Posts

চিন্তা

যা করে মালিকে করব, আল্লাহ্ তুই দেহিস!

October 6, 2025

ফারদিন ফেরদৌস

57
View

আপনি যখন আপনার সিদ্ধান্ত জোরজবরদস্তিতে অন্যের উপর চাপিয়ে দেন, তখন আপনি হয়ে ওঠেন ফ্যাসিজমের সুস্পষ্ট আইকন, আর জুলুমের শিকার মানুষটি হয়ে যান মজলুম। ভাববাদী মতাদর্শে ঈশ্বর হয়ত মজলুমের কথা শোনেন, কিন্তু রাষ্ট্রযন্ত্র নামের পাষাণ সংস্থাটি কারো মিষ্টি কথায় এতটুকু ভোলে না। ক্ষমতার ভিত মজবুত রাখতে ভাববাদীদের দিকে নজর দেয়ার সময় রাষ্ট্রযন্ত্রের নেই। সে মান্যতা দেয়, সমীহ করে অথবা পরিষ্কারভাবে বললে ডরায় কেবল রাজনীতিরে। কাজেই কারো প্রতিবাদের ভাষাকে যদি রাজনীতিকীকরণ না করা যায়, যেকোনো রাষ্ট্রে অন্যায় বা অন্যায্যতার প্রতিকার পাওয়ার আশা বৃথা। কারণ রাষ্ট্রযন্ত্র ঘুরেফিরে ওই রাজনীতিই করে।

প্রথম আলোয় পরিবেশিত খবর থেকে জানা যাচ্ছে, বাউল ফকিরের মতো দেখতে এক ব্যক্তিকে ধরে তিনজন লোক জোর করে চুল কেটে দিচ্ছেন। বয়স্ক মানুষটি অনেকক্ষণ চেষ্টা করেন নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে। না পেরে শেষ পর্যন্ত অসহায় আত্মসমর্পণ করে তিনি বলেন, ‘আল্লাহ, তুই দেহিস।’

সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এমন একটি ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, হেনস্তার শিকার ব্যক্তি হলেন ৭০ বছর বয়সী হালিম উদ্দিন আকন্দ। তিনি ময়মনিসংহের তারাকান্দা উপজেলার কোদালিয়া গ্রামের বাসিন্দা। স্থানীয় বাসিন্দারা তাঁকে হালিম ফকির হিসেবেই চেনেন। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, হালিম উদ্দিন পাগল বা মানসিক বিকারগ্রস্ত নন। বৃদ্ধ হালিম উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেছেন, ‘সেদিন (ঘটনার দিন) সকালে বাজারে একটি দোকানে বইছিলাম। কোদালিয়ার একটা লোক আমারে হুইজ (জিজ্ঞাসা) করে, কই যাইবাম। তহন কই, লালমা (গ্রাম) যাইবাম। কয়, অতো আগ্গয়া (দূরে)! তহন আমি হাঁইট্টা যাওনের লাইগ্যা পথ দেই। হিও এইবায় আয়া মোবাইল করছে হেরারে। পরে হেরা বাইর অইছে, আমারে আটকাইছে। আমি ঘরে বইয়া আছিলাম। আমারে ছেছরাইয়া বাইর কইরা এই কাম করছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমার তো শক্তি কোলাই না। ৮-১০ জনে ধইরাললে কী করণ। আমারে ফালায়া দিয়া হুতাইয়া চুল কাটছে। হেইবালা আমি বেহুঁশ হয়া গেছিলাম।' সেই ঘটনার শারীরিক ও মানসিক আঘাত এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেননি বৃদ্ধ হালিম উদ্দিন। বাইরে বের হতে অস্বস্তি বোধ করেন। তিনি গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, ‘হেই থাইক্কা আমি কামকাজ করতে পারি না, বাজারে আইতারি না, ঘরবৈঠক আমি। রোগী ঝাড়তে পারি না। আসকা মাইরা শইল বেহুঁশ হইয়া যায়, মাথাত পানি ঢালন লাগে (হঠাৎ হঠাৎ অচেতন হয়ে পড়েন, মাথায় পানি ঢালতে হয়)।’

