শ্যামবাজারের এক বড়লোকের ঘরে বহুদিন হইতেই শেখরের বিবাহের কথাবার্তা চলিতে ছিল সেদিন তাহারা দেখিতে আসিয়া আগামী মাঠের কোন একটা শুভ দিন স্থির করিয়া যাইতে চাহিয়া ছিলেন কিন্তু শেখরের জননী স্বীকার করিলেন না যে কে দিয়ে বলিয়া পাঠাইলেন ছেলে নিজে দেখিয়া পছন্দ করিলে তবে বিবাহ দেব
কিন্তু নবীন রায়ের চোখ ছিল শুধু টাকার দিকে তিনি গৃহিণী এই গোলমেলে কথার আসন্ন হইয়া বলিলেন এ আবার কি কথা? মেয়ে তো দেখাই আছে কথাবার্তা পাকা হয়ে যাক তারপরে আশীর্বাদ করার দিন ভালো করে দেখলেই হবে।
তথাপি গৃহিণী সম্মত হইলেন না পাকা কথা কহিতে দিলেন না নবীনরাই সেদিন রাগ করিয়া অনেক বেলায় আহার করিলেন এবং দিবানিদ্রাটা বাহিরের ঘরেই দিলেন
শেখর নাথ লোকটা কিছুটা সৌখিন সে তে তলায় যে ঘটিতে থাকে সেটি অতিশয় সুসজ্জিত দিন পাঁচ ছয় পরে একদিন অমান্য বেলায় সে সেই ঘরের বড় আয়নার সম্মুখে দাঁড়াইয়া মেয়ে দেখিতে যাইবার জন্য প্রস্তুত হইতেছিল ললিতা ঘরে ঢুকিল ক্ষণকাল নিঃশব্দে চাহিয়া থাকিয়া জিজ্ঞাসা করিল বউ দেখতে যাবে না শেখর ফিরিয়া চাহিয়া বলিল এই যে কই বেশ করে সাজিয়ে দাও দেখি বউ যাতে পছন্দ করে ললিতা হাসিল বলিলো এখন তো আমার সময় নেই সে করতা আমি টাকা নিতে এসেছি বলিয়া বালিশের তলা হইতে চাবি লইয়া একটা দিনাজ খুলিয়া গনিয়া গনিয়া গুটি কয়েক টাকা আচলে বাধিয়া লইয়া যেন কতটা নিজের মনেই বলিল টাকা তো দরকার হলেই নিয়ে যাচ্ছি কিন্তু এসব হবে কি করে শেখর চুলের একপাশ বুরুশ দিয়া উপরের দিকে তুলিয়া দিয়া ফিরিয়া দাঁড়াইয়া বলিল শোধ হবে,না হচ্ছে।
ললিতা বুঝিতে পারিল না চাহিয়া রহিল
শেখর বলিল চেয়ে রইল বুঝতে পারলে না ললিতা মাথা নাড়িয়ে বলিল না আর একটু বড় হও তখন বুঝতে পারবে বলি আর শেখর জুতা পায়ে দিয়া বাহির হইয়া গেল।
রাত্রে শেখর একটা কোচের উপর চুপ করিয়া শুয়েছিল মাসিয়া ঘরে ঢুকলেন সে তাড়াতাড়ি উঠিয়া বসিল মা একটা চোখের উপর বসিয়া পরিয়া বলিলেন মেয়ে কিরকম দেখে এলি রে?
