শিক্ষক সবাই হতে পারে না -এটি একেবারেই প্রকৃতিপ্রদত্ত অভিধা। সমাজ, সংসার ও ব্যক্তির অন্ধকার ঘুচিয়ে আলোর দিশা দেখানোই যে অভিধার প্রধানতম অভিপ্রায়।
বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে আমরা চারপাশে যেসব শিক্ষকদের দেখি তাদের অধিকাংশই অনন্যোপায় হয়ে শিক্ষকতা পেশায় এসেছেন। যে কারণে পদ্ধতিগত নৈতিক শিক্ষণ পদ্ধতির সাধনায় ব্রতী হতে তারা দায়বোধ করেন না।
কিন্তু যার জন্মই হয়েছে শিক্ষক হওয়ার জন্য সেই স্বভাব শিক্ষকের গুণপনার ফিরিস্তি বলে শেষ করা যায় না। আমাদের অনেকের শিক্ষক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম তেমনি একজন মহৎপ্রাণ শিক্ষক। যার অবস্থান ও আসন চিরকালের জন্য মহাকালে পোক্ত হয়ে রইল। মনজুর স্যারের মতো মানুষেরা কোনো সমাজ থেকে কখনোই বিদায় নেন না। তাঁদের আলোকের ঝর্ণাধারা ধুইয়ে দিতে থাকে সময়ের সমূহ ক্লেদ।
প্রকৃতির নিয়মে হয়ত এমনটা ঘটে চলেছে যে নশ্বর শরীরকে আমরা আর বাস্তব চোখে দেখতে পারছি না, তবে মহত্তম শিক্ষকদের মায়াভরা প্রেমময় অবয়বের পরাবাস্তব অবিনশ্বরতা কখনোই বিস্মৃত হবার নয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ইমেরিটাস অধ্যাপক, কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম তেমনি একজন পণ্ডিত ব্যক্তিত্ব, যিনি আমারও শিক্ষক ছিলেন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে বহু একাডেমিক পরীক্ষা স্যারের কাছে দিয়েছি। নন্দনতত্ত্ব শিখেছি। স্যারকে কখনোই বিদায় বলব না। একজন প্রজ্ঞাবান শিক্ষাবিদ, গুণী সাহিত্যিক ও নিবিষ্ট সংস্কৃতিসেবী এই ব্যক্তিত্বকে আজীবন মাথায় করে রাখব।
স্যারের সকল সুকৃতি আমরা কমবেশি সবাই জানি। বিশেষকরে কথাসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক হিসেবে তাঁর প্রজ্ঞা নিয়ে নিশ্চিতভাবেই ভবিষ্যতে কোনো শিক্ষার্থী তার ডক্টরাল কোর্সের নিরিখে জ্ঞানগর্ভপূর্ণ অভিসন্দর্ভ রচনা করবে। কিন্তু স্যার তাঁর জীবদ্দশার শেষ দিন পর্যন্ত আমাদের কথিত বিদ্বৎসমাজের জন্য যে মেসেজ রেখে গেলেন তা অতুল্য ও অমূল্য।
গত ২৭ সেপ্টেম্বর ঢাকার বাংলামোটরে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের ইসফেনদিয়ার জাহেদ হাসান মিলনায়তনে আবু খালেদ পাঠান ফাউন্ডেশন আয়োজিত 'আবু খালেদ পাঠান সাহিত্য পুরস্কার ২০২৫' বিতরণী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে অংশ নিয়েছিলেন এই শিক্ষাবিদ।
দ্য ডেইলি স্টার ওই অনুষ্ঠানে দেয়া স্যারের পুরো বক্তব্য নিয়ে সংবাদ পরিবেশন করেছে। সেখান থেকে স্যারের শেষ কথার রবির ঝলক আমরা উপলব্ধি করতে পারি।
ওই আয়োজনে আশির দশকের এক নাট্যকারের স্মৃতিচারণ করে সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, তাকে জিজ্ঞাসা করা হলে, কেমন আছেন? বলতেন, ভালো থাকার হুকুম আছে। তো আমাকেও বলতে হয় যে, আশাবাদ ধরে রাখার হুকুম আছে। হুকুমটা কারা করছে? আমার ছাত্র-ছাত্রীরা। আমার প্রতিদিনের সংসার কাটে ১৮ থেকে ২৪-২৫ বছরের ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে। কাজেই আমার ভেতর বার্ধক্য কোনোদিন আসবে না। যদিও আমার বার্ধক্য উপনীত, আমার বয়স—বার্ধক্যেরও গভীরে চলে গেছি। কিন্তু আমার ভেতর বার্ধক্য আসতে পারে না। কারণ ছেলে-মেয়েরা আমাকে সতেজ রাখে। তারা আমাকে আশাবাদ ধরে রাখতে উদ্বুদ্ধ করে।'
