পোস্টস

গল্প

নীরার সমুদ্র দেখা

৩ জুন ২০২৪

Labiba Erom

মূল লেখক লাবিবা ইরম

হঠাৎ করে ঠিক করলাম স্ত্রী নীরাকে নিয়ে কক্সবাজার যাবো৷ সমুদ্র আমার বিশেষ পছন্দের না। তবে নীরার ভীষণ পছন্দের৷ ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে মেয়েটি কখনো সমুদ্র দেখেনি৷ তার জীবনে সে ঘরের বাইরে "ট্যুর" বা বেড়াতে যাওয়া বলতে স্কুল থেকে একবারই জেলার মধ্যের একটি পিকনিক স্পটে গিয়েছিলো।

নীরাদের পরিবারকে মধ্যবিত্ত বলা যায় না, নিম্ন মধ্যবিত্ত বলে আখ্যা দেয়া যায়৷ আমার শ্বশুর একজন তৃতীয় শ্রেণীর সরকারী কর্মকর্তা হওয়া স্বত্তেও ওদের আর্থিক অবস্থা খুব বেশি ভালো ছিলো না। নীরাদের ভাইবোন সংখ্যা ৮ জন। এটিও তার একটা বড় কারন। এ যুগে এসে এত সন্তান সাধারণত কেউ নেয় না তবে একটি ছেলের আশায় পর পর সাতটি মেয়ে হয় আমার শ্বশুর শাশুড়ির। ৮ম সন্তান ছেলে হওয়ার পর শ্বশুরের মনে হয় তার পরিবার পূর্ণ হয়েছে। তবে আমার শ্বশুর ছেলে মেয়েকে আলাদা করে দেখবেন বা ছেলেকে বেশি গুরুত্ব দিবেন এ ধরনের মানুষ নন। তিনি তার বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান ছিলেন। এ আক্ষেপ থেকেও তিনি আল্লাহর কাছে অনেকগুলো সন্তানের দাবী করতেন। আল্লাহ তার দোয়া শুনেছেন এবং সাতটি কন্যা ও একটি পুত্রসন্তান দান করেছেন তাকে।

আমার শাশুড়ি একজন নিতান্ত সাধাসিধে মানুষ। প্রচুর হাসেন এবং অত্যন্ত অমায়িক।তাছাড়া অভাবের সংসার টানতে টানতে সহ্যশক্তি প্রবল তার। তবে দুনিয়ার কোন প্যাঁচঘোচ তার মাঝে নেই। আমার স্ত্রী নীরার মাঝেও আমার শাশুড়ির সারল্য খুব বেশি। চাহিদাও কম, শান্ত স্বভাবের। ভাইবোন দের মধ্যে সে চতুর্থ।

নীরাদের তুলনায় আর্থিক দিক থেকে আমরা বেশ স্বচ্ছল। আমাদেরকে বড়লোক আখ্যা না দিলেও মধ্যবিত্ত বলে থামিয়ে রাখার সুযোগ নেই। আমার ব্যবসায়ী বাবা দুটি সাততলা বাড়ি তুলে ফেলেছেন, এখন গ্রামের বাড়িতে চারতলা বাড়ি করে বসবাসের জন্য তোড়জোড় চালাচ্ছেন। আমরা দুটো ভাই৷ বিয়ে থা করে সংসারে আর বাবার বিভিন্ন ব্যবসার কাজে লেগে পড়েছি। আমার মা গত হয়েছেন দু' বছর হলো। মা ই নীরার সাথে আমার বিয়ে দেন। বাবা খুব একটা রাজি ছিলেন না ওদের পরিবারের অবস্থা দেখে। তবে নীরার সারল্য, সবার প্রতি মায়া দেখে দেখে আস্তে আস্তে বাবাও নীরাকে বেশ ভালোবাসেন। তাছাড়া আমাদের কোন বোন না থাকায় বাবা দুই বউয়ের মাঝে নিজের মেয়ের ছায়া খুঁজে বেড়ান।