শেখর মায়ের মুখের দিকে চাহিয়া হাসিয়া বলিল বেশ।
শেখরের মায়ের নাম ভুবনেশ্বরী প্রায় পঞ্চাশ এর কাছে আসিয়া ছিল কিন্তু এমনই সুন্দর তাহার দেহের বাঁধন যে দেখলে ৩৫ ৩৬ এর অধিক মনে হইত না।
আবার এই সুন্দর আবরণের মধ্যে যে মাতৃ হৃদয়টি ছিল তাহা আরও নবীন আরো কমল তিনি পায়রা গায়ের মেয়ে পারা গায়ে জন্মেয়া সেখানেই বড় হইয়াছিলেন বটে কিন্তু শহরের মধ্যে তাহাকে একদিনের জন্য বেমানান দেখায় নাই শহরের চাঞ্চল্য সচিবতা এবং আচার ব্যবহারও যেমন তিনি সচ্ছন্দে গ্রহণ করিতে পারিয়া ছিলেন, জন্মভূমির নিবিড় নিস্তব্ধতা ও মাধুর্য ও তেমনি হারাইয়া ফেলেন নাই এই মাটি যে শিকড়ের কত বড় গর্বের বস্তু ছিল সে কথা তাহার মাও জানেন না জগদীশ্বর শেখর কে অনেক বস্তু দিয়েছিলেন অনন্য সাধারণ স্বাস্থ্য রূপ ঐশ্বর্য বুদ্ধি কিন্তু এই জননের সন্তান হইতে পারার ভাগ্যটাকেই সে কায়মনে ভগবানের সবচেয়ে বড় দান বলিয়া মনে করিত।
মা বলিলেন বেশ বলে চুপ করে রইলি যে!
শেখর আবার হাসিয়ে মুখ নিচু করিয়া বলিল, যা জিজ্ঞেস করলে তাই তো বললুম ।
মা -ও হাসিলেন। বলিলেন কই বললি ? রং কেমন ফরসা?কার মত হবে আমাদের ললিতার মত?
শেখর মুখ তুলিয়া বলিল ললিতা তো কাল মা ওর চেয়ে ফরসা মুখ চোখ কেমন?
তাও মন্দ নয়।
তাবে কর্তাকে বলি
এবার শেখর চুপ করিয়া রহিল।
মা ক্ষনকাল পুত্রের মুখের দিকে চাহিয়া থাকিয়া হঠাৎ জিজ্ঞাসা করিয়া উঠিলেন হা রে মেয়েটি লেখাপড়া শিখেছে কেমন ?
শেখর বলিল সে তো জিজ্ঞাসা করিনি মা ।
অতিশয় আশ্চর্য হইয়া মা বলিলেন জিজ্ঞেস করিসনি কি রে? যেটা আজকাল তোদের সবচেয়ে দরকারী জিনিস সেটাই জেনে আসিস নি?
শেখর হাসিয়ে বলিলো না মা ও কথা আমার মনেই ছিল না। ছেলের কথা শুনিয়া এবার তিনি অতিশয় বিস্মিত হইয়া ক্ষণকাল তাহার মুখপানে চাহিয়া থাকিয়া হাসিয়া উঠিয়া বলিলেন তবে তুই ওখানে বিয়ে করবিনে দেখচি!
শেখর কি একটা বলিতে যাইতেছিল কিন্তু এই সময় ললিতাকে ঘরে ঢুকিতে দেখিয়া চুপ করিয়া গেল । ললিতা ধীরে ধীরে ভুবেনেশ্বরীর পেছনে আসিয়া দাড়াইলো।
তিনি বাঁ হাত দিয়া তাহাকে সম্মুখের দিকে টানিয়া নিয়া বলিলেন, কি মা?
ললিতা চুপিচুপি বলিল কিচ্ছু না মা।
ললিতা পূর্বে ইহাকে মাসি মা-বলিত। কিন্তু তিনি নিষেধ করিয়া দিয়া বলিয়াছিলেন , তোর আমি তো মাসি হইনি ললিতে, মা হই। তখন হতে সে মা বলিয়া ডাকিত। ভুবনেশ্বরী তাহাকে বুকের আরো কাছে টানিয়া লইয়া আদর করিয়া বলিলেন কিছু না তবে বুঝি আমাকে শুধু একবার দেখতে এসেছিস?
ললিতা চুপ করিয়া রহিল।
শেখর কহিল দেখতে এসেচে, রাধবে কখন?
মা বলিলেন, রাঁধবে কেন?
