রমনীর সরু নাভির দুলোচল আর লিপস্টিক মাখা ঠোঁট যুগলের গড়িমসি, সাথে খেমটা নাচ দেখিয়ে গুন্ডা বস করার কৌশল — ভারতীয় এবং আমাদের দেশীয় চলচ্চিত্রের চিরাচরিত নিয়ম, যা এখন লিগ্যাসিতে পরিণত হয়েছে। আবার নায়কের আমোদ-প্রমোদ এবং গুন্ডাদের নষ্টামির উপাদান হিসেবে আইটেম গান নামক অংশে এই লিগ্যাসি প্রয়োগ করা হয়।
অবৈজ্ঞানিক কিছু দৈব শক্তির প্রভাব এখানকার ভৌতিক সিনেমাগুলোতে দেখা যায়। সাবেক অন্যায়ের ফলস্বরূপ দুষ্ট শক্তি ঘরের আনাচে-কানাচে বাসা বেঁধেছে। চর্যাপদ, বৈষ্ণব পদাবলি, রামায়ণ, মহাভারত, ইউসুফ-জুলেখা ইত্যাদি প্রাচীন বিভিন্ন ধর্ম, আধ্যাত্মিক ভাব, প্রেম, বিরহ, ও দৈব শক্তি প্রধান সাহিত্যের সাথে মিল রয়েছে আমাদের আশেপাশের কয়েকটি দেশের চলচ্চিত্রের কল্পকাহিনির সাথে।
এতে করে আমরা যারা নতুন প্রজন্ম, তারা কিছুটা পিছিয়ে যাচ্ছি বাস্তবতার চিন্তাভাবনায়। তবে এগুলোই আমাদের সাহিত্যের ইতিহাস, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সাহিত্যের প্রেরণা। তবে চলচ্চিত্রের কাহিনীগুলোর ধারাবাহিকতা পরিবর্তন করা বাস্তবজীবনের বর্তমান সময়ের চাহিদা বলে আমি মনে করি। সময়ের সাথে যায়, বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনির সাথে মিল রেখে বাস্তবসম্মত সিনেমা যুগের চাহিদা।
গরিবের পোলা বড়লোকের মেয়ের সাথে প্রেম, পারিবারিক কলহ, গরিব থেকে ফকিন্নি, ফকিন্নি থেকে গরিব, প্রেম না মানে ধর্ম, লাল শার্ট হলুদ পাঞ্জাবি, ৮০ টাকার ডুপ্লিকেট রে-ব্যানের সানগ্লাস পরে কলেজ-ভার্সিটির সামনে নায়ক দাঁড়িয়ে নায়িকাকে প্রেম নিবেদন — এসব এখন বেখাপ্পা বলে মনে হয়। তাই দেশীয় চলচ্চিত্রের আজ এই বেহাল অবস্থা।
ভারত ও বাংলাদেশের ৯০% চলচ্চিত্রেই নারীর স্বাধীনতা ক্ষুণ্ণ হয়। সেখানে নারী ফ্যামিলির অমতে বিয়ে করতে পারে না, ফলে আবেগের বশে পালিয়ে যায় ফকিন্নির পোলার সাথে বা পছন্দের পোলার সাথে। মদ-গাঁজার সাথে নারীকে দেখানো এক প্রকার বিনোদনের বস্তু হিসেবে। আইটেম গানে মদ আর জুয়ার সাথে নারীর বাক-বাকুম নাচ, গুন্ডা গায়েল করার জন্য রমনীর সরু ৫ ইঞ্চি গর্ত নাভি, দু-ঠোঁটের সেক্সি আলিঙ্গন — এসব এখন অলিখিত আইন হয়ে গেছে। এসব পরোক্ষভাবে নারীকে নিচু করে দেখানো হয়, ভোগের বস্তু হিসেবে গণ্য করা হয়।
তবে বিদেশি মুভির সাথে তাল মিলিয়ে এখন আবার কুকুরকে গুন্ডা ধরার উপাদেয় হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। এখনো বেশিরভাগ মুভিতে ৫/৬টা গান থাকে, বেহুদা আবেগ ফুটে আসে গানগুলোতে — যাত্রাপালায় যেমন কথা হয়, সব গানে গানে।
ঘরে-বাইরে, নদীর তীরে, বনে-জঙ্গলে, ঘাটে, জলে বা ডাঙায়, উজান কিংবা ভাটির স্রোতে — এসব অবাস্তব আবেগের সিন দিয়ে ভরপুর বেশিরভাগ বলিউড, ঢালিউড, টলিউড, টালিউড সিনেমার কাহিনিগুলো। এক নায়ক ১০০ জনকে পিটিয়ে কোণঠাসা করে দেওয়া, লাল-নীল গুন্ডা বাহিনী — এসব খুবই অযৌক্তিক। কথায় কথায় ইংরেজি বাক্য উচ্চারণ করে স্মার্ট সিন বানাতে গিয়ে নিজ দেশের ভাষাকে ‘হুগা’ মেরে দিচ্ছে।
ভূখণ্ডগতভাবে স্বাধীন এসব দেশের মানুষ এখনো মানসিকভাবে পরাধীন, কারণ আমাদের কথোপকথনের সময় ২/৪টা ইংরেজি শব্দ না বললে লজ্জাবোধ করি। আর এসব দেশের নাটক-সিনেমাগুলোতে এর প্রভাব লক্ষণীয়ভাবে দেখা যায়।
গতানুগতিক ধারার বাইরে বের হয়েও কিছু সিনেমা হচ্ছে, তবে সেটা নগণ্য। একটা দেশের নাটক-সিনেমা ইন্ডাস্ট্রিই সে দেশের মানুষের রুচি, পরিচিতি, সমাজ কাঠামো ও সাহিত্যকে দেশ ছাড়িয়ে বহির্বিশ্বে পরিচয় করিয়ে দিতে পারে।
মানুষ আজীবন সংস্কৃতিমনা, মানুষ বিনোদনপ্রিয় — তার স্বাদ ব্যতীত মানুষ ব্যথিত হয়ে যায়, মানসিক শোকে ভোগে। ব্যথিত ও শোকাচ্ছ হৃদয়কে মুক্ত করার জন্য সেই বিনোদন সে নেবে — সেটা নিজ দেশের বিনোদন জগত হোক বা অন্য দেশের।
বর্তমান শিক্ষিত যুব ও তরুণ সমাজের বেশির ভাগ পাশ্চাত্যের বিনোদনের দিকে ঝুঁকে যাচ্ছে, কারণ দেশীয় চলচ্চিত্র ও নাটক তাদের বিনোদন দিতে ব্যর্থ হয়েছে। তাই তরুণ বা যুব সমাজকে দোষারোপ করা যাবে না, কিংবা আব্দুল হাকিমের বঙ্গবাণী কবিতা মুখস্থ করে দেশদ্রোহী বা জারজ বলে গালি দেওয়াও ঠিক নয়।