ্টেম্বর ৯৪তম জন্মদিনে রাজনীতি নিয়ে প্রথম আলোকে বলেছিলেন, 'আমরা রাজনৈতিকভাবে যা চেয়েছি, সেখানে পৌঁছাতে পারিনি। আমরা সাধারণ মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে পারিনি। একটা শ্রেণিকে আমরা সমৃদ্ধ করেছি, ইংরেজিতে যাকে বলে ভার্টিক্যাল গ্রোথ। এই গ্রোথ হয়েছে উচ্চবিত্ত শ্রেণি, মধ্যবিত্ত শ্রেণি, ব্যবসায়ী, পেশাজীবীদের। এরাই সমস্ত ক্রিম, মধু খেয়ে নিয়েছে। আর সাধারণ মধ্যবিত্ত, সাধারণ মানুষ অবহেলিত। তারা খুব সামান্য পেয়েছে, হয়তো পায়নি।'

এ থেকে উত্তরণের উপায় বাতলে দিতে গিয়ে আহমদ রফিকের বয়ান হলো, 'আমি বরাবর বলি, একটা আদর্শকে ধরে লক্ষ্যে পৌঁছাতে হয়। সমাজতন্ত্রের পতনের পর আমি অনেক ভেবেছি। দিনের পর দিন, রাতের পর রাত। শেষ পর্যন্ত মনে হয়েছে, হিউম্যানিজম বা মানবতাবাদকে যদি আমরা আঁকড়ে ধরি, তাহলে সেটার মাধ্যমে আমরা এগিয়ে যেতে পারি। বিভিন্ন রাজনৈতিক আদর্শ-মতাদর্শও কিন্তু হিউম্যানিজমের মধ্যে পড়ে। বাংলাদেশ নামে সেক্যুলার, আসলে কি সেক্যুলার? একের পর এক সংখ্যালঘু শ্রেণির ওপর বিশেষ করে নিম্নবিত্তের ওপর হামলা চলে। এটার ভেতরে বহু ফ্যাক্টর এসে যোগ দেয়। আমাদের সরকার চুপ করে দেখে। হামলার শিকার যারা, তাদের বরাত দিয়ে যদি বলি, তারা বলেছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যদি সময়মতো আসত, তাহলে এত ঘর পুড়ত না। তার মানে এসব ব্যাপারে উদাসীনতা আছে।'

৯৪তম জন্মদিন ২০২২ সালের ১২ সেপ্টেম্বর প্রথম আলোতে প্রকাশিত 'প্রয়োজন তাঁকে আগলে রাখা' শীর্ষক নিবন্ধে ইসমাইল সাদী জানান, 'অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী ২০১৮ সালে এক বক্তৃতায় তাঁকে নিয়ে বলেছিলেন, চিকিৎসাশাস্ত্র অধ্যয়ন করে কেবল রাজনৈতিক কারণে চিকিৎসক হতে না পারলেও বিচিত্র বিষয়ে প্রয়োজনীয় লেখালেখির মধ্য দিয়ে আহমদ রফিক প্রতিনিয়ত সমাজের চিকিৎসা করে গেছেন। ভাষা আন্দোলন নিয়ে নির্মোহ গ্রন্থপ্রণয়ন, স্বাধীনতা আন্দোলনের তথ্যভিত্তিক গবেষণা, নজরুল, জীবনানন্দ, চে গুয়েভারা, বাংলাদেশের কবিতা-বিষয়ক অনন্য আলোচনা, শহীদ বুদ্ধিজীবী ও কালোত্তীর্ণ মানুষদের নিয়ে নিজস্ব মূল্যায়ন তাঁকে নতুন প্রজন্মের কাছে স্মরণীয় করে রাখবে।
তবে অতি সম্প্রতি সামনাসামনি আলাপকালে আহমদ রফিক আক্ষেপ প্রকাশ করলেন। বললেন, যে জাতিরাষ্ট্রের স্বপ্ন তাঁরা দেখেছিলেন, তা অধরাই থেকে গেছে। একুশের চেতনাকে ঘিরে সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক জাগরণ সাফল্য এনে দিয়েছিল স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে। সেই রাষ্ট্রে বাংলা সর্বস্তরের মানুষের ভাষা হলো না, বরং উপেক্ষিত হলো।

দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ মানসিকভাবে সাম্প্রদায়িক। এদের অসহিষ্ণুতা নিয়ে তিনি বললেন, শুধু আমাদের দেশ নয়, ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন সময় ক্ষমতাসীন দলগুলোর রাজনীতি কখনোই শতভাগ প্রগতিশীল ছিল না -আপাতভাবে প্রগতিশীল ছিল। বিভিন্ন দেশের উদাহরণ টেনে বললেন, নবীন জাতিরাষ্ট্রগুলোর দুর্বলতা হলো, এসব দেশের জনগণ আন্দোলনে একরকম, ক্ষমতাপ্রাপ্ত হলে আরেকরকম। তখন উন্নতিকে খেয়ে ফেলে দুর্নীতি।'

ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস, ঢাকায় মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলো, দেশ বিভাগ ফিরে দেখা, সাম্প্রদায়িকতা ও সম্প্রীতি ভাবনা, রবীন্দ্রনাথের রাষ্ট্রচিন্তা ও বাংলাদেশ, রবীন্দ্রনাথের চিত্রকল্প, রবীন্দ্রনাথ এই বাংলায় অথবা বাঙালির স্বাধীনতা যুদ্ধসহ কতশত বইয়ে একজন বর্ষিয়ান মননশীল মানুষ আহমদ রফিক আজীবন দেশের সংস্কৃতি বদলাতে কথা বলে গেলেন। কিন্তু তাঁর কথা শুনবার অথবা তাঁর পাঠ গ্রহণ করবার মানুষের বড় অভাব এই পরগণায়। আহমদ রফিককে ধারণ করতে হলে যে মাপের ধীশক্তিসম্পন্ন মানুষের প্রয়োজন কালক্রমে তারা কেমন নাই হয়ে গেল। গবেষণালব্ধ তাঁর বইগুলো ধূলায় ধুসরিত হয়ে কেবল পুরনো হতে থাকবে। দায় ও দরদ নিয়ে কেউ হয়ত পাঠ করবে না। আহমদ রফিক চর্চার আর্গলও কেউ আর খুলবে না। কার্যত আমাদের মনোজগতকে এমন এক স্থবিরতা গ্রাস করবে -যেখানে সাম্যবাদী বোধ আর সাহিত্য-সংস্কৃতির বিশ্বজনীন স্বরূপ উপেক্ষিত হতে থাকবে। আমরাও হারাতে থাকব মানবিকতা ও মনুষ্যত্ববোধ। সময়ের ঘূর্ণিপাকে পড়ে আমরা আহমদ রফিকদের মতো অমূল্য নিধিদের হারিয়ে ফেলতে থাকব সশরীর ও চেতনায়।

মেধা ও মননহীন অনুৎপাদনশীল উলু খাগড়ার এক চেতনাহীন প্রান্তর ছেড়ে অন্য আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে আহমদ রফিক তাঁর সপ্রতিভ জ্ঞানচর্চা জারি রাখবেন -এই প্রত্যাশা রেখে তাঁর পুণ্যস্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাই। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'অনন্ত জীবন' কবিতার পঙ্ক্তিমালা তাঁর অনুপম ভাবশিষ্যের জন্য নৈবেদ্য হিসেবে রাখা থাক:
এই জগতের মাঝে একটি সাগর আছে
নিস্তব্ধ তাহার জলরাশি,
চারিদিক হতে সেথা অবিরাম অবিশ্রাম
জীবনের স্রোত মিশে আসি।
সূর্য হতে ঝরে ধারা, চন্দ্র হতে ঝরে ধারা,
কোটি কোটি তারা হতে ঝরে,
জগতের যত হাসি যত গান যত প্রাণ
ভেসে আসে সেই স্রোতোভরে--
মেশে আসি সেই সিন্ধু-'পরে।

লেখক: সাংবাদিক 
২ অক্টোবর ২০২৫

Comments

    Please login to post comment. Login