লৌকিক জীবনের জার্নি শেষে বারজাখ তথা কবরে প্রত্যেক মানুষকে তিনটি প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে। এই প্রশ্ন করার জন্য ফেরেশতা ‘মুনকার-নাকির’ দায়িত্বপ্রাপ্ত থাকবেন। কবরের তিনটি প্রশ্ন আরবিতে এভাবে হবে: ‘মান রাব্বুকা? ওয়া মা দ্বীনুকা? ওয়া মান নাবিয়্যুকা?’ অর্থাৎ ‘তোমার রব কে? তোমার দ্বীন-ধর্ম কী? তোমার নবী কে?’ এবং এটা হলো ইসলামিজমের অন্যতম বড় শিক্ষা। জ্ঞানচক্ষু উন্মীলনের পরই মোটের ওপর এই পাঠগুলো আমাদের সবারই জানা। তাহলে সিরাজগঞ্জের দাদির কী হলো যে, এই উত্তর না দিতে পেরে তিনি নিজের নাতির হাতে প্রাণ খোয়ালেন? বাস্তবতা হলো রাত দুপুরে হঠাৎ ঘুম থেকে জেগে দেশিয় অস্ত্র হাতে নাতির চণ্ডমূর্তি দেখে তিনি ভড়কে গিয়েছিলেন।
সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ার চকবরুভেংড়ী গ্রামে ৮৫ বছরের এক দাদির শিরশ্ছেদ করেছে তারই নাতি। কারণ দাদি 'তোমার রব কে? -এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেননি। প্রশ্নটা ছিল বিশ্বাসের, উত্তর না দিতে পারাটা যুক্তির। কিন্তু ফল হলো মৃত্যুর। এই ঘটনাটি কোনো বিচ্ছিন্ন উন্মাদ যুবকের অপরাধ নয়; এটি এক গভীর সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিক বিপর্যয়ের প্রতিচ্ছবি। যুবক সজিব আলী মোল্লা, যিনি তার স্বজনদের বয়ানে সম্প্রতি 'অপ্রকৃতস্থ' হয়ে পড়েছিলেন, সম্ভবত ভুগছিলেন ধর্মীয় বিভ্রমজনিত সিজোফ্রেনিয়ায় -যেখানে মানুষ মনে করে, সে ঈশ্বরের দূত বা ঈশ্বরের পক্ষ থেকে বিচার করার দায়িত্বপ্রাপ্ত। সজিবের মস্তিষ্কে বাস্তবতা ও ধর্মীয় কল্পনা একাকার হয়ে গেছে। এ এক ভয়ংকর মানসিক রোগ -যা ধর্ম দিয়ে শুরু হলেও শেষ হয় পাগলামি, মানসিক বিকার ও প্রতিহিংসায়।
বাংলাদেশের আজকের যুবসমাজের এক বড় অংশ নিজের বিদ্যাশিক্ষা ও যুক্তিবোধের বাইরে এসে ধর্মীয় বিধানাবলী শিখতে চায় ইউটিউব শর্টস, ফেসবুক রিলস বা টিকটকে চটুল বয়ান থেকে। সেখানে ধর্ম নয়, ধর্মের উত্তেজনা ও অপব্যাখ্যাই বেশি শেখানো হয়। এক মিনিটের টানটান উত্তেজনাপূর্ণ ভিডিওতে ‘কাফের’, ‘জাহান্নামি’, -এই শব্দগুলো ভয়, ঘৃণা ও বিভাজনের নেশা জাগায়। এক শ্রেণির মৌলভি এই ভয়কে পুঁজি করে তৈরি করেছে একধরনের ধর্ম-ইকোনমি, যেখানে যত ভয় দেখানো যায়, তত অনুসারী বাড়ে। যুবকরা শেখে না পরমতসহিষ্ণুতা, ঔদার্য, সহনশীলতা বা আত্মসমালোচনা; তারা শেখে বিচার করা, শত্রু চিহ্নিত করা। ধর্মচর্চা নয়, ধর্মান্ধতার প্রদর্শনই হয়ে ওঠে তাদের আত্মতৃপ্তির মাধ্যম।