শেখর আশ্চর্য হইয়া জিজ্ঞেস করিল, কে তবে ওদের রাধবে মা?
ওর মামাও তো সেদিন বললেন ললিতায় রাধাপাড়া সব কাজ করবে।
মা হাসিয়া উঠিলেন। বলিলেন ওর মামার কি যা হোক একটা বললেই হল। ওর বিয়ে হয়নি ওর হাতে খাবে কে? আমাদের বামন ঠাকুরুনকে পাঠিয়ে দিয়েচি তিনি রাধবেন। বড় বৌমা আমাদের রান্নাবান্না করছচেন আমি দুপুর বেলা ওদের বাড়িতেই আজকাল খাই।
শেখর বুঝিল মা এই দুখী পরিবারের গুরুভার হাতে তুলিয়া লইয়াছেন সে একটা তৃপ্তির নিশ্বাস ফেলিয়া চুপ করিল।
মাস খাননেক পরে একদিন সন্ধ্যার পর শেখর নিজের ঘরে কোচের ওপর কাত হইয়া এক মনে ইংরেজি নোভেল পড়িতে ছিল । বেশ মন লাগিয়া গিয়াছিল, এমন সময় ললিতা ঘরে ঢুকিয়া বালিশের তলা হইতে চাবি লইয়া শব্দ সারা কোরিয়া বিরাজ খুলিতে লাগিল। শেখর মুখ না তুলিয়াই বলিল কি?
ললিতা বলিল টাকা নিচ্চি।
হু বলিয়া শেখর পড়িতে লাগিলো ।
ললিতা আঁচলে টাকা বাধিয়া উঠিয়া দাঁড়াইলো আজ সে সাজিয়া গুজিয়া আসিয়াছিল তাহার ইচ্ছা শেখর চাহিয়া দেখে। কহিল ১০ টাকা নিলুম শেখর দা।
শেখর আচ্ছা বলিল, কিন্তু চাহিয়া দেখিল না। অগত্যা সে এটা ওটা নাড়িতে লাগিল, কিন্তু কিছুতেই কোন ফল হইল না, তখন ধীরে ধীরে বাহির হইয়া গেল কিন্তু গেলেই তো চলে না, আবার তাহাকে ফিরিয়ে আসিয়া দূর করাই দাঁড়াতে হইল। আজ তাহারা থিয়েটার দেখিতে যাইবে।
শেখরের বিনা হুকুমে সে যে কোথাও যাইতে পারে না, ইহা সে জানিত।কেহই তাহাকে ইহা বলিয়া দেয় নাই, কিংবা কেন কি জন্য এসব তর্ক কোনদিন মনে ওঠে নাই। কিন্তু জীবমাত্ররই যে একটা স্বাভাবিক সহজ বুদ্ধি আছে ,সেই বুদ্ধি তাহাকে শিখাইয়া দিয়াছিল, অপরে যাহা ইচ্ছা করিতে পারে যেখানে খুশি যাইতে পারে ,কিন্তু সে পারেনা সে স্বাধীন নয় এবং মামা মামির অনুমতি তাহার পক্ষে যথেষ্ট নয়। সে দ্বারের অন্তরালে দাঁড়াইয়া আস্তে আস্তে বলিলো আমরা যে থিয়েটার দেখতে যাচ্চি।
তাহার মৃদুকন্ঠ শেখরের কানে গেল না -সে জবাব দিল না।
ললিতা তখন আরও একটু কলা চড়াইয়া বলিল সবাই আমার জন্য দাঁড়িয়ে রয়েছে যে এবার শেখর শনিতে পাইল বইখানা এক পাশে নামাইয়া রাখিয়া জিজ্ঞাসা করিল কি হয়েছে ললিতা একটুখানি দুষ্ট ভাবে বলিলো এতক্ষণে বুঝি কানে গেল আমরা থিয়েটারে যাচ্ছি যে
আমরা কারা?
আমি,আন্নাকালি,চারু ,আর চারুর মামা।
মামাটি কে?