আমার বড় ভাই নিজের পছন্দে বিয়ে করেছিলেন, প্রথম দিকে ভাবী এইজন্য বেশ আড়ষ্ট থাকতেন কারন বাবা খুব রাগ দেখাতেন। আস্তে আস্তে সবাই মিলেমিশে গিয়েছি। বাবা আপাতত গ্রামের বাড়ি আছেন,যেহেতু বাড়ির কাজ হচ্ছে। এমনি তে বাবা দুই ভাইয়ের বাসায় পালা করে থাকছেন গত দু বছর। মা থাকতে অবশ্য নিজেরা এক ফ্লাটে থাকতেন।
যাই হোক, সাংসারিক ঝামেলা বা এটা সেটা, মায়ের অসুস্থতা সব মিলিয়ে নীরাকে নিয়ে বিয়ের পর আমি ঠিক কোথাও যাইনি। হয়তো দাওয়াত বা আশেপাশে কোথাও পর্যন্তই যাওয়া হয়েছে।

আমাদের বিয়ের পাঁচ বছর হলো তবে এখনো কোন সন্তানের মুখ আমরা দেখিনি। ডাক্তারের কাছে দৌড়াদৌড়ির পর জানা গেলো হয়তো কখনো আমাদের সন্তান হবেনা, সমস্যাটা আমার।
এ খবরটি জানার পর নীরা আমার হাত শক্ত করে ধরেছিলো। আমার মা সহ আমার চাচী, ফুপুরা এতদিন নীরাকে অনেক কথা শুনিয়েছে৷ যদিও কখনো নীরা আমার কাছে নালিশ করেনি তবে আমি শুনেছি বা দেখেছি নিজেই। ডাক্তারের কাছে শোনার পর এ অত্যাচার থেকে নীরা রেহাই পেল যদিও, তবে আমার মনে হলো হয়তো ওর মাঝে এটি নিয়ে আক্ষেপ আছে।

মেয়েরা যেমন ধরনের স্বামী বা সঙ্গী খোঁজে আমি ঠিক সেমন নই। বরং আমার নিজেকে একটু রোবট মনে হয়। আসলে আমি কখনো মেয়েদের নিয়ে ভাবিনি। আকর্ষণ বোধ করিনি এমন নয় তবে রোমান্টিকতা বা ঠিক কিভাবে এগুলো করতে হয় আমি জানিনা। আর নীরার যে স্বভাব তাতে সে নিতান্তই প্রয়োজন না পড়লে কোন জিনিস চায় না। শখের কোন কথা কখনো বলেনা।

নীরার যে সমুদ্র প্রিয় এটিও আমি জেনেছি অদ্ভুতভাবে। একদিন খবর দেখছিলাম টিভিতে, নীরা সাধারণত টিভিও দেখে না। অবসরে সেলাই করে বা এটা সেটা বানায়। সেদিন কক্সবাজারের উপর একটি খবর দেখাচ্ছিলো, নীরা সেটা শুনে কেন যেন ভেতরের ঘর থেকে এসে ড্রইং রুমে সোফায় বসলো। হাতে সেলাইয়ের ফ্রেম। তার খুব আগ্রহ নিয়ে বড় বড় চোখ করে কক্সবাজারের ভিডিও দেখতে থাকলো। আমি খেয়াল করে বললাম,

"কি ব্যাপার নীরা?এই খবর দেখছো যে এত আগ্রহ নিয়ে?"

-"আমার সমুদ্র দেখতে অনেক ভালো লাগে জানেন! আমি কখনো সামনাসামনি সমুদ্র দেখিনি। শুধু ভিডিও আর টিভিতেই দেখেছি!"

নীরা খানিকটা বাচ্চা মানুষের মত খুশি খুশি গলায় বললো। ঠিক সেই মুহুর্তে আমি আবিষ্কার করলাম যে, এই মেয়েটার সাথে দীর্ঘ ৫ বছর বসবাস করেও আমি ঠিক জানিনা এই মেয়েটাকে। আমি কখনো শুনিনি সে কি ভালোবাসে, তার কি শখ, কোন খাবারটা তার প্রিয়, কোন খাবারটা তার ভালোই লাগে না, তার প্রিয় রঙ কি....

আমি কখনো জিজ্ঞেস করিনি, আর নীরাও কখনো বলেনি। তবে আমার ব্যাপারে সে জেনে নিয়েছে, জিজ্ঞেস করেছে, খেয়াল করেছে। আমার প্রিয় রঙ, প্রিয় খাবার, পছন্দ অপছন্দ সবই সে দেখে রেখেছে।

সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে নীরাকে বললাম

"ব্যাগ গোছাও নীরা, আমরা বাইরে যাবো।"

নীরা বেশ অবাক হয়ে বললো,
-"কোথায় যাবো? বাড়ি? বাবা সুস্থ আছেন? কোন কিছু হয়েছে নাকি?"

