Posts

উপন্যাস

ক্যাম্পাস-প্রেম,পর্ব ৪

October 21, 2025

Humayun Kabir

265
View

 ৩৬

ক্যাম্পাস- প্রেম (উপন্যাস পর্ব ৪) 

হুমায়ুন কবীর 

আমার অকৃত্রিম বন্ধু সিগারেট। তাকে স্মরণ করতে হলো। ব্রিজের রেলিংয়ে বসে বসে ধোয়া  তৈরি করা ছাড়া এখন আর আমার কোন কাজ নেই। সমস্ত পৃথিবীতে এখন এই আমার প্রধান কাজ। সিগারেট টেনে টেনে ক্লান্ত হয়ে প্রায় দশটার দিকে ব্রিজ থেকে নামলাম। ব্যস্ত দড়াটানার জনস্রোত এখন কিছুটা থিতিয়ে  এসেছে।হাটা  শুরু করলাম। কালেক্ট্রি ভবনের নিচে আবছা অন্ধকার। বিশাল ভবনের উত্তরে ছোট্ট উদ্যান। সেখানে রাতের বধূরা রসের মেলা বসিয়েছে। স্ত্রী পুরুষের দর কষাকষির হালকা কথাবার্তা কানে ভেসে ভেসে আসছে। কত সস্তায় এখানে ভালোবাসা বিক্রি হচ্ছে। কেবল বাঁশ পটি পার হয়েছি। অপর পাশের ঘন অন্ধকার থেকে হাত নেড়ে ইশারায় একটা মেয়ে আমাকে কাছে ডাকছে।

৩৭

সে বোধ হয় একটাও খদ্দের পায়নি। তার জন্যও মায়া হল। লাজ লজ্জাহীন মেয়ে আর্দ্র  গলায় বলছে, ওই মিয়া লাগলে আসেন। 

সিগারেট টানতে টানতে দ্রুত প্রস্থান করলাম। 

সেই রাতেই। আমাকে হলের ছাদে ডাকা হল। ফলের ছাদ হল অপরাধী ছাত্রের জন্য রিমান্ডের সবচেয়ে নিরাপদ জায়গা। আজ আমাকে রিমান্ডে নেওয়া হবে। প্রায় ঘুমিয়েই পড়েছিলাম। হল কমিটির দুই নেতা দরজা ধাক্কাধাক্কি করে   জাগালো। তাদের চোখে মুখে আগুন ঝরে পড়ছে। যেন ওরা হুলো বেড়াল আর আমি নেংটি ইঁদুর। এখনই ঘাড় মটকে দেবে। আমি খুব বেশি পাত্তা দিলাম না। 

৩৮

জানিয়ে দিলাম পরে আসছি। ওরা চলে গেল। ভাবতে শুরু করলাম। কি করা যায়? এখন হলের অধিকাংশ ছাত্রই ঘুমিয়ে পড়েছে। আমার যারা দু-একজন আছে তারাও কে কোথায় আছে, হয়তো  ঘুমিয়ে পড়েছে।এই সুযোগে করিম তার ক্যাডার  বাহিনী দিয়ে আমাকে পেটাবে। ছাদে মোটা মোটা জ্বালানি কাঠ রয়েছে। যারা পেটাবে তারা নেশা করে তৈরি হয়ে বসে আছে। আমি ছাদে উঠবো দু চার কথা বলার পর হঠাৎ শুরু হবে মার। কারণ হিসেবে হাজির করা হবে, আজ মিছিল থেকে বেরিয়ে আসা, কলেজ ক্যাম্পাসে দেরিতে মিছিলে যোগ দেওয়া। মিছিলে চোখ দিয়ে স্লোগান  না দিয়ে চুপচাপ হাটা।করিম তার টিকটিকি শাহীনকে সব সময় আমার পিছনে লাগিয়ে রাখে। হয়তো আমার অজানা আরো কোন দোষ হাজির করা হবে। কি কি তার মনে আছে সেই ভালো জানে। 

