মিসেস মানস্টির জানালা থেকে যে দৃশ্য দেখা যেত, তা বিশেষ চমকপ্রদ না হলেও তার কাছে এটি অপরূপ সৌন্দর্যে ভরা ছিল। তিনি নিউইয়র্কের একটি বোর্ডিংহাউসের তৃতীয় তলার পিছনের একটি ঘরে থাকতেন। সেই রাস্তায় যেখানে পুরনো আশ-ব্যারেলগুলো ফুটপাতেই পড়ে থাকত, আর ফুটপাথের ফাটলগুলো এতটাই গভীর ছিল যে সেগুলো দেখলে যেকোনো মানুষ বিস্মিত হতো।
তিনি ছিলেন একটি বড় পাইকারি দোকানের কেরানির বিধবা স্ত্রী। স্বামীর মৃত্যুর পর তিনি একা পড়েন, কারণ তাদের একমাত্র মেয়ে ক্যালিফোর্নিয়ায় বিয়ে করে সেখানেই বসবাস করত। নিউইয়র্কের এত দূরত্ব মেয়ের পক্ষে মাকে নিয়মিত দেখতে আসা সম্ভব ছিল না। মিসেস মানস্টে চাইলেই পশ্চিমে মেয়ের কাছে চলে যেতে পারতেন, কিন্তু তারা এত বছর ধরে আলাদা ছিলেন যে উভয়েই একে অপরের সঙ্গের প্রয়োজনীয়তা কম বোধ করতেন। তাদের মধ্যে শুধুমাত্র কয়েকটি আনুষ্ঠানিক চিঠি আদান-প্রদান হতো, যা মেয়ের উদাসীনতায় ভরা থাকত আর মিসেস মানস্টে লিখতেন কষ্ট করে, কারণ তার ডান হাত বাতের কারণে শক্ত হয়ে উঠছিল।
মিসেস মানস্টের দিনের সবচেয়ে বড় আনন্দ ছিল তার জানালা থেকে বাইরের দৃশ্য দেখতে পাওয়া। তিনি তার ঘরের তিনটি জানালা থেকে যে সামান্য দৃশ্য দেখতে পেতেন, তার প্রতিটি ইঞ্চি তার কাছে পরিচিত ছিল। সামনের দিকের দুটি জানালা থেকে তিনি প্রতিবেশীদের বাড়ির পিছনের অংশগুলো দেখতে পেতেন - সেখানে ফুলের টব, কাঠের বারান্দা, মাঝে মাঝে কোনো মহিলা কাপড় শুকাতে দিতেন বা জানালা মুছতেন। কিন্তু তার প্রিয় দৃশ্য ছিল পাশের জানালা থেকে - সেখান থেকে তিনি একটি ছোট বাগানের অংশ এবং একটি উইলো গাছ দেখতে পেতেন, যার পাতাগুলো মৌসুম অনুসারে রং বদলাত।
বছরের প্রতিটি ঋতুতে এই দৃশ্যের পরিবর্তন তাকে গভীরভাবে আনন্দ দিত। বসন্তে যখন উইলো গাছে কচি পাতা গজাত, গ্রীষ্মে যখন প্রতিবেশীর বাগানের গোলাপ ফুটত, শরতে যখন পাতাগুলো বেগুনি ও সোনালি হয়ে যেত - সবই তিনি মুগ্ধ হয়ে দেখতেন। শীতকালেও যখন তুষারপাত হতো এবং সবকিছু সাদা চাদরে ঢেকে যেত, তখনো তিনি জানালায় বসে সেই দৃশ্য উপভোগ করতেন।
একদিন একটি ভয়ানক খবর শুনলেন মিসেস মানস্টে। পাশের বাড়ির মালিক বাড়িটি ভেঙে সেখানে একটি নতুন অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিং তৈরি করতে যাচ্ছে। এই নতুন ভবনটি তার প্রিয় দৃশ্য সম্পূর্ণরূপে ঢেকে দেবে।
এই সংবাদটি মিসেস মানস্টেকে গভীরভাবে হতাশ করল। তিনি বুঝতে পারলেন, শীঘ্রই তার জীবনের একমাত্র আনন্দটি চিরতরে চলে যাবে। তিনি এতটাই হতাশ হয়ে পড়লেন যে তার স্বাস্থ্যের অবনতি হতে শুরু করল।
একদিন তিনি সাহস করে পাশের বাড়ির মালিকের সাথে দেখা করলেন এবং তাকে অনুরোধ করলেন নতুন ভবনটি একটু পিছনে সরিয়ে তৈরি করতে, যাতে তার দৃশ্য অবরুদ্ধ না হয়। কিন্তু বাড়ির মালিক তার আবেদন উপেক্ষা করলেন - এত বড় শহরে একজন বৃদ্ধার এমন ছোটখাটো আবেগের কোনো মূল্য নেই তার কাছে।
মিসেস মানস্টে হতাশ হয়ে বাড়ি ফিরলেন। কয়েকদিন পরই যখন নির্মাণকাজ শুরু হলো এবং প্রথম দেয়ালটি উঠতে দেখলেন যা ধীরে ধীরে তার প্রিয় উইলো গাছকে ঢেকে দিচ্ছিল, তখন তিনি একটি চরম সিদ্ধান্ত নিলেন।
একটি ঝড়ো রাতে, যখন সবাই ঘুমিয়ে ছিল, মিসেস মানস্টে নিজের জীবনবিমুখ এক কাজ করলেন। পরের দিন সকালে তাকে মৃত অবস্থায় পাওয়া গেল। ডাক্তাররা বললেন, বার্ধক্যজনিত কারণেই তার মৃত্যু হয়েছে।
কিন্তু বোর্ডিংহাউসের মালিক জানতেন, আসল কারণটা কী। নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার পর যখন নতুন ভবনটি মিসেস মানস্টির জানালার সমস্ত দৃশ্য সম্পূর্ণরূপে ঢেকে দিল, তখন সবাই বুঝতে পারল - মিসেস মানস্টে শুধু একটি দৃশ্য হারাননি,তিনি তার জীবনেরই মূল অর্থ বা আসল অর্থ হারিয়ে ফেলেছিলেন।