Posts

উপন্যাস

পাবার মতো চাইলে পাওয়া যায়/ পর্ব-১

October 8, 2025

Kishore Karunik

Original Author কিশোর কারুণিক

104
View

     ‘এখানে বসতে পারি ?’
‘জ্বি-না, লোক আছে।’
মৃদুকণ্ঠস্বর কানে এলো, দাঁড়িয়েই থাকলাম। ট্রেনে প্রচ- ভিড়। আশে-পাশে সিট খালি নেই। কপোতাক্ষ এক্সপ্রেস। টিকিটে সিট নম্বর থাকে, কাউন্টার থেকে টিকিট নিতে পারিনি। আজ বোধ হয় জরিমানা দিতে হবে! মনে একপ্রকার ভয় কাজ করছে। আশে-পাশে অনেকেই বসে আছে। ট্রেন এক স্টেশন অতিক্রম করছে। এখনো ভদ্রমহিলার পাশের সিট খালি। লোক আছে বললো, অথচ কেউ বসছে না!
     ‘বই নেবেন ?  বই!’
একফেলিওয়ালাকে বই বিক্রি করতে দেখে জিজ্ঞেস করলাম, ‘জীবনানন্দ দাশের কবিতার বই আছে?’
     ‘না ভাই। রবিঠাকুর, মধুসূদন, নজরুল ইসলামের বই আছে।’ ব’লে, বইফেরিওয়ালা আমার দিকে তাকালো।
আমি বললাম, ‘না-লাগবে না।’ বলতেই ফেরিওয়ালা চলে গেলো। আমি দাঁড়িয়ে থেকেই খোলা জানালা দিয়ে বাইরের দৃশ্য দেখতে লাগলাম। মাঝে-মধ্যে সামনে বসে থাকা মেয়েটির দিকেও নজর পড়ছে। প্রকৃতির দৃশ্য আর মেয়েটি যেন একাকার হয়ে যাচ্ছে। আমার জীবনে এই প্রথম লুকিয়ে কোনো মেয়ের মুখের দিকে বারবার তাকানো। ট্রেন ছেড়েছে সকাল ৯টা ৩০ মিনিটে, এখন সকাল ১০টা ৫ মিনিট। পঁয়ত্রিশ মিনিট দাঁড়িয়ে আছি। আর এই পঁয়ত্রিশ মিনিটের মধ্যে বসে থাকা মেয়েটির দিকে বেশ কয়েকবার তাকিয়েছি। নিশ্চয় কী যেন আছে মেয়েটির চেহারায়! 
‘শ্রাবস্তী, এই শ্রাবস্তী আমি এখানে। দরকার হলে ডেকো।’
এক পুরুষকণ্ঠস্বর কানে এলো। পেছন ঘুরে থাকায় দেখা গেলো না লোকটিকে। সামনে বসা মেয়েটি ঘাড় নাড়িয়ে লোকটির কথাতেই সায় দিলো।
মেয়েটির নাম হয়তো শ্রাবস্তী। জীবনানন্দ দাশের এক কবিতায় এই শ্রাবস্তীর শব্দের উল্লেখ আছে। প্রথমে সংগ্রহে থাকা বেশ কয়েকটা বাংলা অভিধানে খুঁজেও শ্রাবস্তী শব্দের অর্থ খুঁজে পাইনি। না পাওয়ার ভেতর দুর্লভ আকাক্সক্ষা থাকে বোধ হয়! অবশেষে এক বইতে শ্রাবস্তী শব্দের অর্থ খুঁজে পেয়েছি। তখন মনে হয়েছে আমি বিশ্ব জয় করেছি। আর এই মেয়েটির নামও শ্রাবস্তী এবং আমার সামনে বসে আছে। ব্যাপারটি ভাবতে খুবই ভালো লাগছে।
এই পৃথিবীতে মানুষ জন্ম নেবার পর থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সে শিক্ষিত-অশিক্ষিত, অথবা যে রুচিরই মানুষ হোক, সে যা চিন্তা করে, মনে-মনে কল্পনা করে, আর তাই যদি তার জীবনে ঘটে যায়, তাহলে কেমন হতো পৃথিবীর পরিবেশ! ঘটে যাওয়া ঘটনার পান্ডুলিপির লেখক হয়তো তা হতে দেবে না। প্রকৃতি শুধু স্বাধীনতা দিয়েছে যেমন ইচ্ছে ভাবতে, স্বপ্নের জগতে নিজেকে জয়ী করতে। আমি কি দার্শনিক হয়ে যাচ্ছি ?
   ‘কোথায় যাবেন ?’ মৃদুস্বরে ব’লে শ্রাবস্তী মায়াবী চাহনিতে নৃত্যকরা চুলগুলোকে সংযত করতে-করতে বললো। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘আমাকে বলছেন?’
