ধানক্ষেতের মাঝে ছোট একটা কাঁচা ঘর। টিনের ছাউনি পুরনো, দেয়ালে ফাটল, মাটির মেঝেতে পা রাখলেই ধুলো উড়ে যায়। তবুও এই ঘরটাই ছিল রহিম উদ্দিনের পৃথিবী।
তিনি একজন কৃষক—অন্যের জমিতে কাজ করে যা পান, তাই দিয়েই চলে সংসার।
সংসারের পাঁচ সদস্য: রহিম, তার স্ত্রী ছমিরা বেগম, পনেরো বছরের ছেলে রুবেল, সাত বছরের মেয়ে রিনা, আর বৃদ্ধা মা হালিমা খাতুন।
অভাব ছিল এই পরিবারের নিত্যসঙ্গী।
তবুও তারা বেঁচে ছিল ভালোবাসায়, আশা-নির্ভর জীবনে।
রুবেল ছিল খুব মেধাবী ছেলে। গ্রামের স্কুলে সবাই তাকে ভালোবাসত। স্বপ্ন ছিল একদিন শিক্ষক হবে, অন্যদের পড়াবে, পরিবারকে দারিদ্র্যের হাত থেকে মুক্ত করবে।
কিন্তু বাস্তবতা যেন তার স্বপ্নের ঠিক বিপরীত দিকে হাঁটছিল।
প্রতিদিন স্কুলে যাওয়ার আগে রুবেল মায়ের কাছে বলত,
“মা, আমার খাতাটা শেষ হয়ে গেছে, কাল নিয়ে দেবেন?”
আর মা বলত,
“আচ্ছা বাবা, কাল কোনোভাবে জোগাড় করব।”
কিন্তু “কাল” শব্দটা তাদের জীবনে খুব কষ্টের ছিল, কারণ প্রতিটি কাল মানে ছিল না পাওয়ার দিন।
একদিন রাতে ছমিরা ধোঁয়াভরা চুলার পাশে বসে ছিলেন। রহিম ফিরে এলেন মাঠ থেকে। ক্লান্ত মুখে বললেন,
“ছমিরা, কাল থেকে রুবেলরে আমার সাথে মাঠে নিতে হবে। এখন আর স্কুলের খরচ চালানো সম্ভব না।”
ছমিরার চোখ ভরে উঠল। “ওর তো স্বপ্ন ছিল শিক্ষক হওয়ার...”
রহিম মাটির দিকে তাকিয়ে বলল,
“পেট খালি থাকলে বই ধরা যায় না, ছমিরা।”
রুবেল দরজার আড়ালে সব শুনে ফেলেছিল। সেদিন রাতে সে কাঁদতে কাঁদতে মায়ের কাছে বলেছিল,
“মা, আমি কি চিরদিন গরিবই থাকব? আমারও তো একটা জীবন ছিল...”
মা কোনো উত্তর দেননি। শুধু তার মাথায় হাত রেখে বলেছিলেন,
“সব স্বপ্নই পূরণ হয় না, বাবা... কিছু সপ্ন অপূর্ণ থেকে যায়।”
এরপর থেকে রুবেল স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দেয়। সকালবেলা বাবার সাথে মাঠে যায়, ঘামে ভিজে শরীর, কিন্তু চোখে জমে থাকা স্বপ্নগুলো মরে না, শুধু কষ্টে নীরব হয়ে যায়।
২০২৪ সালের বর্ষাকাল অন্যসব বছরের মতো ছিল না।
আকাশ যেন অভিমানী শিশুর মতো অবিরাম কাঁদছিল।
দিনের পর দিন বৃষ্টি, নদীর পানি ফুলে-ফেঁপে উঠেছে।
চরের ঘরগুলোর চারপাশে পানি জমে গেছে, হাঁটাচলার পথ ডুবে গেছে।
রহিম বলল,
“পানি কমলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।”
কিন্তু পানি কমল না, বরং বাড়তেই থাকল।
এক রাতে প্রচণ্ড বাতাস বইতে লাগল, সঙ্গে প্রবল বৃষ্টি।
হঠাৎ ঘরের ভেতরে পানি ঢুকতে শুরু করল। পানির মাত্রা বাড়তে লাগল। তাই সবাই ছাদে উঠতে চেষ্টা করল।
রুবেল রিনার হাত ধরে রাখল শক্ত করে।
দাদি কাশতে কাশতে বললেন,
“আল্লাহ, বাঁচাও...”
হঠাৎ এক বিশাল ঢেউ এসে ঘরটাকে ভাসিয়ে দিল।
সবাই ছিটকে গেল আলাদা হয়ে।
রুবেল রিনার হাত ধরে ছিল, কিন্তু স্রোতের টানে হাত ছুটে গেল।