Posts

গল্প

পরিনীতা - প্রথম পরিচ্ছেদ

October 14, 2025

Rezwana Roji

Original Author শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

Translated by রেজওয়ানা প্রধান

199
View

গুরুচরণ চেচাইয়া ডাকিয়া উঠিলেন শেখর নাকি?শোনো, শোনো একজন দীর্ঘায়তন বলিষ্ঠ সুন্দর যুবা ঘরে প্রবেশ করিল।

গুরুচরণ বলিলেন বসো, আজ সকালে তোমার খুরিমার কান্ডটা শুনেচ বোধহয় ।

শেখর মৃদু  হাসিয়া বলিল ,কান্ড আর কি মেয়ে হয়েছে তাই? গুরুচরণ একটা নিঃশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন ,তুমি তো বলবে তাই কিন্তু তাই যে কি সে শুধু আমি জানি যে!

 শেখর কহিল ওরকম বলবেন না কাকা শুনলে বড় কষ্ট পাবেন তাছাড়া ভগবান যাকে পাঠিয়েছেন তাকে আদর-আহ্লাদ করে ডেকে নেওয়া উচিত। 

গুরুচরণ মুহূর্তকাল মৌন থাকিয়া বলিলেন, আদর আহ্লাদ করা উচিত সে আমিও জানি । কিন্তু বাবা ভগবানও তো সুবিচার করেন না, আমি গরিব, আমার ঘরে এত কেন এই বাড়িটুকু পর্যন্ত তোমার বাপের কাছে বাধা পড়েছে ,তা পড়ুক সেজন্য দুঃখ করিনি শেখর, কিন্তু এই হাতে হাতেই দেখনা বাবা এই যে আমার ললিতা মা বাপ মরা সোনার পুতুল একে শুধু রাজার ঘরেই মানায়।

কি করে একে প্রাণ ধরে যার তার হাতে তুলে দি বলতো ? রাজার মুকুটে যে কোহিনুর জ্বলে, তেমনি কহিনুর রাশিকৃত করে আমার এই মাটিকে ওজন করলেও দাম হয় না। কিন্তু কে তা বুঝবে! পয়সার অভাবে এমন রত্ন কেও আমাকে মিলিয়ে দিতে হবে বল দেখি বাবা ,শেষ সময়ে কি রকম সেল বুকে বাজবে? ১৩ বছর বয়স কিন্তু হাতে আমার এমন তেরোটা পয়সা নেই যে একটা সমন্ধ পর্যন্ত স্থির করি ।

গুরু চরণের দুই চোখ অশ্রু পূর্ণ হইয়া উঠিল । শেখর চুপ করিয়া রহিল। 

গুরুচরণ পুনরায় কহিলেন ,শেখরনাথ দেখতো বাবা, তোমার বন্ধুবান্ধবের মধ্যে যদি এই মেয়েটার কোন গতি করে দিতে পারো। আজকাল অনেক ছেলে শুনেছি টাকা করি দিকে চেয়ে দেখেনা , শুধু মেয়ে দেখেই পছন্দ করে। তেমনি যদি দৈবাৎ একটা মিলে যায় ,শেখর তাহলে বলছি আমি ,আমার আশীর্বাদে তুমি রাজা হবে। আর কি বলবো বাবা ,এ পাড়ায় তোমাদের আশ্রয়ে আমি আছি, তোমার বাবা আমাকে ছোট ভাইয়ের মতোই দেখেন ।

শেখর মাথা নাড়িয়ে বলিল আচ্ছা তা দেখব ।

গুরুচরণ বলিলেন ভুলনা বাবা দেখো ৮ বছর বয়স থেকে তোমাদের কাছে লেখাপড়া শিখে মানুষ হচ্ছে, তুমি তো দেখতে পাচ্ছ ও কেমন বুদ্ধিমতী, কেমন শিষ্ট শান্ত। একফোঁটা মেয়ে আজ থেকে ওই আমাদের রাধা বারা করবে সমস্ত ই এখন ওর মাথায়।

এই সময়ে ললিতা একটিবার চোখ তুলিয়ায় নামাইয়া ফেলিল। তাহার ওষ্ঠাধরের উভয় প্রান্ত ঈশ্বৎ প্রসারিত হইলো মাত্র।

 গুরুচরণ একটা নিঃশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন ওর বাপে কি কিছু কম রোজগার করেছে কিন্তু সমস্তই এমন করে দান করে গেল যে এই একটা মেয়ের জন্য কিছু রেখে গেল না।

শেখর চুপ করিয়া রহিল। গুরুচরণ নিজেই আবার বলিয়া উঠিলেন, আর রেখে গেল না বা বলি কি করে ?সে যত লোকের যত দুঃখ ঘচিয়েছে তার সমস্ত ফল টুকুই আমার এই মাটিকে দিয়ে গেছে, তা নইলে কি এতটুকু মেয়ে এমন অন্নপূর্ণা হতে পারে! তুমিও বলো না শেখর , সত্যি কিনা?

শেখর হাসিতে লাগিল ।জবাব দিল না ।

সে উঠিবার উপক্রম করে দেই গুরুচরণ জিজ্ঞাসা করিলেন, এমন সকালেই কোথা যাচ্চ?

শেখর বলিল ব্যারিস্টার এর বাড়ি - একটা কেস আছে। বলিয়া উঠিয়া দাঁড়াইতে গুরুচরন আর একবার স্মরণ করাইয়া বলিলেন, কথাটা একটু মনে রেখো বাবা! ও একটু শ্যাম বর্ণ বটে কিন্তু চোখ মুখ এমন হাসি এত দয়া মায়া পৃথিবী খুঁজে বেড়ালেও কেউ পাবে না।

শেখর মাথা নাড়িয়ে হাসিমুখে বাহির হইয়া গেল ।এই ছেলেটির বয়স পঁচিশ -ছাব্বিশ এম এম পাস করিয়া এতদিন শিক্ষানবিশি করিতেছিল , গতবছর হইতে অ্যাটর্নি হইয়াছে। তাহার পিতা নবীন যায় গুড়ের কারবারে লক্ষ্যপতি হইয়া কয়েক বৎসর হইতে ব্যবসা ছাড়িয়ে দিয়া ঘরে বসিয়া তেজারতি করিতেছিলেন বড় ছেলে অবিনাশ উকিল- ছোট ছেলে এই শেখরনাথ।

তাহার প্রকাণ্ড তেতলা বাড়ি পাড়ার মাথায় উঠিয়েছিল এবং ইহার একটা খোলা ছাদের সহিত গুরুচরণের ছাতা মিশিয়ে থাকায় উভয় পরিবারে অত্যন্ত আত্মীয়তা জন্মিয়েছিল, বাড়ির মেয়েরা এই পথেই যাতায়াত করিত।

Comments

    Please login to post comment. Login