৩৯

এই মুহূর্তে হল কমিটিতে আমার পক্ষে  কথা বলার মত কেউ নেই। পরের টার্মে হয়তো আমিই হলের সভাপতি হব, সেই ব্যবস্থা  জুমন ভাই করে দেবে। কিন্তু আজ বাঁচাবার কেউ নেই। করিম জুমন ভাইয়ের এন্টি গ্রুপ করে, আমি ভয়ে ঘামতে  শুরু করেছি। সিগারেট ধরিয়ে ঠান্ডা মাথায় চিন্তা শুরু করলাম। দরজায় আবার ধাক্কাধাক্কি শুরু হলো। এবার মনে হচ্ছে দরজা ভেঙে ফেলবে। আজ কপালের মার কেউ বাঁচাতে পারবে না। কোনো বুদ্ধি আসছে না। দ্রুত সিগারেট টানছি।ইতিপূর্বে ছাদের মা'র খেয়ে কয়েকজন হাত-পা ভেঙে হল ছাড়তে বাধ্য হয়েছে। আমার কপালে তাই লেখা আছে না-কি? তাহলে দাঁতাল করিম আজ আমার উপর চরম প্রতিশোধ নেবে?তার বিরোধিতার প্রতিশোধ? 

৪০

মাথায় একটা বুদ্ধি আসলো। শেষ চেষ্টা হিসেবে এটাকে কাজে লাগানো যেতে পারে। যত যাই হোক জুমন ভাই জেলা সভাপতি। আর করিম শুধু মাত্র একটি হলের। দেখি তার দোহাই দিয়ে। বললাম, আমি এখন ছাদে যেতে পারবো না। শরীরটা খুব খারাপ। এতে তারা রেগে আরও দ্বিগুণজোরে দরজা ধাক্কাতে লাগলো। বললাম, 'জুমন ভাইয়ের সাথে কথা হয়েছে। সকাল বেলায় জুমন ভাই এসে করিম ভাইয়ের সাথে কথা বলবে। "

কথায় কাজ হলো। যেন জ্বলন্ত আগুনে পানি পড়েছে। সব চুপসে গেছে। টু শব্দটি না করে ধীরে ধীরে ওরা চলে গেল। 

৪১

বেচারা দাঁতাল করিম। আমি এখন যেন স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, দাঁতাল আলিম ছাদে বসে আছে। পাশে তার ক্যাডাররা। প্রত্যেকের হাতে লাঠি। আমাকে না মারতে পেরে করিম হতাশ। তার মুখ হাঁ হয়ে গেছে। সামনের বড় দাঁত দুটো শুড়ের মতো বেরিয়ে এসেছে।দাঁতে বাতাস লেগে গেলে কি শুকিয়ে যাচ্ছে। করিম বারবার জিভ দিয়ে  ভেজাবার চেষ্টা করছে। ক্লান্তিতে তার সাগরেদরা ঝিমাতে  শুরু করেছে। করিম দাঁত বের করে হতাশ হয়ে বসে আছ। মাথার ওপর তার চাঁদহীন  রাতের ফাঁকা খোলা আকাশ। 

৪২# # #

ভেবেছিলাম রাশমিনের  সাথে এ জীবনে আর দেখা হবে না। দেখা হলেও কথা হবে না। হয়তো সে আমাকে এড়িয়ে যাবে। কপাল ভালো বলতে হবে, ভালো না মহাভালো। পরীক্ষার দিন দেখা হয়ে গেল। কি সৌভাগ! 

সেই হাসি হাসি চোখ, হাজারো কথার ছুটোছুটি, চঞ্চল স্থিরতা। দাঁড়িয়ে আছি আব্দুল হাই কলা ভবনের সামনে। পরীক্ষার্থীর পরীক্ষা দিয়ে বের হতে শুরু করেছে। পরীক্ষার্থীকে আমি সুনিবিড় পর্যবেক্ষণে রেখেছি।  দোতলা তিনতলার দিকে নজর বুলিয়ে নিয়ে গেটের দিকে নজর রাখছি।সবার প্রতি দৃষ্টি দিচ্ছি না। দিচ্ছি শুধু বোরকা ওয়ালীদের দিকে।  এ এক মহাযজ্ঞ। ১০০ জন মেয়ের ভিতর ৯০ জন মেয়েই বোরকা পরা 