প্রথম আলোর পক্ষে প্রশ্ন ছিল, যাঁরা চুল কেটে দিলেন, তাঁদের বিচার চান কি না, এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আমি কোনো কিছু কই না, যা করে মালিকে করব।’

ঠিক একইরকম আকুতি আমরা দেখেছিলাম গোয়ালন্দের নূরাল পাগলার স্বজনদের মুখে। আধ্যাত্মিকতা চর্চাকারী গৃহের প্রধান মুরুব্বির মরদেহ আয়োজন করে কবর থেকে তুলে নিয়ে জনসমক্ষে পুড়িয়ে দেয়ার পরও স্বজনেরা রাষ্ট্রের কাছে কোনো বিচার চাননি। তারাও বলেছেন, স্রষ্টা যা ভালো মনে করবেন তাই করবেন, কারো প্রতি কোনো অভিযোগ নেই।

বস্তুত "আল্লাহ্ তুই দেহিস” -এই বাক্য উচ্চারণের মধ্যে নিহিত আছে রাষ্ট্রের প্রতি অবিশ্বাস। আধুনিক রাষ্ট্রকাঠামো, আইনি প্রতিকার, কিংবা প্রশাসনিক সহায়তার কোনো প্রত্যাশা নেই এই উচ্চারণে। এটি আসলে রাষ্ট্রকে টোটালি প্রত্যাখ্যানের ভাষা।

ফরাসি ইতিহাসবিদ ও দার্শনিক পল-মিশেল ফুকোঁর ভাষায় রাষ্ট্র যখন জনগণকে কেবল শাসনযন্ত্রের চোখে দেখে, তখন জনগণ পাল্টা রাষ্ট্রের বৈধতাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে। রাজবাড়ির গোয়ালন্দের নূরাল পাগলার অনুসারী, ময়মনসিংহের কোদালিয়ার আব্দুল হালিম আকন্দ কিংবা তাঁদের অনুবর্তীরা রাষ্ট্রের কাছে অভিযোগ না করে সরাসরি ঈশ্বরকে সাক্ষী ডাকছেন -এটি রাষ্ট্রচ্যুত এক অস্তিত্বের ঘোষণা।

অনেকেই আছেন ভাববাদীদের এই সরল মনস্তত্ত্বকে বাহ্বা দিয়ে রাষ্ট্রের আসল কর্তব্য বেমালুম ভুলিয়ে দিতে চাইছেন। কিন্তু এর জের কল্যাণরাষ্ট্রের জন্য সুখকর নয়।

গণমানুষ সংঘবদ্ধ কিছু চিহ্নিত অমানুষের দ্বারা হেনস্থার শিকার হচ্ছেন হরহামেশা। এই ফৌজদারি অপরাধনামা রাজনৈতিক ইস্যু। এই রাজনৈতিক ইস্যুকে পারলৌকিকতার দিকে সরিয়ে নিচ্ছে কেউ কেউ। এর ফলে রাষ্ট্রীয় অপরাধ বা প্রশাসনিক ব্যর্থতা এক ধরনের মেটাফিজিকাল পরিসরে নিক্ষিপ্ত হয়, যা বাস্তব রাজনৈতিক সমাধানের পথে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়। দার্শনিক কার্ল মার্ক্স যে “ভাববাদী ধোঁকা” (idealist illusion) সম্বন্ধে সতর্ক করেছিলেন, এখানে তারই প্রতিফলন দেখা যায়। সমাজের প্রভাবশালী শ্রেণি তাদের নিজেদের স্বার্থকে সার্বজনীন সত্য, প্রাকৃতিক নিয়ম বা সাধারণ জ্ঞানের মতো করে হাজির করে। ফলে বাস্তবের ভেতরকার বৈষম্য, শোষণ ও ক্ষমতার সম্পর্ক আড়াল হয়ে যায় -এটাই আইডিওলজিক্যাল ইল্যুশনের সারকথা।

