Posts

পোস্ট

পেলিয়েটিভ কেয়ারে অকুপেশনাল থেরাপির প্রয়োজনীয়তা

October 10, 2025

IBN MOKTADIR

143
View

১. ভূমিকা

আজ বিশ্ব হস্পিক এবং পেলিয়েটিভ কেয়ার দিবস। এ দিবসের এবারের স্লোগান হচ্ছে– প্রতিশ্রুতি অর্জনঃ পেলিয়েটিভ কেয়ারে সর্বজনীন প্রবেশাধিকার। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সাথে তাল মিলিয়ে বাংলদেশেও এই দিবস উদযাপিত হয়। তবে উন্নত দেশে খুব পরিচিত বিষয় হলেও আমাদের দেশের জনসাধারণের মধ্যে এই পেলিয়েটিভ কেয়ার সম্বন্ধে ধারণা খুব কম।প্রতি বছর ৬ কোটিরও বেশি মানুষের পেলিয়েটিভ কেয়ার পরিসেবা প্রয়োজন, যার ৮০% এরও বেশি মানুষ নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশগুলিতে বাস করে। বিশ্ব হস্পিক এবং পেলিয়েটিভ কেয়ার এ্যাসোসিয়েশন (ডব্লেউএইচপিসিএ)  অনুমান করেছে যে পেলিয়েটিভ কেয়ারের চাহিদার অর্ধেকেরও বেশি উচ্চ-আয়ের দেশগুলিতে পূরণ করা হচ্ছে, যেখানে নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশগুলিতে-তে বৃহত্তর চাহিদার মাত্র ৪% পূরণ করা হচ্ছে, যা একটি অব্যাহত এবং আশ্চর্যজনক বৈষম্য।

পেলিয়েটিভ কেয়ার এমন এক ধরনের সমন্বিত সেবা যা জীবন-সংশয়ী বা দীর্ঘমেয়াদি অসুস্থতায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের শারীরিক, মানসিক, সামাজিক ও আত্মিক কষ্ট কমিয়ে জীবনের মান উন্নত করার লক্ষ্যে প্রদান করা হয়। এই যত্নের মূল উদ্দেশ্য রোগীকে “জীবনের শেষ পর্যায়েও অর্থবহ ও মর্যাদাপূর্ণ জীবনযাপন” নিশ্চিত করা। এই পরিপ্রেক্ষিতেঅকুপেশনাল থেরাপি রোগীর দৈনন্দিন জীবনযাপনে স্বনির্ভরতা ও মানসিক স্থিতিশীলতা আনয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

২. অকুপেশনাল থেরাপির মূল উদ্দেশ্য

অকুপেশনাল থেরাপির মূল লক্ষ্য হলো—

  • ব্যক্তিকে তার দৈনন্দিন জীবনযাপনের অর্থবহ কার্যকলাপে অংশ নিতে সহায়তা করা,
  • কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি ও সীমাবদ্ধতা হ্রাস করা,
  • মানসিক ও সামাজিক সুস্থতা রক্ষা করা,
  • জীবনমানের উন্নয়ন ঘটানো।

পেলিয়েটিভ কেয়ারে এই লক্ষ্যগুলো রোগীর শারীরিক ও মানসিক অবস্থা অনুযায়ী বাস্তবায়িত হয়, যাতে তারা তাদের অবশিষ্ট জীবন স্বাচ্ছন্দ্যে ও মর্যাদাসহ কাটাতে পারেন।

৩. শারীরিক সহায়তায় অকুপেশনাল থেরাপির ভূমিকা

পেলিয়েটিভ রোগীদের শারীরিক দুর্বলতা, ব্যথা, ক্লান্তি, জয়েন্ট স্টিফনেস বা মাংসপেশির দুর্বলতা প্রায়ই দেখা যায়।
অকুপেশনাল থেরাপিস্ট—

  • এনার্জি কনজারভেশন কৌশল শেখান,  যাতে রোগী কম শক্তি ব্যয় করে দৈনন্দিন কাজ সম্পন্ন করতে পারেন।
  • পজিশনিং ও মুভমেন্ট থেরাপি দেন, যা ব্যথা ও প্রেশার সোর কমাতে সাহায্য করে।
  • অ্যাডাপটিভ ইকুইপমেন্ট (যেমন: বিশেষ চেয়ার, গ্রিপার, ফিডিং এইড ইত্যাদি) ব্যবহারে সহায়তা করেন, যাতে রোগী দৈনন্দিন কাজ সহজে সম্পাদন করতে পারেন।
  • হাত ও শরীরের কার্যক্ষমতা বজায় রাখতে হালকা ব্যায়াম শেখান।

৪. মানসিক ও আবেগীয় সহায়তা

দীর্ঘমেয়াদি বা জীবন-সংশয়ী অসুস্থতা মানসিকভাবে রোগীকে ভীষণ ভীত ও হতাশ করে তোলে।
অকুপেশনাল থেরাপিস্ট—

  • রোগীর  আত্মসম্মান ও আত্মবিশ্বাস পুনরুদ্ধারে কাজ করেন।
  • অর্থবহ কাজ যেমন—চিত্রাঙ্কন, বাগান করা, বই পড়া, হস্তশিল্প ইত্যাদি কাজে রোগীকে সম্পৃক্ত করেন, যা মানসিক প্রশান্তি আনে।
  • রোগী ও পরিবারের সঙ্গে সাইকোসোশিয়াল কাউন্সেলিংকরেন, যাতে সবাই মিলে রোগীকে ইতিবাচকভাবে সহযোগিতা করতে পারে।
  •  

