স্কুল শিক্ষায় সংস্কৃতি আর আমাদের কূপমন্ডুকতা
বাংলাদেশে স্কুল পর্যায়ে সংগীত শিক্ষক নিয়োগের দাবি নতুন কিছু নয়। ইসলামপন্থী রাজনৈতিক সংগঠনগুলো সংগীতকে “হারাম” বলে বিরোধিতা করছে। তারা বলছে এতে নীতি নৈতিকতার নাকি আরো বিস়র্জন ঘটবে, নেত্রকোনার পূর্বধলার সেই আমার অজপাড়া গ্রাম থেকে গুলশান বননীর প্রতিটি মুসলমান পরিবারে একটা করে কোরআন শরীফ বা হিন্দুদের ঘরে গীতা বা বেদ রয়েছে, বাংলাদেশে হাজার হাজার কওমি কিংবা আলিয়া মাদ্রাসা রয়েছে, রয়েছে ক্লাস থ্রী থেকে এসএসসি পর্যন্ত ধর্ম শিক্ষা বই, প্রতিবছর শীত কালে গ্রাম থেকে শহরে, টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া আয়োজনের মাধ্যমে হাজার লক্ষ ধর্মীয় ওয়াজ মাহফিল হয়, এ সমস্ত কিছুই মানুষের কথা বলে, নৈতিকতার কথা বলে, চরিত্র সংশোধের কথা বলে, ঘুষ দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলে। এই সমস্ত কিছুই আমি সম্মান করি। তবে আসলেই কি এতো আয়োজনের পরে ও আমাদের নৈতিক উন্নয়ন ঘটেছে? নাকি সেটা আরো তলানিতে যাচ্ছে?। সুস্থ্য সংগীত চর্চা আমাদের বরকে যাওয়া নৈতিকতাকে আরো খারাপের দিকে নিয়ে যাবে? না, না। বেসিক্যালি এতে আমাদের নৈতিকতা বা ধর্মের কোন ক্ষতি হবে না , বরং এসব বিরুধী লোকজনের রাজনীতিতে নেগিটিভ প্রভাব পড়বে। খোদ সংস্কৃতি অঙ্গনের লোকজন ই কাজ পাবে না বা চাকরি যাওয়ার ভয়ে এই পদক্ষেপের পক্ষে কথা বলছে না, অবশ্য সামনে আপনারা এমনিতেই রুটি রোজগারের কাজ পাবেনা না, আপনাদের নিরবতা ই আপনাদের রুটি রোজগারের পথ বন্ধ করে দিবে, ভাগ্য খারাপ হলে সেসময় বেশি দূরে নয়। আর সাধারণ শিক্ষিত প্রগতিশীল মানুষজন মরার পরে জাহান্নামের ভয়ে এ নিয়ে তৎপরতা দেখাচ্ছে না অথচ জীবনের এপাড়ে জীবিত থাকাকালীন ই পুরো দেশটা জাহান্নামে পরিণত হয়ে গেছে। সংগীত শিক্ষা আপনাকে জাহান্নামে নিয়ে যাবে এই কূপমন্ডুকতা আমি দেখোছি আমাদের আশেপাশের বেশ ডিগ্রিওয়ালা মানুষের ও। অনেকের ভুল ধারণা, সংগীত মানেই অশ্লীলতা বা বিকিনি পরে নাচ। অথচ বাস্তবতা হলো— সংগীত মানে অশ্লীলতা নয়; বরং এটি মানুষের আবেগ, আধ্যাত্মিকতা, সংস্কৃতি ও সভ্যতার মেরুদণ্ড। সংগীত এক দেশের শেকড়, ইতিহাস ও পরিচয়ের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত।
***আধুনিক বিজ্ঞানে প্রমাণিত, সংগীত শিশুদের মস্তিষ্কের দুই অংশকেই সক্রিয় করে। Left hemisphere ভাষা, লজিক ও গণিত শেখায়; আর right hemisphere সৃজনশীলতা, কল্পনা ও আবেগ নিয়ন্ত্রণ করে।
স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির গবেষণায় : সংগীত শেখা শিক্ষার্থীর মনোযোগ ধরে রাখার ক্ষমতা ৩০% বেশি।
হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুল: যারা সংগীত শেখে তাদের গড় IQ ও স্মৃতিশক্তি ৭ পয়েন্ট পর্যন্ত বেশি।
হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়, জার্মানি তাদের গবেষণায় বলছে : সংগীত শিক্ষার্থীদের গণিত ও ভাষা শেখার গতি দ্বিগুণ করে।
অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি: গ্রুপ মিউজিক কার্যকলাপ শিশুদের সহমর্মিতা ও দলগত নেতৃত্ব শেখায়।
