Posts

গল্প

গল্প: হিরার হোটেল

October 27, 2025

আহমেদ সাব্বির

Original Author আহমেদ সাব্বির

142
View

হিরার হোটেল

আহমেদ সাব্বির

আমতলার মোড়ে হীরার খিঁচুড়ি বেশ সুস্বাদু। একপ্লেট খিঁচুড়ি, সঙ্গে মচমচে ডিমভাজা মাত্র চল্লিশ টাকা। ধোঁয়াওঠা খিঁচুড়ির চাক ভাঙলে মুরগির মাংসের দুই একটা কুচি আঙুলে উঠে আসে। সকাল আটটা বাজতেই হীরা ধোঁয়াওঠা খিঁচুড়ি নিয়ে হাজির হয়। ধীরে ধীরে দিনমজুর, রিকশাঅলা, শিক্ষক আর অফিসের কর্মীরা এসে ভিড় করে। ঘন্টা খানেকের মধ্যেই ডেক খালি হয়ে যায়। 

শফিক সাহেব হীরার হোটেলে আসেন চা খেতে। দীর্ঘদেহী, ফর্সা, মথায় কাচাপাকা চুল। বয়স ষাটের কাছে। চাকরি আর বেশি দিন নাই। চা খেতে খেতে তিনি উদাস ভঙ্গিতে তাকিয়ে থাকেন। এই হোটেলের ছাউনিটা তার বড় ভালো লাগে। পরিচ্ছন্ন আর খেলামেলা। এখান থেকে ত্রিমুখী মোড়ের ভিউটা ভাল করে ধরা দেয়। মোটা ফ্রেমের চশমায় ভেসে ওঠে মফস্বলের খন্ডচিত্র। কত গাড়ি, রিকশা-বাইক সাঁ-সাঁ করে ছুটছে। কত লোকজন আসছে যাচ্ছে। সবচেয়ে বেশি ভাল লাগে স্কুলগামী ছোট ছোট শিশুদের। মায়ের হাত ধরে কেমন পুট পুট করে গল্প করতে স্কুলে যায়। কখনো বাবার সঙ্গে ঝগড়া করতে করতে যায়। সেদিন বাবার কাঁধে চড়া এক শিশুকে দেখে বড় ভাল লাগল। বাবার মাথার উপর একটা চিপসের প্যাকেট ধরে বসে আছে মেয়েটি। চিপস তুলে তুলে খাচ্ছে আর গল্প করছে। দৃশ্যটা দেখে শফিক সাহেব মুগ্ধ হলেন। মনে হলো সম্রাট আকবর যেন হাতীর পিঠে ভ্রমণে বেরিয়েছেন। হাতীটার সঙ্গে সম্রাট কথা বলছেন আর হাতী দুই কান দুলিয়ে দুলিয়ে পথ চলছে।

পথচারীদের ছুটেচলা দেখতে দেখতে চা শেষ হয় যায়। মাঝে মধ্যে খিঁচুড়িও খান তিনি। হীরা প্লেট সাজিয়ে এক চামচ চালতার আচার দিয়ে হাতে ধরিয়ে দেয়- ‘মামা খান’। হীরার সঙ্গে মামা-ভাগ্নে সম্পর্ক। মেয়েটা এমন মায়া করে খাওয়ায়, না বলতে পারেন না।   

সেদিনও শফিক সাহেব হোটেলে এসে বসলেন। মনটা বেশ ফুরফুরে। ‘হীরাম্মা একটা চা দিস’ বলতেই হীরা কয়েকটা নারকেলের নাড়ু মুঠোয় গুঁজে দিল।

 ‘মামা আগে এটা খান। তারপর চা দেই।’

শফিক সাহেব অবাক হলেন। 

‘কী ব্যাপার! অসময়ে এই দুর্লভ দ্রব্য কোথায় পেলি?’

‘মামা কালকে রাতে ছেলেরা বলল নাড়ু খাবে। তাই বানিয়েছিলাম। এগুলো আপনার জন্য নিয়ে এসেছি।’

অনেক বছর পর নারকেলের নাড়ু পেয়ে শফিক সাহেব শৈশবে ফিরে গেলেন। নানীর গোপন বৈয়াম থেকে নাড়ু চুরি করে ধরা পড়ার গল্প হীরা কে শুনিয়ে শিশুর মতো হেসে উঠলেন। 

‘বাহ্! অপূর্ব স্বাদ। আমাকে একদিন বেশি করে নাড়ু বানিয়ে দিস। আতপচাল, গুড়, নারকেল আমিই কিনে দেব।’

‘ঠিক আছে মামা দেবনে।’