৫. দৈনন্দিন জীবনযাপনের প্রশিক্ষণ 

অকুপেশনাল থেরাপিস্ট রোগীকে ব্যক্তিগত পরিচর্যা, খাওয়া, পোশাক পরা, টয়লেট ব্যবহার, স্থান পরিবর্তন ইত্যাদি মৌলিক কাজ শেখান রোগীর বর্তমান সক্ষমতা অনুযায়ী।

  • প্রয়োজন হলে বাড়ির পরিবেশ  প্রবেশগম্য বা সহজলভ্য করে দেওয়ার পরামর্শ দেন।
  • পরিবারকে রোগীর  সহায়তা প্রদানের উপায় শেখানো হয়—যেমন কীভাবে রোগীকে বসাতে,  তুলতে, খাওয়াতে বা যত্ন নিতে হবে।

৬. জীবনের মান উন্নয়নে ভূমিকা

পেলিয়েটিভ কেয়ারের অন্যতম উদ্দেশ্য হলো জীবনমান উন্নত করা। অকুপেশনাল থেরাপি রোগীর জীবনে “অর্থপূর্ণতা” আনয়নে কাজ করে—

  • রোগীর আগ্রহ ও পছন্দ অনুযায়ী কার্যকলাপ বেছে দেন।
  • পরিবার ও সমাজের সঙ্গে  সম্পর্ক বজায় রাখতে সহায়তা করেন।
  • রোগীর পেশাগত বা সামাজিক ভূমিকার আংশিক পুনর্নির্মাণে সাহায্য করেন।

এর ফলে রোগী “আমি কিছু করতে পারি” এমন আত্মবিশ্বাস ফিরে পান, যা মানসিক স্বস্তি ও জীবনসন্তুষ্টি বৃদ্ধি করে।

৭. পরিবারের ভূমিকা ও থেরাপিস্টের সহযোগিতা

অকুপেশনাল থেরাপিস্ট শুধু রোগীর নয়, পরিবারকেও পেলিয়েটিভ যত্নের অংশীদার করে তোলেন।

  • পরিবারকে শেখান কীভাবে রোগীকে স্বনির্ভর করতে সহায়তা করা যায়।
  • যত্নদাতাদের মানসিক চাপ কমাতে কাউন্সেলিং ও রিলাক্সেশন টেকনিক শেখান।
  • প্রয়োজনে বাড়িতে উপযোগী থেরাপি পরিকল্পনা সাজিয়ে দেন,  যাতে রোগীর যত্ন নেওয়া সহজ হয়।

৮. হাসপাতাল ও কমিউনিটি পর্যায়ে প্রযোজ্যতা

অকুপেশনাল থেরাপিস্টরা—

  • হাসপাতালে: মেডিকেল টিমের সঙ্গে সমন্বয়ে কাজ করেন;  চিকিৎসক, নার্স ও ফিজিওথেরাপিস্টদের সঙ্গে যৌথভাবে থেরাপি প্ল্যান তৈরি করেন।
  • কমিউনিটিতে: বাড়িভিত্তিক সেবা, হোম ভিজিট ও সচেতনতামূলক কার্যক্রমের মাধ্যমে রোগী ও পরিবারের পাশে থাকেন।
  •  

৯. বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট

বাংলাদেশে পেলিয়েটিভ কেয়ার এখনো একটি বিকাশমান ক্ষেত্র। অনেক রোগী চিকিৎসার পাশাপাশি মানসিক ও দৈনন্দিন সহায়তার প্রয়োজন অনুভব করেন। অকুপেশনাল থেরাপিস্টরা এই সেবাকে আরও মানবিক ও কার্যকর করে তুলতে পারেন—

  • হাসপাতালভিত্তিক প্যালিয়েটিভ কেয়ার ইউনিট চালু করা এবং এইসব ইউনিটে কাজের সুযোগ তৈরি করা ।
  • অকুপেশনাল থেরাপিস্টদের নিয়োগ প্রদান এবং প্রশিক্ষণ বৃদ্ধি ।
  • জনগণের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানো জরুরি।
  •  

১০. শেষ কথা 

সবশেষে বলা যায়, পেলিয়েটিভ কেয়ারে অকুপেশনাল থেরাপি শুধু রোগীর শারীরিক স্বাচ্ছন্দ্যই বাড়ায় না, বরং তাকে জীবনের শেষ সময়টুকু মর্যাদার সঙ্গে বাঁচতে সহায়তা করে। এটি একটি মানবিক, সহানুভূতিশীল এবং জীবনকেন্দ্রিক পেশাগত সেবা—যা রোগের শেষ সীমায়ও জীবনের গুণগত মান বজায় রাখতে অপরিহার্য। তাই পেলিয়েটিভ কেয়ারের প্রতিটি পর্যায়ে অকুপেশনাল থেরাপিকে অন্তর্ভুক্ত করা সময়ের দাবি। 

লেখকঃ এ,এইচ, ইবনে মোক্তাদির

জুনিয়র কনসালটেন্ট-অকুপেশনালথেরাপি

পক্ষাঘাতগ্রস্থদেরপুনর্বাসনকেন্দ্র (সিআর পি), সাভার, ঢাকা-১৩৪৩ 

Comments

    Please login to post comment. Login