ভালো শিক্ষক না হলে ভালো শিক্ষিত ছাত্র-ছাত্রী তৈরি করা যায় না। এটি একেবারে আমার পরীক্ষিত একটা চিন্তা। শিক্ষককে ভালো হতে হবে। শিক্ষককে মেধাবী হতে হবে। আমাদের প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকরা কত বেতন পান? সংস্কার তো ওইখান থেকেই শুরু করতে হবে। মৌলিক বিষয়গুলো তো আপনাকে দেখতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা দাবি জানান, তাদের দাবিগুলো মিটে যায়। এখনো দেখছি, বেতন বাড়ানো হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা খুব আনন্দ পাচ্ছেন। তাদেরও বেতন বাড়বে। বেতন তো বাড়া উচিত প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকদের! এই বর্তমান বাজারে তাদের যদি দেওয়া হয় এক লক্ষ টাকা করে মাসে, তাদের থাকার জায়গা দেওয়া হয় মানসম্পন্ন। বিসিএস পরীক্ষার জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে সময় নষ্ট করার চাইতে এই মেধাবীরা এসে প্রাইমারি স্কুলে এসে ঢুকবে। আপনি ভাবুন, কত বড় একটা বিপ্লব হতে পারে শিক্ষার ক্ষেত্রে! কেউ শোনেননি কথা। আমি বহুদিন থেকে লেখালেখি করছি। কেউ একটা কথাও শোনেননি। সংস্কার হবে কী করে? যারা সংস্কার করবেন তাদেরও তো শিক্ষার অভাব আছে,' বলেন তিনি।
মনজুরুল ইসলাম বলেন, 'দেখুন শিক্ষার একটা সংস্কৃতি আছে, সংস্কৃতির একটা শিক্ষা আছে। দুটো মেলে না। যেসব দেশে দুটো মিলে গেছে, সেসব দেশে উন্নতি হয়েছে। শিক্ষার সংস্কৃতিটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, এটা আলোকিত করে মানুষকে। আর সংস্কৃতির শিক্ষা হচ্ছে সবাইকে সবার সঙ্গে যুক্ত করা। এই প্রাণের সঙ্গে প্রাণ যুক্ত না হলে, মনের সঙ্গে মনের মিল না হলে সমাজে কলহ থাকে, সমাজে অসূয়া থাকে, নিন্দাবাদ চলতেই থাকে, এবং এক সময় সেটি ভয়ংকর রূপ ধারণ করতে পারে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা তো আমরা সবাই পাই। তো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ভেতরে সংস্কৃতিটা কোথায় আমাদের? আলো জ্বালার সংস্কৃতি মনের ভেতর, জানার, একটা কৌতূহলের, উৎসাহের?'
রেনেসাঁর প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, 'পশ্চিমবঙ্গে উনিশ শতকে সেটি ঘটেছে কিন্তু খুব ছোট পরিসরে। সেই রেনেসাঁ দেশকে জাগায়নি, একটা সম্প্রদায়কে জাগিয়েছে শুধু। অথচ মধ্যযুগে আলাওল লিখেছেন পদ্মাবতী। রেনেসাঁ এখানে, এই পূর্ববঙ্গে ঘটেছিল যখন আলাওল পদ্মাবতী লিখছেন, সেটি সবচেয়ে বড় রেনেসাঁর ঘটনা। কারণ নিজেকে ছড়িয়ে দেওয়া, অন্য সম্প্রদায়ের চিন্তাকে গ্রহণ করা, উনিশ শতকের কলকাতার সম্প্রদায়ে সেটি ছিল না। এটি ছিল মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে, যার অনেক স্রষ্টা ছিলেন মুসলমান, যারা নিজেদের ভাষা নিয়ে ভেবেছেন, ভাষার সঙ্গে সংস্কৃতি নিয়ে ভেবেছেন, উত্তরাধিকার নিয়ে ভেবেছেন, লোকায়ত চিন্তা এবং প্রজ্ঞাকে কাজে লাগাবার কথা বলছেন।'
'ওখানেই তো আমাদের রেনেসাঁর বীজ রোপিত ছিল। সেই সেখান থেকে আমাদের মহীরুহ তৈরি হওয়ার কথা ছিল এতদিনে। হয়নি, কারণ শিক্ষাকে সবচেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ একটা খাত হিসেবে তৈরি করা এবং ভৌত কাঠামো তৈরির উন্নয়নের যে সমস্ত কাঠামো আমরা দেখি চারদিকে, সেগুলোর ওপর জোর দেওয়া হচ্ছে,' যোগ করেন তিনি।