এমনকি চিকিৎসা বিজ্ঞানে এখন মিউজিক থেরাপি ব্যবহার হচ্ছে— ডিপ্রেশন, অটিজম ও আলঝেইমার রোগীদের চিকিৎসায়।
তাহলে যে বিষয়টি শিশুর মেধা, মনোযোগ, গণিত, ভাষা, মানসিক স্বাস্থ্য ও সৃজনশীলতা বাড়ায়, সেটিকে স্কুল থেকে বাদ দেওয়ার কোনো যৌক্তিকতা নেই।
**** আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা
বিশ্বের উন্নত ও শিক্ষায় অগ্রসর দেশগুলোর দিকে তাকালেই সংগীত শিক্ষার গুরুত্ব বোঝা যায়।
ফিনল্যান্ড, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া: বিশ্বসেরা শিক্ষাব্যবস্থায় সংগীত বাধ্যতামূলক বিষয়।
মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, তুরস্ক, ইরান: মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ হয়েও সংগীত শিক্ষা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে চালু আছে।
ভারত ও শ্রীলঙ্কা: প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক পর্যায়েই সংগীত শেখানো হয়। ভারতের নোবেলজয়ী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, অমর্ত্য সেন কিংবা বিশ্বসেরা মিউজিক ডিরেক্টররা ছোটবেলা থেকেই সংগীত শিক্ষা পেয়েছিলেন। আল বিরুনী বা আল রাবীর মতো বিশ্বসেরা মুসলিম মনীষীরা ও মেধা বিকাশে শিশুদের সুস্থ্য ধারার মিউজিক শিক্ষার গুরুতারোপ করেছেন।
অর্থাৎ, সংগীত শিক্ষা পশ্চিমা সংস্কৃতি চাপিয়ে দেওয়া নয়; বরং এটি গ্লোবাল স্ট্যান্ডার্ড শিক্ষার অংশ, যেখানে বাংলাদেশকেও পিছিয়ে থাকা উচিত নয়।
***সংগীত মানেই অশ্লীলতা নয়
অনেকের ভুল ধারণা— সংগীত মানেই আধুনিক পশ্চিমা নাচ-গান, বিকিনি শো বা অশ্লীলতা। আসলে তা নয়।হামদ, নাত, সুফি গজল, কাওয়ালি সবই সংগীতের অন্তর্ভুক্ত।বাংলার বাউল, ভাটিয়ালি, লালন, নজরুলগীতি, রবীন্দ্রসংগীত আমাদের সংস্কৃতির প্রাণ।সংগীত মানে আধ্যাত্মিকতা, মানবিকতা, সৃজনশীলতা ও সংস্কৃতির বহিঃপ্রকাশ।
সংগীত ছাড়া বাঙালিত্বকে পূর্ণ বলা যায় না। তাই এটিকে সবসময় অপসংস্কৃতির সাথে মিলিয়ে দেখা অযৌক্তিক।
***বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় সংগীত শিক্ষা চালুর জন্য কয়েকটি বাস্তব পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে—
প্রথমে সংগীতকে বিকল্প বিষয় হিসেবে চালু করা।
স্থানীয় সংগীত ঐতিহ্য যেমন বাউল, ভাটিয়ালি, নজরুলগীতি,কাওয়ালি ইত্যাদিকে পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করা।
স্কুলে যোগ্য মিউজিক শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া ও প্রশিক্ষণ বাড়ানো।
শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্য উন্নয়নে মিউজিক থেরাপি প্রোগ্রাম চালু করা।
***সংগীত শিক্ষা চালু হওয়া মানে বাচ্চাদের হাতে শুধু বাদ্যযন্ত্র তুলে দেওয়া নয়— বরং তাদের মন, মেধা, সংস্কৃতি ও পরিচয়ের দরজা খুলে দেওয়া। এটি শিশুদের শিক্ষা ব্যবস্থাকে পূর্ণাঙ্গ করে তোলে, তাদের সৃজনশীল ও মানবিক প্রজন্ম হিসেবে গড়ে তোলে। তাই ধর্মীয় ও রাজনৈতিক চাপ অতিক্রম করে এখনই বাংলাদেশের স্কুলে সংগীত শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া সময়ের দাবি।
এস এফ,
২০ সেপ্টেম্বর, ২০২৫।