৪৩

হঠাৎ দেশে  বোরকার সংখ্যা জ্যামিতিক হারে বেড়ে গেছে। এখন নিজের বউ পাশ দিয়ে হেঁটে গেলেও কেউ ভালো করে খেয়াল না করলে চিনতে পারবে না। পুরুষের জন্য অসুবিধা হলেও মেয়েদের জন্য খুব সুবিধা হয়েছে। কিছু করার জন্য বোরকা খুবই নিরাপদ গোপন নিরাপদ আশ্রয়। এত বোরকার আড়ালে কোথায় যে রাশমিন আছে খুঁজে বের  করা মুশকিল। তবে একটা সুবিধা আছে। সব রঙের বোরকা পর্যবেক্ষণ করছি না।। শুধু কালো রংএর বোরকা পর্যবেক্ষণ করছি। অবশ্যই  কালো রঙের বোরকার সংখ্যায় বেশি। আমার স্পষ্ট মনে আছে, রাশমিন কালো রঙের বোরকা পরেছিল  সেদিন। সেদিন কালো রঙের বোরকা পরেছিল বলে যে আজও কালো রঙের বোরকা পরবে তার কোন মানে নেই। 

৪৪

তবুও আমার বিশ্বাস কালো রঙের  বোরকাতেই আমার কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তি মিলবে।কালো রঙের   বোরকা যদি সে পরে থাকে তাহলে হাজার বোরকার ভিড়েও আমি তাকে চিনি নেব। তার বোরকা  গেঞ্জির কাপড়ের তৈরি।সবকিছু স্মৃতিপটে   নিখুঁতভাবে গেঁথে নিয়েছি।তার হাঁটার প্রতিটি ছন্দ আমার এক দেখায় মুখস্ত হয়ে গেছে।   রাশমিন হাটলে হাঁটার সময় তার বাম কোমরে মাঝে মাঝে একটু ভাজ পড়ে। বোরকার টানটা  থাকে বাম কোমরের দিকে। কিছুই  ভুলিনি আমি। 

সেই কখন থেকে দাঁড়িয়ে আছি। দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে পায়ে ব্যাথা হয়ে গেছে।কত মেয়ে  সামনে দিয়ে বেরিয়ে গেল।কোথাও ভুল  হয়নি তো আমার?মনের ভিতর সন্দেহ  মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। 

৪৫

ধৈর্যেরাও বিদ্রোহ শুরু করেছে।হতাশা গ্রাস করতে চাচ্ছে। কিন্তু হেরে গেলে তো হবে না। তবু কোথায় সে?হয়তো সে  পরীক্ষা দিতে আসেনি।এমনি  জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ফরম তুলেছে।তার  এসএসসির রেজাল্ট খুবই ভালো।হয়তো  ইন্টারের ইমপ্রুভ নিয়ে ব্যস্ত আছে।সাইন্স  গ্রুপের তো অনেক ঝামেলা। প্রাকটিক্যাল টেল প্রাকটিক্যাল ট্যাল  আছে। সেতো  খুবই ভালো ছাত্রী।এসএসসি   পর্যন্ত সমস্ত ক্লাসের সে ফার্স্ট ছিল। এতো ভালো ছাত্রী জাতীয়  বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা না দেওয়াটাই খুব স্বাভাবিক। এখানে পরীক্ষা দিতে আসাটাই তো অস্বাভাবিক। হয়তো  কোন বিশ্ববিদ্যালয় তার চান্স হয়ে গেছে। আজ যে এখানে পরীক্ষা আছে সে কথা হয়তো সেই ভুলেই গেছে। 

৪৬

অথবা যদি সে এসেও থাকে পরীক্ষা দিয়ে হয়তো কোন ফাঁকে   বেরিয়ে গেছে। হাজারো হয়তো মনের মাঝে সন্দেহের   ডালপালা মেলে আমাকে ভেঙে চুরে, চুমরে ভেঙে   গুঁড়ো গুঁড়ো করছে। মন দোলনার মত দুলছে। আর চুরচুর করে ঝরে যাচ্ছে। তবু ক্ষীণ  আশায় বুক বেঁধে অবিচলতা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। যদি কোন ক্রমে দেখা হয়ে যায়। খড়ের গাদা থেকে সূচ খুঁজে বের করার মত অবস্থা।  হাজার হাজার ছেলেমেয়ে গেট দিয়ে স্রোতের মতো বের হয়ে যাচ্ছে। গেটের মুখে বটের ঝুরির মতো জটলা।তবু  দেখা যাক। যদি দেখা হয়।আর কিছু  নয় শুধু দেখা। এক পলক। হঠাৎ ঘাড়ে একটা থাপ্পড় পড়লো। তাকিয়ে দেখি, তৌফিক। 

৪৭

তৌফিক-কিরে  এত ডাকছি, বধির  হয়েছিস,  না বোবা?