হ্যাঁ।’
‘রাজশাহীতে।’
‘বসবেন এখানে ?’
নির্লজ্জের মতো রাজি হতে গেলাম না। বললাম, না-না থাক, দাঁড়িয়েই ভালো আছি।
‘অনেক পথ তো, কতক্ষণ আর দাঁড়িয়ে থাকবেন! বসুন।’
শ্রাবস্তী নিজে একটু সরে আমাকে বসার জায়গা করে দিলো। নিজের কাছে একটু ভালো লাগলো। শ্রাবস্তী যখন নিজেকে গুছিয়ে নিচ্ছিলো, তখন আমি ওর মুখের দিকে তাকিয়েছিলাম। আসলে নামের সাথে চেহারার অদ্ভুত মিল আর ‘শ্রাবস্তী’-র চেয়ে মাধুর্যম-িত যদি কোনো নাম থাকে, তবে হয়তো এই মেয়েটিকে সেই নামে ডাকা যায়।
কেন যেন মনে হচ্ছে মেয়েটি অনেক গুণের অধিকারিণী। তাছাড়া আমি অপরিচিত। আমার সাথে যেভাবে আপনজনের মতো কথা বললো, হয়তো মেয়েটির মনে কোনো জড়তা নেই। যাদের মন নির্মল, তারা অনেক কিছু করতে পারে। তবে কি এই মেয়েটি নির্মল মনের অধিকারিণী ? তাছাড়া আমিই বা এতো কিছু ভাবছি কেন ওর সম্মন্ধে ?
‘কী হলো, বসেন।’
ব্যাগটা বাংকারে রেখে আমি বসে পড়লাম শ্রাবস্তীর পাশে। আশে-পাশের সবাই এক নজর তাকালো। শ্রাবস্তীর শব্দহীন হাসিতে আনন্দ দোল দিয়ে উঠলো মনের ভেতর। এর আগে বাসে-ট্রেনে যাতায়াত করেছি, কিন্তু আজ যা ঘটলো তা কোনোদিন ঘটেনি।
    চুপচাপ বসে আছি। শ্রাবস্তীও আর কথা বলছে না, জানালা দিয়ে বাইরের দৃশ্য দেখছে।
   আমি দাঁড়িয়েছিলাম বলে ও হয়তো ভদ্রতাবশত আমাকে বসতে বলেছে। কোথায় যাবো জিজ্ঞেস করেছে। এই অল্প সময়ে শ্রাবস্তীর সম্মন্ধে ভালো ধারণা তৈরী হয়েছে আমার। আমার সম্মন্ধে কী ভাবছে শ্রাবস্তী? আমি যে ওর প্রতিপদক্ষেপগুলো নিয়ে ভাবছি, ও কি তা বুঝতে পারছে ? না কি আমাকে আকর্ষণ করার জন্য এতোসব করছে! মনের  ভেতর কৌতূহল জাগছে।
   শ্রাবস্তী ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে ছোট একটি নোট বুক বের করে কী যেন দেখছে। ও-কি আমাকে দেখানোর জন্য নোট বুকটা বের করলো ? আমি মাঝে-মধ্যেই শ্রাবস্তীর দিকে তাকাচ্ছি। শ্রাবস্তী যা করছে হয়তো কোনো সুন্দরী মেয়ে কোনো পুরুষের সাথে এরূপ করলে, তারাও কি আমার মতো করে পাশে বসে থাকা মেয়েটির দিকে তাকাবে ? 
   হঠাৎ ট্রেনের গতি ধীর হয়ে এলো। ট্রেন কি এখানে দাঁড়াবে ? কৌতূহলী হয়ে শ্রাবস্তীকে ‘একটু দেখি’ বলে ওর উপর ঝুঁকে জানালায় মুখ বাড়ালাম। শরীরের  ভেতর....মুহুর্তে বিদ্যুৎ চমকে গেলো। 
  হয়তো শ্রাবস্তী নিজেকে সংযত করে বসতে গিয়ে ওর হাত আমার কোমড় স্পর্শ করে। এক ঝলক তাকালাম ওর দিকে। ও যেন লজ্জা পেল। সৌজন্যবোধ থেকেই ও ব’লে উঠলো ‘সরি’। কেন যেন মনে হলো, শ্রাবন্তী ভদ্রতা দেখানোর একটুও সুযোগ হাতছাড়া করছে না।
    ট্রেন পুরোপুরি থেমে গেছে। জানালা দিয়ে অনেকে উঁকি দিয়ে দেখছে। কেউ কেউ ট্রেন থেকে নিচে নামছে। আমি সিটে বসলাম।

Comments

    Please login to post comment. Login