শফিক সাহেব ঘড়ি দেখলেন। দশটা বাজে। অফিসের অনেক কাজ পড়ে আছে। তিনি তড়িঘড়ি উঠে পড়লেন। হীরা হোটেল সামলাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। চায়ের দাম মিটিয়ে পথে নামবেন এমন সময় পিছন থেকে একটা হাত তার বাম হাতটা খপ করে ধরে ফেলল। ছোট্ট হাতের নরম তুলতুলে আঙুল। শফিক সাহেব পিছন ফিরে দেখলেন- হিজাব পরা একটা পিচ্চি মেয়ে। ফুটফুটে মুখ, ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে আছে। মেয়েটি বলল- ‘আংকেল আমারে এট্টু খিঁচুড়ি কিনে দেবেন? খাব।’

শফিকে সাহেব মেয়েটির মাথায় হাত রাখলেন। ‘কী নাম গো মা তোমার?’

আমার নাম সাদিয়া। ক্লাস ওয়ানে পাড়ি। আপনি সেই আংকেল। আমি চিনতি পারিছি। 

কোন আংকেল বলো তো! আমাকে আগে কখনো দেখেছো?

‘হ্যা কতবার। থানার মোড়ে একটা চায়ের দোকানে।’ 

শফিক সাহেবের আজকাল কিছু মনে থাকে না। চলার পথে কত চেনা মানুষ সালাম দেয়। হ্যান্ডশেক করে। তিনি তাদের নাম মনে করতে পারেন না। লজ্জায় পড়ে যান। 

সাদিয়াকে দেখে শফিক সাহেব কিছুক্ষণ চিন্তা করলেন। চেনা চেনা মনে হলো মেয়েটাকে। কিন্তু কোথায় দেখেছেন মনে করতে পারলেন না। লজ্জিত ভঙ্গিতে বললেন- ‘হ্যা একটু একটু মনে হয় চিনতে পেরেছি। তোমার বাসা কোথায় যেন…’

না, চিনতে পারলেন না তো। আমাদের বাড়ি কুমিরায় আংকেল। 

সাদিয়ার স্মার্ট চাহনি আর চটপটে কথাবার্তায় হীরাও মুগ্ধ হলো।

শফিক সাহেব হীরাকে খিঁচুড়ি আর ডিমভাজা দিতে বললেন। 

তুমি কোথায় পড়াশুনা করো?

‘কুমিরা মাদ্রাসায়। পাঁচ রোল।’ 

সাদিয়ার কথায় তিনি মজা পেলেন। কিন্তু কোথায় দেখেছেন মনে করতে পারলেন না। 

‘তুমি খিঁচুড়ি এখানে বসে খাবে?’

‘না আংকেল। সঙ্গে আব্বা-মা আছে।’ 

‘ওনারা কোথায়?’

‘ওই যে রাস্তার ওপারে। সাদিয়া আঙুল উঁচু করল। 'ওই যে... দেখেতে পাচ্ছেন?’ 

‘কই না তো। ওনাদের এখানে ডেকে আনো না হয়।’

‘ওই তো ওপারে। গাছের নিচে। আপনি চোখে দেখেন না নাকি।’ 

শফিক সাহেব হেসে উঠেলেন। ‘বয়স হয়েছে তো। চোখ ঝাপসা হয়ে থাকে।’ 

‘দেখেন ওই যে আব্বা, হুইল চেয়ারে বসা আর মা পিছনে দাঁড়ায়ে।’ 

শফিক সাহেব এবার সাদিয়াকে চিনতে পারলেন। জড়িয়ে ধরে বললেন- ‘হ্যাঁ এবার চিনতে পেরেছি। এতদিন তুমি কোথায় ছিলে মা। তোমাকে কতদিন পরে দেখলাম।’

হীরা খিুঁচড়ি প্যাকেট করে দিয়েছে। সঙ্গে কয়েকটা সাগর কলা। 

প্যাকেট হাতে পেয়ে সাদিয়ার চোখ দুটো চকচক করে উঠল। মনে হলো পৃথিবীর সব খুশি প্যাকেটে ভরে ওর হাতে তুলে দেয়া হয়েছে। 

সাদিয়ার সঙ্গে প্রথম দেখা হয় কয়েক মাস আগে। সেদিন ছিল শনিবার, দুপুরবেলা। সেলুন থেকে বাসায় ফেরার সময় শফিক সাহেব থানার মোড়ের একটা দোকানে চা খাচ্ছিলেন। হঠাৎ দেখলেন রাস্তার ওপারে একটা হুইল চেয়ারে বসে আছে একজন মধ্যবসয়ী লোক। পিছনে ফুটফুটে সুন্দর একটা মেয়ে। মেয়েটি বাবার সঙ্গে গল্প করছে আর হুইল চেয়ার ঠেলতে ঠেলতে পথ চলছে। শ্যামলা মুখ। পরনে নীল ফ্রক। মাথা ভার্তি লম্বা চুল। তুলতুলে পা ক্লান্তিহীন। চোখে চোখ পড়তেই তিনি মেয়েটাকে হাত ইশারায় ডাকলেন। বললেন- তুমি কিছু খাবে?

