Posts

চিন্তা

ঘৃণা বিক্রি হয়, মানবতা নয়: ভাগাড়ের নিত্যবস্তু তাই কেবলই আবর্জনা!

October 18, 2025

ফারদিন ফেরদৌস

195
View

দেশে এখন অ্যানার্কিজম ও র‌্যাডিক্যালিজম দারুণভাবে হাত ধরাধরি করে চলছে। যেন এক পিতার ঔরসে দুই জমজ ভাই। কেউ একজন লিখেছেন, দেশটা ভাগাড় হলে, চারিধার থেকে আবর্জনা এসে ওই ভাগাড়ে জমবেই। কথাটা অসত্য নয়। কিন্তু দেশটাকে ভাগাড়ে পরিণত করছে কারা? কী তাদের অভিপ্রায়?

বাংলাদেশে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এক শ্রেণির সোশ্যাল মিডিয়া প্রভাবক তাদের অনুসারীদেরকে মারাত্মকভাবে বিপথগামী করে তুলছে। তারা ধরে নিয়েছে ৫ অগাস্টের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর পুরো সময়টাই তাদের পক্ষে গেছে। ধর্ম, রাজনীতি কিংবা দেশপ্রেমের নামে তারা এমন এক ডিজিটাল আন্দোলন গড়ে তুলেছে যার মূল উপজীব্য হচ্ছে গালি, ঘৃণা ও বিভাজন। তারা মানুষকে শেখাচ্ছে না, কীভাবে উদার হতে হয়, সৎ হতে হয়, মানবিক হতে হয় বা সমাজে অবদান রাখতে হয়। বরং তারা শেখাচ্ছে কীভাবে অন্যের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করতে হয়, কীভাবে প্রতিপক্ষকে শত্রু ভাবতে হয়। তাদের বক্তৃতায় নেই পড়াশোনার অনুপ্রেরণা, নেই শিল্প-সাহিত্যের সৌন্দর্যবোধ, নেই কর্মসংস্থানের বাস্তব পরামর্শ। আছে কেবল নৈরাজ্যের উস্কানি -যা ধীরে ধীরে সমাজের নরম-কোমল হৃদয়কে কঠিন ও হিংস্র করে তুলছে।

প্রশ্ন জাগে, মানুষ কেন এমন অ্যানার্কিস্ট তথা নৈরাজ্যবাদী হয়? তাদের উদ্দেশ্যই বা কী? কোনো দেশ যদি উচ্ছন্নে যায়, সেই বিশৃঙ্খলা থেকে তাদের লাভটাই বা কী?

সোশ্যাল মিডিয়ার ট্রোলিং আজ এমন এক মানসিক অবস্থায় পৌঁছেছে যেখানে নৈরাজ্যবাদীরা অন্যের কষ্টে হাসে, অপমানকে রসিকতা বলে মনে করে, এবং ভিন্নমতকে দেশদ্রোহিতা বলে গালি দেয়। এই অবস্থাই নৈরাজ্যবাদীদের প্রকৃত বিজয় -কারণ সমাজ যত বেশি বিভক্ত হবে, তাদের প্রভাব ততই বাড়বে।

যে সমাজে মানুষ চিন্তার চেয়ে প্রতিক্রিয়াকে বেশি গুরুত্ব দেয়, সেখানে নৈরাজ্যবাদীরা ‘নায়ক’ হয়ে ওঠে। তাদের আসল উদ্দেশ্য দেশের উন্নয়ন, সভ্যতা বা শুভবোধের পক্ষে নয় -বিশৃঙ্খলার মধ্য দিয়ে নিজেদের প্রভাব ও বাজার তৈরি করা। তারা বুঝে নিয়েছে, চরমমাত্রার অশান্ত জনতাই হলো সবচেয়ে সহজে প্রভাবিত হওয়ার মতো নির্বোধ জনগণ।

এই বিষয়টি শুধু বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নয়, বরং গ্লোবাল প্যাটার্ন হিসেবেও বিশ্লেষণ করা যায়। মোটাদাগে তিনটি ভাগে বিষয়টি বিশ্লেষণ করা যায়: 
১. মনস্তাত্ত্বিক প্রেরণা, 
২. রাজনৈতিক ও সামাজিক উদ্দেশ্য, এবং ৩. আদর্শিক ও অর্থনৈতিক লাভ

বিশ্বজুড়ে 'disruptive influencer' তথা বিপর্যয়-সৃষ্টিকারী প্রভাবক নামে এক সামাজিক-মনস্তাত্ত্বিক ধরন দেখা গেছে। হার্ভার্ড কেনেডি স্কুলের Shorenstein Center on Media, Politics and Public Policy (2021)–এর একটি রিপোর্টে বলা হয় -'Many populist digital influencers are driven by recognition hunger -a deep psychological need to feel significant in a polarized environment.' বাংলাদেশেও এই প্যাটার্ন দৃশ্যমান। এই ধরণের ব্যক্তি সাধারণত নিজের প্রতি সমাজের অবমূল্যায়ন বা হতাশা থেকে উঠে এসে, ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে attention economy-এর সুযোগ নেয়। অর্থাৎ যত বেশি বিতর্ক, তত বেশি ভিউ; যত বেশি গালি, তত বেশি শেয়ার। তারা জানে, ঘৃণা বিক্রি হয়, মানবতা নয়। তাই তারা সমাজ কর্তৃক উত্থাপিত প্রায় সকল আলোচনাই উত্তেজনার দিকে ঠেলে দেয়।