তুষার -  বোবাও নয়, বধিরও নয়- বিটপি। বুঝলি গাছ।তুই আবার কখন ডাকলি? 

তৌফিক-  কমছে কম  ১০০০ ডাক দিয়েছি।  স্ট্যাচুর মতো দাঁড়িয়ে আছিস।কি চিন্তা করছিলি  বল?

 তুষার- আরে না।  এমনি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ফুলবাগান দেখছি। কলা ভবনের নিচে কত ফুল ফুটেছে দেখ। 

তৌফিক - আগুনের ভিতর দাঁড়িয়ে কেউ গোলাপ ফুল দেখেনা। সর্ষেফুল দেখে। তুই কোনটা দেখছিস? 

৪৮

তুষার - আমি সরষেও দেখছি না, সর্ষের ফুলও দেখছি না। দেখছি গোবর। 

 তৌফিক-কোথায়? 

তুষার- তোর মাথায়। 

তৌফিক, - পাগল রা কত কিছু দেখে।তোর কপালে  দুঃখ আছে। শালা। 

কথা বলতে বলতে তৌফিক দাঁড়িয়ে থাকা রিক্সায় যেয়ে উঠলো।রিকশায়  শুধু সে  একা নয়। আগে থেকেই তার বান্ধবী জনা  বুক ফুলিয়ে বসে আছে। 

তুষার - তোর কপালে তো দেখছি সুখের সীমা নেই। 

তৌফিক -  সে বিচার তোকে করতে হবে না।সন্ধ্যায়  দড়াটানায় আবুলের চায়ের দোকানে আয়। কথা আছে। 

৪৯

জনা আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো।আমিও  মুচকি হেসে তার হাসির জবাব দিলাম।

ইদানিং  দেখছি তৌফিক রাত দিন জনার সাথে লেগে আছে। হোটেলে, ম্যাচে, সর্বত্র জনা- তৌফিক। মেসে  একই লেপের তলায় তাদের মাঝে মাঝে আবিষ্কার করি। এক মাস আগেও তৌফিককে রেখার সাথে সব জায়গাতে দেখা যেত। তার আগে ছিল পপি। এখন দেখছি জনা। অবশ্য রেখা পপি কেউ যে তৌফিকের দিকে হা করে চেয়ে বসে আছে তা নয়।তারাও  অন্যজনের গলায় ঝুলে গেছে।কে আর অতীত নিয়ে পড়ে থাকতে চায়। 

 তৌফিক আর জনা চলে গেল। আমি রোদের ভেতর কারেন্টের পিলারের মতো আবার শক্ত অবস্থান নিলাম। পরীক্ষার্থী নেমে এসেছে।

৫০

আমি আশা ছেড়ে দিয়েছি।আজ  আর দেখা হলো না। বাদাম ওয়ালার  সাথে ১০০ গ্রাম বাদাম কেনার জন্য দরকষাকষি শুরু করেছি।পাশ থেকে  একটি মেইল কন্ঠ আমাকে আহবান করল- তুষার ভাই। 

আমি চমকে  উঠলাম। এ যে বহুল  প্রত্যাশিত সেই আহ্বান। এযে স্বয়ং রাশমিনের কণ্ঠস্বর। বোরকার ফাঁকে সেই চোখ।তাকিয়ে দেখি বোরখার ফাঁকে সেই চোখ হাসছে।  হাজারো কথার প্রান   চোখ দুটিতে ছোটা ছুটি করছে।

যাকে  দেখার জন্য, যার সাথে কথা বলার জন্য-  এত দীর্ঘ সময় এত কষ্ট স্বীকার করলাম, দ্বিধাদ্বন্দ্বের চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে প্রত্যাশা পূরণের সমভূমিতে এসে সমস্ত ফসলের বীজ  যেন আমার হারিয়ে গেছে।অথচ  এইতো উপযুক্ত সময়। দেরি

Comments

    Please login to post comment. Login