আমি একটু হেসে বললাম,
"সব ঠিক আছে, আমরা ঘুরতে যাবো। বিয়ের তো পাঁচটা বছর হলো, ঘুরতেও তো যাইনি কোথাও, তুমিও কখনো বলোনি..."

নীরা খানিকটা হতভম্ব হয়ে বললো,
-"কো..কোথায় যাবো ঘুরতে?"

"সমুদ্রে, কক্সবাজার!" বলে কক্সবাজারে যাওয়ার টিকিট দুইটা দেখালাম।

নীরা শুধু যে অবাক হলো তা-ই না, রীতিমতো ওর হাত পা কাঁপতে লাগলো। ও কাঁপা কাঁপা হাতে টিকিট দু'টো নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখলো যেন বিশ্বাসই করতে পারছেনা।

দুইদিন দেখতে দেখতে কেটে গেলো। ব্যাগ গোছাতে যেতে দেখা গেলো নীরার আসলে তেমন কিছু নেই, কারন ও প্রয়োজনীয় জিনিস ছাড়া তেমন কিছু চায় না, আমিও শখ করে দিইনি কিছু কিনে। তবে এবার দিলাম। মনে ভরে শপিং করে দিলাম, বড় ভাবী শপিং এ হেল্প করলেন। নীরা শুধু বড় বড় চোখ করে শপিং দেখলো আর এতকিছু কেন লাগবে সেই হিসেব কষতে লাগলো।

নির্দিষ্ট দিনে আমরা রওনা হলাম কক্সবাজার। নীরা এত আনন্দিত, এত খুশি যে বাচ্চাদের মত করে আনন্দ প্রকাশ করতে থাকলো। আমিও ওকে প্রাণ ভরে দেখতে দিলাম, খাবার কিনলাম, খেলাম। আমি লক্ষ্য করলাম নীরা স্ট্রীট ফুড খেতে খুব পছন্দ করে। বিশেষ করে একটু বেশি ঝাল দেয়া ঝালমুড়ি, ফুচকা এসব। প্রথমে একটু লজ্জা পেল এসব খাবার কিনে দিতে বলবে নাকি ভেবে, পরে আস্তে আস্তে এতদিনের লজ্জা ভেঙে নিজেই বললো আমাকে এটা কিনে দেন, ওটা খাবো। আমারও বেশ আনন্দ লাগলো ওর সাথে এসব কিনে খেতে। কেমন যেন মনে হচ্ছিলো আমি এক কিশোর ছেলে আমার কিশোরী প্রেমিকাকে নিয়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে সমুদ্রে যাচ্ছি।

কক্সবাজার পৌছে হোটেলে উঠেই এক মুহুর্তও দেরি না করে সমুদ্রের দিকে দৌড় দিলাম। নীরা যেন আসলেই একটা কিশোরী হয়ে উঠলো। আনন্দ ঠিকরে বের হতে লাগলো ওর চোখেমুখে। আমার দিকে তাকালেই লজ্জা পেয়ে যাচ্ছিলো। আমি ওকে আস্বস্ত করতেই যেন ওর মাঝে লুকিয়ে থাকা সেই কিশোরী মেয়েটি আর বাঁধা শুনলো না।

ঘোরাঘুরির মাঝে নীরা হিসেবের খাতা কলম নিয়ে বসছিলো,
আমি থামিয়ে দিয়ে বললাম,

"নীরা, সবকিছু কি হিসেব করে হয়? মাঝে মাঝে হিসেবের বাইরে যেতে হয়। এই যে দিনগুলো, এগুলো হয়তো আর আসবেনা৷ আসো এগুলোকে এনজয় করি। এসব হিসেব বাদ দাও তো। আল্লাহর রহমতে কম নেই তো আমাদের!"