অক্সফোর্ড ইন্টারনেট ইনস্টিটিউটের Global Disinformation Order Report (2023)-এ বলা হয়েছে, 'Digital disinformation campaigns are often designed to weaken public trust in democratic institutions, thereby creating a vacuum for alternative authoritarian narratives.' বাংলাদেশে কিছু প্রবাসী বা প্রান্তিক রাজনৈতিক গোষ্ঠী রাষ্ট্রবিরোধী আবেগকে ‘রাজনৈতিক মূলধন’ হিসেবে ব্যবহার করে। তাদের লক্ষ্য সাধারণত তিনটি: রাষ্ট্রের প্রতি আস্থা ভাঙা – যাতে মানুষ রাষ্ট্রকে শত্রু ভাবে; সাংস্কৃতিক ভিত্তি ধ্বংস করা –যেমন মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতি; এবং নিজেকে বিকল্প নেতৃত্ব হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা –'আমরাই সত্যিকারের দেশপ্রেমিক' এই বয়ান তৈরি করা। এটাই মূলত এক ধরনের “Digital Anarchism” -যা রাষ্ট্রীয় কাঠামোকে অচল প্রমাণ করে নিজেদের মতাদর্শকে ‘একমাত্র মুক্তির পথ’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা।

এই নৈরাজ্যবাদী কণ্ঠস্বরগুলো কেবল মতাদর্শের জন্য নয়, বরং ইনফ্লুয়েন্সার অর্থনীতির অংশ। MIT’s Center for Civic Media (2022) এর একটি গবেষণা বলছে-
'Polarizing content yields higher engagement, which platforms translate into monetization and algorithmic amplification.' অর্থাৎ তারা যত বেশি রাগ সৃষ্টি করে, তত বেশি algorithmic boost পায়, আর সেই সঙ্গে বিজ্ঞাপন বা দান (Patreon, YouTube monetization, crypto donations) থেকে আয় করে। এছাড়া কিছু বিদেশি নেটওয়ার্ক বা ডিপ স্টেট তাদের রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক স্বার্থে 'destabilization narratives'-এর অংশ হিসেবে এই ধরনের কণ্ঠস্বরকে উৎসাহিত করে।

এই ঘৃণামূলক প্রচার কাঠামো আসলে collective reasoning–কে ধ্বংস করে। মানুষের মধ্যে যুক্তিবোধ, সহমর্মিতা ও মানবতাবাদ দুর্বল হয়; তার জায়গা নেয় tribalism তথা গোষ্ঠীবাদ -'আমরা বনাম তারা' মনোভাব। এখানেই তারা সফল হয়, কারণ সমাজে বিভাজন বাড়লে তাদের প্রয়োজন বাড়ে।

ফরাসি সমাজবিজ্ঞানী Gustave Le Bon তার The Crowd: A Study of the Popular Mind (1895) গ্রন্থে লিখেছিলেন -'When reasoning individuals turn into an emotional crowd, they lose moral restraint and become capable of destruction without conscience.' অর্থাৎ: যখন যুক্তিনিষ্ঠ ব্যক্তি উত্তেজিত জনসমাগমে পরিণত হয়, তখন সে নৈতিক সংযম হারায় এবং ধ্বংসকে বিবেকবর্জিত আনন্দ হিসেবে গ্রহণ করে। বাংলাদেশের বর্তমান সোশ্যাল মিডিয়া সংস্কৃতিতে এ বইয়ের ভবিষ্যদ্বাণী ভয়াবহভাবে সত্য হচ্ছে।

একটি সচেতন সমাজের লক্ষ্য হওয়া উচিত নৈরাজ্যের পরিবর্তে যুক্তি, মানবতা ও সংস্কৃতির পুনর্গঠন। কিন্তু আমরা দেখছি, যুক্তি এখন শত্রু, সংলাপ এখন দুর্বলতার চিহ্ন, আর মানবতা এখন ‘ভণ্ডামি’র আরেক নাম। যারা এই ঘৃণার বাণিজ্য চালাচ্ছে, তারা আসলে জানে -বিশৃঙ্খল জনগণই সবচেয়ে সহজে প্রভাবিত জনগণ। তাই তারা সমাজে এমন এক ক্রোধময় আবহ তৈরি করতে চায়, যেখানে সবাই কারও না কারও শত্রু হয়ে ওঠে, আর তারা থাকে সেই অগ্নিকুণ্ডের ওপর নিরাপদে -প্রভাবশালী ও লাভবান।

শেষ পর্যন্ত এ লড়াই কোনো মতাদর্শের নয়, বরং এক মানসিক যুদ্ধ -মানবতার বিপক্ষে। যে সমাজে মানুষ চিন্তার চেয়ে প্রতিক্রিয়াকে বেশি গুরুত্ব দেয়, সেখানে নৈরাজ্যবাদীরা নায়ক হয়, আর যুক্তিবাদীরা নির্বাসিত হয়। তাই এখন সবচেয়ে প্রয়োজন প্রশান্ত যুক্তির পুনর্জাগরণ -এমন এক সাংস্কৃতিক ও নৈতিক আন্দোলন যা মানুষকে শেখাবে, সুবোধ স্বাধীন চিন্তাই হলো প্রকৃত মুক্তি, ঘৃণায় কিছুতেই নয়। দেশটা ভাগাড়ে পরিণত হওয়ার আগে শুভবোধ, সত্য ও সুন্দরকে ফেরাতেই হবে।

লেখক: সাংবাদিক 
১৮ অক্টোবর ২০২৫

Comments

    Please login to post comment. Login