মেয়েট বলল- ‘খাতি পারি। তবে আমার কাছে কলাম টাকা নেই।’ 

‘না না টাকা লাগবে না। আমিই কিনে দেব। কি খাবে বলো?’

‘একটা বনরুটি কিনে দেন তাইলি।’ 

শফিক সাহেব মেয়েটিকে সেদিন রুটি আর কলা কিনে দিয়ে বললেন- ‘এখন থেকে এদিকে এলে তোমার যা খেতে মনে চায় খেয়ে যাবে।’ তিনি দোকনদারকে বলে দিলেন- ‘ও এলে যা খেতে চায় দিও। আমি টাকা দিয়ে দেব।’ 

তারপর আর দেখ হয় নি। মাঝে মধ্যে দোকানদার শফিক সাহেবকে বলত- 'মেয়েটি এসেছিল। খাবার নিয়ে গেছে।' শফিক সাহেব টাকা দিয়ে দিয়ে দিতেন। 

আজ তিনি সাদিয়াকে প্রথম দেখায় চিনতে পরলেন না। এ কয়েক মাসে একটু বড় হয়ে গেছে। সেই সাথে হিজাব পরেছে বলে চিনতে দেরি হলো। সাদিয়াকে দেখে শফিক সাহেবের বুকটা হু-হু করে উঠল। নিজে বৈয়াম খুলে একমুঠো চকলেট দিলেন। বললেন- এখন থেকে যখনই আসবে হীরার সঙ্গে দেখা করবে। তোমার যা খেতে মন চায় নিয়ে যাবে। 

সাদিয়া শফিক সাহেবের হাত জড়িয়ে ধরল। বলল- ‘আংকেল আসেন না। আব্বা-মা’র সঙ্গে দেখা করায়ে দেই। আপনি খুব ভাল।’ 

হাত ধরে টানতে লাগল সাদিয়া। হীরা পাথরের মতো দাঁড়িয়ে দেখছিল। শফিক সাহেব বললেন- ‘না গো মা। আজ থাক।’ আরেকদিন হবে।’

হীরা বলল- ‘যান না মামা, এত করে যখন বলছে।’

শফিক সাহেব দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। বললেন- ‘কীভাবে যাই বলো। আমার পা চলে না। ওরা কথাই চিন্তা করো। বাবার হুইলচেয়ার টানতেই ওর কত আনন্দ। রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে ঘুরে বাবাকে ঠেলতে ঠেলতে ও বড় হচ্ছে। এটাই ওর খেলা। অথচ ও এখনো বুঝতে শেখেনি পঙ্গু বাবা আর দুঃখীনি মায়ের সংগ্রাম। নিয়তি ওকে পথে নামিয়েছে।’

মা হাত ইশারায় সাদিয়াকে ডাক দিল। সাদিয়া তবু চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকল।

‘বড় আফসোস হয় সাদিয়ার জন্য। ওর শৈশবটা রঙিন হতে পারল না।’ 

শফিক সাহেব চোখ মুছতেই ফোন বেজে উঠল। তিনি পকেট থেকে ফোন বের করলেন। জরুরী কল। কিন্তু ধরলেন না, কেটে দিলেন। সাদিয়াকে দেখে তার হারিয়ে যাওয়া রাইসা’র কথা মনে পড়ে।  বছর দশেক আগে কথা। না বলেই চলে গেল মেয়েটা। বেঁচে থাকলে কত বড় হত। বাইকের সামনে বাসিয়ে প্রায়ই শহর ঘোরাতেন তিনি। মেয়েটি খুব আনন্দ পেত। ভিক্ষুক দেখলেই বলত- ‘এ্যাই আব্বু গাড়ি থামাও। চোখে দেখো না নাকি। দাও, বড় টাকা দাও।’

কর্তিক মাস। হঠাৎ একটা শীতল হওয়া শরীর ছুঁয়ে বয়ে গেল। সাদিয়া একছুটে রাস্তা পার হয়ে চলে গেল। শফিক সাহেবও পা বাড়ালেন অফিসের দিকে।

Comments

    Please login to post comment. Login