মনোবিজ্ঞানের ভাষায় এটিকে বলা হয় Delusional Reinforcement -যেখানে মানুষ যত বেশি ধর্মীয় বক্তব্য শোনে, ততই সে নিজের বিকৃত ধারণাকে ‘ঈশ্বরপ্রদত্ত সত্য’ মনে করে। এই অবস্থায় তার মস্তিষ্কে ডোপামিন নিঃসরণ বেড়ে যায়; ধর্মীয় উন্মাদনা তখন মাদক ক্যাপ্টাগনের মতো কাজ করে। ফলে মানব মস্তিষ্কে বাস্তবতা থেকে বিচ্যুতি, যুক্তির লোপ এবং হঠাৎ সহিংসতা দেখা দেয়। এই মানসিক বিভ্রমে মানুষ এমন কাজ করতে পারে, যা জেগে থাকা অবস্থায় কখনোই করত না।
সজিব আলীর 'রব কে?' প্রশ্নটি আসলে বিশ্বাসের নয়, বরং গভীর মানসিক নিরাপত্তাহীনতা, আত্মপরিচয়ের সঙ্কট ও বিচ্ছিন্নতার বহিঃপ্রকাশ। যে প্রজন্ম সঠিক শিক্ষা, সংস্কৃতি ও নৈতিক দিকনির্দেশনা পায়নি, সে ঈশ্বরকে খুঁজে বেড়ায় ভয় দিয়ে, ভালোবাসা দিয়ে নয়। দাদির শিরশ্ছেদ তাই এক প্রতীকী আত্মহত্যা -যেখানে নাতি আসলে নিজের মানবিকতাকেই নির্মম ও নির্দয়ভাবে হত্যা করেছে।
আমরা দীর্ঘদিন ধরে ধর্মীয় উগ্রতাকে 'বিশ্বাসের স্বাধীনতা' হিসেবে রক্ষা করে চলেছি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধর্মতত্ত্বের নামে চিন্তা ও প্রশ্ন করার স্বাধীনতা বন্ধ করেছি। বিজ্ঞানমনস্কতাকে পাপ বলে গণ্য করা হচ্ছে। যেখানে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতে নামে যে কাউকে যখন তখন হত্যাযোগ্য করে তোলা যায়। বস্তুত আমাদের সামষ্টিক এই নীরব প্রশ্রয়ই একশ্রেণীর দুর্বলচিত্তের মানুষের মধ্যে উন্মাদনা ও মনোবিকারকে প্রশ্রয় দিয়েছে।
এই পরিস্থিতি থেকে মুক্তির পথ জটিল হলেও অসম্ভব নয়। আমাদের শিক্ষা ও ধর্মচর্চায় মনোবিজ্ঞানের পাঠ সংযোজন জরুরি -শিশুকে বুঝাতে হবে, ঈশ্বর ভয় নয়, ভালোবাসার প্রতীক। সোশ্যাল মিডিয়ায় বিভ্রান্তিকর ধর্মীয় কনটেন্টের কঠোর নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন। পরিবারকে সচেতন হতে হবে -ধর্মীয় উন্মাদনা শুরু হয় নীরব প্রশ্রয় থেকে। সংস্কৃতি, সাহিত্য, সঙ্গীত, শিল্প, চারুকলা, সুকুমারবৃত্তি, বিজ্ঞানচর্চা ও খেলাধুলাকে হতে হবে মানসিক ভারসাম্যহীনতা থেকে মুক্তির আসল আশ্রয়।
যে নাতি দাদিকে জিজ্ঞেস করেছিল 'তোমার রব কে?', সে জানে না -তার নিজের রব কোনো ঠুনকো প্রশ্নমালায় সীমাবদ্ধ নয়, বরং অসীম অতুল্য এক সত্তা। তাঁর নাম না নিলেও তিনি কারো খাবার পানি হাওয়া বন্ধ করে দেন না।
একটি প্রজন্মের মনে যখন ভালোবাসার জায়গা দখল করে ভয়, ঘৃণা ও প্রতিশোধের অদম্য স্পৃহা, তখন ঈশ্বরের অহিংস ধর্মটাই চরমতম হিংস্রতায় পর্যবসিত হয়। এই ভয় থেকে মুক্ত হতে হবে মানবতা পুনরুদ্ধারের মহতি উদ্যোগে।
লেখক: সাংবাদিক
২৩ অক্টোবর ২০২৫
192
View