এই যুগ, আমরা ভাবছিলাম যোগাযোগের যুগ। প্রযুক্তির উৎকর্ষের এই দিনে আমরা কল্পনা করেছিলাম সারা বিশ্বকে এক সুতোয় গেঁথে দেওয়ার, সীমানা ছাড়িয়ে বন্ধুত্বের বন্ধন গড়ার। কিন্তু এই যে এতো এতো যোগাযোগের মাধ্যম, এই যে এতো এতো বন্ধুর তালিকা, তার মাঝে আমরা কি সত্যিই যোগাযোগ করতে পারছি?
নগরের আকাশে আজ এক সন্ধ্যাতারা উদাসীন। তার আলোয় মুখ ঢেকে বসে আছে এক তরুণী। স্মার্টফোনের পর্দায় তার চোখ আটকে আছে, কিন্তু তার হৃদয় যেন কোথাও হারিয়ে গেছে। তার ফেসবুক প্রোফাইলে শত শত বন্ধু, ইনস্টাগ্রামে হাজার হাজার অনুসারী, কিন্তু আজ এই সন্ধ্যায় তার পাশে বসে গল্প করার কেউ নেই।
এই যে বিচ্ছিন্নতা, এই যে নিঃসঙ্গতা, এ যেন আমাদের সমাজের এক নতুন ব্যাধি। প্রযুক্তির এই আলো ঝলমলে পৃথিবীতে আমরা যেন হারিয়ে ফেলছি মানুষের সান্নিধ্য, হৃদয়ের স্পর্শ। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম আমাদের হাতের মুঠোয় এনে দিয়েছে গোটা দুনিয়া, কিন্তু তার বিনিময়ে কেড়ে নিয়েছে আমাদের পাশের মানুষটিকে।
আমরা কথা বলি মেসেজে, দেখা করি ভিডিও কলে, কিন্তু হারিয়ে ফেলেছি চোখের ভাষা, কন্ঠস্বরের উষ্ণতা। আমরা শেয়ার করি সুখ-দুঃখের ছবি, কিন্তু ভুলে যাই পাশে বসে কান্না মোছার সান্ত্বনা, হাসির উল্লাসে সামিল হওয়ার আনন্দ।
এই যে নতুন প্রজন্ম, তারা বড় হচ্ছে ভার্চুয়াল বন্ধুদের ভিড়ে। তারা শিখছে লাইক আর কমেন্টে নিজেকে মাপতে, কিন্তু ভুলে যাচ্ছে মানুষের মনের জটিলতা, সম্পর্কের গভীরতা।
তবে কি প্রযুক্তিই দোষী? না, দোষ আমাদের, আমাদের ব্যবহারের। আমরা প্রযুক্তিকে করে তুলেছি প্রাচীর, যে প্রাচীর আমাদের আলাদা করে দিচ্ছে পরস্পর থেকে। আমরা যোগাযোগের মাধ্যমকে বানিয়ে ফেলেছি অযোগাযোগের কারণ।
এই অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার উপায় কি? আমাদের কি ফিরে যেতে হবে সেই পুরনো দিনে, যখন ছিল না ইন্টারনেট, ছিল না স্মার্টফোন? না, পেছনে ফেরা সম্ভব নয়, সমাধানও নয়। সমাধান হলো সচেতনতা, হলো প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার।
আমাদের মনে রাখতে হবে, প্রযুক্তি হলো মাধ্যম, সেতু। সেতু যেমন দুই তীরকে জুড়ে দেয়, তেমনি প্রযুক্তিও আমাদের কাছে এনে দিতে পারে দূরের মানুষকে। কিন্তু সেই সেতুর ওপর দিয়ে আমাদের নিজেদেরই হেঁটে যেতে হবে, হাতে হাত রেখে, মন খুলে।
আমাদের বুঝতে হবে, ভার্চুয়াল বন্ধুত্বের বাইরেও একটা জীবন আছে, যেখানে আছে সত্যিকারের মানুষ, সত্যিকারের অনুভূতি। আমাদের সময় দিতে হবে পরিবারকে, বন্ধুদের, প্রতিবেশীদের। আমাদের শিখতে হবে আবার চোখে চোখ রেখে কথা বলতে, হাত ধরে হাঁটতে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম যে শুধু বিচ্ছিন্নতার কারণ নয়, সেটাও আমাদের মনে রাখতে হবে। এর মাধ্যমেও আমরা গড়তে পারি সুন্দর সম্পর্ক, যদি আমরা সচেতন থাকি, যদি আমরা বুঝতে পারি এর সীমাবদ্ধতা।
তাই আজ, এই সন্ধ্যায়, আসুন আমরা একটা প্রতিজ্ঞা করি। প্রতিজ্ঞা করি প্রযুক্তির দাসত্ব থেকে মুক্ত হওয়ার, মানুষের কাছে ফিরে যাওয়ার। প্রতিজ্ঞা করি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে সেতু হিসেবে ব্যবহার করার, প্রাচীর হিসেবে নয়।
আসুন আমরা আমাদের হারিয়ে যাওয়া সন্ধ্যাকে খুঁজে পাই, সেই সন্ধ্যাকে যেখানে ছিল আড্ডা, ছিল গান, ছিল মনের কথা। আসুন আমরা ফিরে পাই আমাদের সেই হারিয়ে যাওয়া মানবিকতাকে, যে মানবিকতা আমাদের করে তোলে সত্যিকারের মানুষ।