নীরা একটু অপ্রস্তুত হয়ে গেলো। আসলে নীরা সারাজীবন দেখে এসেছে হিসেবের সংসার, তাই হিসেব ছাড়া চলতে পারেনা৷ তবে সে বুঝে গেলো। আর হিসেবের ধার ধারলো না। বাচ্চাদের মত আমার কাছে আবদার করে এটা ওটা চাইতেও থাকলো। জীবনে প্রথম আমি আবিষ্কার করলাম যে এই মেয়েটার আবদার মেটানোতেও একটা অদ্ভুত আনন্দ কাজ করছে আমার মাঝে।

সাতদিনের বেড়ানোর মাঝে তিন দিনের মাথায় হঠাৎ করেই আবহাওয়া খারাপ হতে লাগলো। সমুদ্রে উঠলো উত্তাল ঝড়। ৯ নম্বর বিপদ সংকেত। আমরা আটকা পড়ে গেলাম হোটেল রুমে। আমাদের হোটেল টা সমুদ্রের দিকে, ঘর থেকে সমুদ্র দেখা যায়। রাতে কারেন্ট চলে গেলো, ভীষণ বাতাস, সমুদ্রে গর্জন। সারারাত আমি আর নীরা একজন আরেকজন কে ধরে বসে থাকলাম। সকাল হতে পরিস্থিতি ঠান্ডা হতে শুরু করলো।

দুপুর আসতে না আসতেই সমুদ্র আবার আগের মত নীরব, যেন গতাকাল রাতে কিছুই হয়নি। যদিও বিপদ সংকেত ছিলো, তবুও লোকজন ধীরে ধীরে আবার সমুদ্রের কাছে যেতে শুরু করলো।

নীরাও বায়না ধরলো, 
-"চলেন আমরা সমুদ্রের কাছে যাই!"

"আরে তুমি পাগল হলে? এখনো বিপদ সংকেত উঠিয়ে নেয়নি, এখনও বিপদ আসতে পারে!"

-"আরে দেখেন না, সবাই যাচ্ছে। কিছু হবেনা। আর হওয়ার আগে তো টের পাবোই! আবার কবে না কবে আসতে পারবো, চলেই তো যাবো, চলেন না যাই সমুদ্রের কাছে!"

নীরার ছেলেমানুষী আবদার ফেলতে পারলাম না। দু'জনে ধীরে ধীরে সমুদ্রে ধারে গেলাম আবার। অনেক মানুষ ততক্ষনে জড় হয়েছে৷ সবকিছু স্বাভাবিক। অবশ্য মাইকে একটু পর পর স্বেচ্ছাসেবীরা সাবধান করছে। নীরা মন্ত্রমুগ্ধের মত আবার সমুদ্রের মাঝে হাঁটাহাঁটি করছে। আমি নীরার হাত শক্ত করে ধরে রেখেছি। পানি এসে আমাদের পা ভিজিয়ে দিচ্ছে।

হঠাৎ একটা বড় ঢেউ আসলো। বিশাল তোড়ে, এতটা বেশি যে আমার হাত থেকে নীরার হাত ছিটকে গেলো। এরপরের ঢেউ আরো বড়, নীরাকে আর দেখতে পেলাম না। এদিকে স্বেচ্ছাসেবীরা এসে আমাকে জাপ্টে ধরে ফেললো। আমি নীরার নাম ধরে চিৎকার দিতে থাকলাম। শান্ত সমুদ্র কোন পূর্বাভাস ছাড়াই আবার গর্জে উঠলো। নীরাকে আর দেখতেই পেলাম না।
সেই ঝড় থামলো পরেরদিন সকালে। স্বেচ্ছাসেবক সহ আরো সকলে মিলে ১৩ টি লাশ উদ্ধার করলো। তার মাঝে একটি ছিলো নীরার। নীরার নীরব নিথর শরীরটা দেখে আমার পুরো পৃথিবী দুলে উঠলো। যার জন্য সমুদ্রে আসলাম তাকে সমুদ্রেই রেখে যেতে হলো।

নীরার সমুদ্র অনেক পছন্দের ছিলো। আমার সমুদ্র পছন্দ নয়।

নীরার সমুদ্র দেখা
-লাবিবা ইরম
২৭।০৫।২৪

(দেশের বিভিন্ন জায়গায় ঝড় হচ্ছে, আল্লাহ সবাইকে হেফাজত করুন এর থেকে৷ অনেকে সমুদ্রে ঝড় দেখতে যায়, এটা অনেক বড় রিস্কের ব্যাপার। আমার মনে হয় না জেনেশুনে এ ধরনের জীবনের রিস্ক নেয়ার প্রয়োজন আছে। সবাই নিরাপদে থাকুন, সাবধানে থাকুন।)