রাষ্ট্র কেবল সেই প্রতিবাদই শোনে যা রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে তাকে চাপে ফেলে। এটি ইতালীয় মার্ক্সবাদী দার্শনিক এবং কমিউনিস্ট রাজনীতিক আন্তোনিও ফ্রাঞ্চেস্কো গ্রামশি “হেজিমনি” তত্ত্বের সঙ্গে মিলে যায় -যেখানে রাষ্ট্র কেবল মতাদর্শের নয়, বলপ্রয়োগেরও আধিপত্য বজায় রাখে।

কাজেই 'আল্লাহ্ তুই দেহিস' ধ্বনি রাষ্ট্রের জন্য রাজনৈতিক সংকেত নয়; এটি রাষ্ট্রের কাছে নিতান্তই একটি আধ্যাত্মিক উচ্চারণ, যার বাস্তব কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। অথচ মাজার ভাঙা, দরবার পোড়ানো কিংবা যত্রতত্র চুলকাটা গোষ্ঠী রাষ্ট্রীয় নিষ্ক্রিয়তা কিংবা মদদেই সক্রিয় থাকে। এজন্যই তাদের মোকাবেলা করতে হলে সংগঠিত রাজনৈতিক আন্দোলন প্রয়োজন, ভাববাদী স্লোগান নয়।

প্রতিবাদ যখন কেবল নান্দনিকতা বা দার্শনিকতার স্তরে সীমাবদ্ধ থাকে, তখন তা এক ধরনের “অপ escapism” হয়ে দাঁড়ায়। ফরাসি দার্শনিক আলবেয়ার কামুর The Rebel গ্রন্থে বিদ্রোহের নান্দনিকতা ও রাজনৈতিক কার্যকারিতার মধ্যে পার্থক্য তুলে ধরা হয়েছে। প্রতিবাদ যদি বাস্তব রাজনৈতিক শক্তিকে চ্যালেঞ্জ না করে, তবে তা শেষ পর্যন্ত “সৌন্দর্যচর্চা” হয়ে পড়ে।

বাস্তব জীবনের চাপ, দুঃখ-কষ্ট, একঘেয়েমি বা সমস্যার মুখোমুখি না হয়ে কল্পনার জগতে ডুবে থাকা বা বিনোদনের মাধ্যমে সেগুলো থেকে মানসিকভাবে পালানোর চেষ্টা করা বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এটি কেবল আবেগময় সংহতি তৈরি করে, কিন্তু রাষ্ট্রীয় সহিংসতা বা গোষ্ঠীগত নিধনকাণ্ড প্রতিরোধে কার্যকর হয় না।

রাষ্ট্রকে স্বীকার করে নিয়েই রাষ্ট্রের ওপর বৈপ্লবিক রাজনৈতিক চাপ অব্যাহত রাখা জরুরি। কোনোমতেই আধুনিক রাষ্ট্রের রাজনৈতিক কাঠামো থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার সুযোগ নেই।

কাজেই আমরা দ্ব্যর্থহীনভাবে বলত চাই রাষ্ট্রীয় নিষ্ক্রিয়তায় মাজার-ভাঙা কিংবা চুলকাটা গোষ্ঠীকে মোকাবিলা করতে হলে দরকার সংগঠিত রাজনৈতিক প্রতিরোধ। 'যা করে মালিকে করব'র মতো ভাববাদী শ্লোগান সহজিয়া তরিকার ধারক ও বাহক সরল-সাদাসিধে মানুষের নিজস্ব অভিধানে সসম্মানে থাকুক। এই ভূমিতে সংঘটিত সকল ধরণের বর্বরতা, অসভ্যতা ও অমানবিকতা প্রতিরোধে আমরা রাষ্ট্রের প্রচ্ছন্ন প্রতিকার দেখতে চাই। গলা খুলে সকল অন্যায় ও অধর্মের সমন্বিত প্রতিবাদ ও নিন্দা জানাতে চাই।

লেখক: সাংবাদিক 
২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫

Comments

    Please login to post comment. Login