দেশের অনেক পলিটিক্যাল লিডার কোনো এক প্রত্যন্ত এলাকার বাজারের বটগাছের গোড়ায় দাঁড়িয়ে লাউড স্পিকারে ঘোষণা দেন -আমরা খুব শিগগিরই দারিদ্র্যকে মিউজিয়ামে পাঠাতে চলেছি। দেশটা সিঙ্গাপুর হতে আর দেরি নাই। এগুলো যে সবই কথার কথা একটু চোখ কান খোলা রাখলেই সবারই অনুধাবন করবার কথা।
বাংলাদেশে গত তিন বছরে দারিদ্র্যের হার বেড়ে এখন দাঁড়িয়েছে ২৭ দশমিক ৯৩ শতাংশে। ২০২২ সালে এই হার ছিল ১৮ দশমিক সাত শতাংশ। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) তাদের এক গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করেছে।
অপরদিকে দেশের ১৯.২ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্য সীমার নিচে বসবাস করছে বলে গেল জানুয়ারিতে জানায় বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)। এর মধ্যে শহরে দারিদ্র্যের হার সাড়ে ১৬ শতাংশ এবং গ্রামে সেই হার ২০ শতাংশের বেশি বলে জানায় সংস্থাটি।
ধনী তথা এলিট সমাজ কি সত্যিই দারিদ্র্য দূর করতে চায়? নাকি তারা এই অবস্থাকে জিইয়ে রাখে নিজেদের স্বার্থে? বাস্তবতা হলো -দারিদ্র্য কোনো দুর্ঘটনা নয়, এটি ক্ষমতাশালী শ্রেণির নির্মিত এক কৌশলগত স্ট্রাকচার।
পুঁজিবাদী অর্থনীতি গরিবদের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। ধনীরা এই শ্রেণিকে বিলুপ্ত করতে চায় না; বরং এদের ওপর নির্ভর করেই তাদের লাভের সাম্রাজ্য টিকিয়ে রাখে।
রাজনীতিতে দারিদ্র্য এক প্রকার নিয়ন্ত্রণের অস্ত্র। গরিব মানুষ ভয় পায় -চাকরি হারানোর, রেশন বন্ধ হয়ে যাওয়ার, বা ভাতার তালিকা থেকে নাম বাদ পড়ার। এই ভয়ই তাকে আজ্ঞাবহ করে তোলে। শাসকগোষ্ঠী তাই দারিদ্র্য দূর করে না, বরং কৌশলগতভাবে জিইয়ে রাখে, যেন জনগণ চিরকাল নির্ভরশীল থাকে রাষ্ট্র ও দলের দয়ার ওপর।
সমাজবিন্যাসে নিচের স্তর না থাকলে ওপরের স্তরের মহিমাও অর্থহীন হয়ে পড়ে। বিলাসিতা, অভিজাত ক্লাব, এক্সক্লুসিভ শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা -এসবের অর্থই তখন মুছে যাবে। তাই দারিদ্র্য কেবল অর্থনৈতিক নয়, এটি যেন একটি সামাজিক প্রয়োজন -যাতে সমাজের শ্রেণিভেদ ও উচ্চতাবোধ টিকে থাকে।
এলিট শ্রেণি দারিদ্র্যকে উপস্থাপন করে ব্যক্তিগত ব্যর্থতা হিসেবে -যেন কেউ গরিব কারণ সে অলস, অযোগ্য বা দুর্ভাগা। এভাবে তারা কাঠামোগত শোষণকে আড়াল করে দেয়। স্কুলের বই, ধর্মীয় উপদেশ, পত্রিকার কলাম, টেলিভিশনের প্রোগ্রাম -সব জায়গায় ঢুকিয়ে দেওয়া হয় এই যোগ্যতার মিথ: 'যে পরিশ্রমী, সে উপরে উঠবে।' কিন্তু প্রশ্ন হলো -যার জন্মই হয়েছে প্রান্তিকতার মধ্যে, সে উঠবে কোন সিঁড়ি বেয়ে?
এলিট সমাজ আবার দারিদ্র্যকে ব্যবহার করে নিজেদের নৈতিক পরিশোধনের জন্য। তারা দান করে, ট্রাস্ট গড়ে, এনজিও চালায় -যেন নিজের অপরাধবোধকে ধুয়ে ফেলা যায়। এই দান আসলে অনেকটাই শোষণের রক্তচিহ্ন মুছে ফেলবার পারফিউমের মতো।
তারা দারিদ্র্য দূর করে না, বরং মানবিক মুখে তাকে পোষ মানায়। এতে তাদের অর্থনৈতিক অন্যায় পবিত্রতার আচ্ছাদন পায়।
হাডুডু খেলার তরিকা মেনে অন্যকে দাবিয়ে রাখবার মতো আমাদের এই সমাজ মোটেই দারিদ্র্যকে নির্মূল করতে চায় না, সে আসলে যেনতেনভাবে নিজের ক্ষমতা কাঠামোকেই টিকিয়ে রাখবার প্রয়াসী।
কাজেই গরীবের সান্ত্বনা ঘুরেফিরে ওই কবি কাজী নজরুল:
হে দারিদ্র্য, তুমি মোরে করেছ মহান
তুমি মোরে দানিয়াছ খ্রীস্টের সম্মান।
ফারদিন ফেরদৌস
২৫ অক্টোবর ২০২৫