এই শিক্ষাবিদ বলেন, 'আমাদেরকে বুঝতে হবে যে, দ্বন্দ্বমান সমাজে সব সময় পক্ষ-প্রতিপক্ষ থাকে। পক্ষের দিকে যদি আমরা থাকি, যেখানে শুভ আছে, সুন্দর আছে, কল্যাণ আছে, তাহলে বাকিগুলো দুর্বল হয়ে পড়ে। কিন্তু আমরা তো ওইদিকে চলে যাই। আমরা অকল্যাণ দেখলেই দৌড়ে পড়ি। অশুভ দেখলেই আমাদের আনন্দ হয়। বীভৎসতা-সহিংসতা আমাদের এত বেশি তৃপ্তি দেয়! একজন নিরীহ মানুষকে ধরে আমরা যেকোনো ধরনের অন্যায় করতে পারি তার সঙ্গে। তার ব্যক্তিগত স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করতে পারি। একজন নারীর নিজের ওপর কোনো নিয়ন্ত্রণ আমরা প্রতিষ্ঠা করতে কখনো দেবো না। তাদেরকে সব সময় একদম এক ধরনের মোরাল পুলিশিংয়ের ভেতর রাখব। আর মুক্ত চিন্তা যদি করতে না জানি, নিজের ভেতর যদি বিতর্ক না করতে পারি নিজের সঙ্গে নিজের বিতর্কটাই তো আমাদের চলে না কখনো! আমাদের বিতর্ক থাকে না, শুধু তর্ক হয়।'
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড পত্রিকায় সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম ২০২১ সালের ১৬ জুন একটি সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন। সেখানে স্যারকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, শিক্ষকরা এখন কতোটা পথ দেখাতে পারছেন? স্যার বলেছিলেন, না, তারা পথ দেখাতে পারছেন না। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের একটি বড় অংশ বিসিএস এর জন্য উদগ্রিব হয়ে থাকে। আমি তাদের দোষ দিচ্ছি না। বিসিএস পরীক্ষা মনে হয় একমাত্র পরীক্ষা যেখানে মামার জোর লাগে না, নিজের মেধা খাটিয়ে চাকরি পেতে পারে। এজন্যই এঠহ আকর্ষণীয়। বিশ্ববিদ্যালয়তো বিসিএস চাকরিজীবী তৈরি করবে না। বিশ্ববিদ্যালয় মেধাবী বিজ্ঞানী তৈরি করবে, তৈরি করবে সমাজ সেবক। মানবিকতা এবং দর্শন নিয়ে ভাববেন সেরকম দার্শনিক এবং মানবিক মানুষ তৈরি করবে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন সেটি হচ্ছে না। কারণ আমরা পথ দেখাতে পারছি না।
জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সুশিক্ষার পক্ষে কথা বলে গেছেন সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম। কিন্তু কেউ কোথাও তাঁর কথা রাখেনি -এমন আক্ষেপ নিয়েই স্যারকে শেষ কথাগুলো বলে যেতে হয়েছে।
আমাদের রাজনীতিবিদ অথবা দেশশাসকরা কেন শিক্ষায় পর্যাপ্ত বরাদ্দ কিংবা আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের বিচারে আধুনিক শিক্ষা নিশ্চিত করেন না? হতে পারে এটা ঠিকঠাক করলে গণমানুষের চোখ খুলে যাবে এবং তারা তাদের সুবিধাবাদী রাজনীতির সুযোগ হারাবে। বস্তুত মনজুর স্যার আমাদেরকে পথের দিশা দেখিয়ে গেছেন, মশাল জ্বালিয়ে রেখে গেছেন -আমরা যদি সেই আলোকবর্তিকার দিকে নজর না দিয়ে অন্ধকার অমাবস্যার সাধনা করে যেতে থাকি -সে দায় একান্তই আমাদের।
মনে রাখা জরুরি আমাদের ওপর ভালো থাকা কিংবা আশাবাদী হওয়ার হুকুম আছে। ঐশ্বরিক ওই হুকুমের নিবিষ্ট সূত্রধার ছিলেন সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম স্যার। আমরা স্যারের পুণ্যস্মৃতির প্রতি অতল শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করি।
লেখক: সাংবাদিক
১০ অক্টোবর ২০২৫