ললিতা বলিল, তার নাম গিরিনবাবু।
পাঁচ - ছদিন হ'লো মুঙ্গরের বাড়ি থেকে এসেছেন ,এখানে বি,এ পড়বেন বেশ লোক সে-
বা: নাম ধাম পেশা দিব্যি আলাপ হয়ে গেছে দেখচি। তাতেই চার পাঁচ দিন মাথার টিকিটি পর্যন্ত দেখতে পাইনি তাস খেলা হচ্ছিল বোধ করি?
হঠাৎ শেখরের কথা বলার ধরন দেখিয়া ললিতা ভয় পাইয়া গেল। সে মনেও করে নাই এরূপ একটা প্রশ্ন উঠিতে পারে। সে চুপ করিয়া রহিল।
শেখর বলিল এ কদিন খুব তাশ চলছিল না?
ললিতা ঢোক গেলিয়া মৃদুস্বরে কহিল চারু বললে যে।
চারু বললে! কি বললে? বলিয়া শেখর মাথা তুলিয়া একবার চাহিয়া দেখিয়া কহিল একেবারে কাপড় পরে তৈরি হয়ে আসা হয়েছে আচ্ছা যাও।
ললিতা গেল না সেখানেই চুপ করিয়া দাঁড়াইয়া রহিল।
পাশের বাড়ির চারুকলা তাহার সমবয়সী এবং সই তাহারা ব্রাহ্মণ শেখর ওই গিরিনকে ছাড়া তাহাদের সকলকেই চিনিত। গিরিন পাঁচ সাত বছর পূর্বে কিছুদিনের জন্য একবার এদিকে আসিয়া ছিল।
এতদিন বাকিপুরে পড়ি তো কলিকাতায় আসিবার প্রয়োজন হয় নাই আসেও নাই। তাই শেখর তাহাকে চিনিত না ।ললিতা তথাপি দাঁড়াইয়া আছে দেখিয়া বলিল, মিছে দাঁড়িয়ে রইলে কেন যাও। বলিয়া মুখের সম্মুখে বই তুলিয়া লইল।
মিনিট পাঁচেক চুপ করিয়া থাকার পরে ললিতা আবার আস্তে আস্তে জিজ্ঞাসা করিল যাব?
যেতেই তো বললুম ললিতা ।
শেখরের ভাব দেখিয়া ললিতার থিয়েটার দেখিবার স্বাদ লোপ পাইলো কিন্তু তাহার না গেলেও যে নয় কথা হয়েছিল সে অর্ধেক খরচ দিবে এবং চারুর মামা অর্ধেক দিবে।
চারুদের ওখানে সকলেই তাহার জন্য অধীর হইয়া অপেক্ষা করিতেছে এবং যত বিলম্ব হইতেছে তাহাদের অধৈর্যও তত বারিতেছে ইহা সে চোখের উপর দেখিতে লাগিল কিন্তু উপায়ও খুঁজিয়া পাইলো না।
অনুমতি না পাইয়া যাইবে এত সাহস তাহার ছিল না ।আবার মিনিট দুই তিন নিঃশব্দে থাকিয়া বলিল ,শুধু আজকের দিনটি যাব ।
শেখর বইটা একপাশে ফেলিয়া দিয়া ধমকাইয়া উঠিলো বিরক্ত করো না ললিতা। যেতে ইচ্ছা হয় যাও, ভালো মন্দ বুঝবার তোমার যথেষ্ট বয়স হয়েচে।
ললিতা চমকিয়া উঠিল শেখরের কাছে বকুনি খাওয়া তাহার নতুন নহে অভ্যাস ছিল বটে কিন্তু দু-তিন বছরের মধ্যে এরকম শুনে নাই। ওদিকে বন্ধুরা অপেক্ষা করিয়া আছে, সেও কাপড় পরিয়া প্রস্তুত হইয়াছে, ইতিমধ্য টাকা আনিতে আসিয়া এই বিপত্তি ঘটিয়াছে।
এখন তাহাদের কাছে বা সে কি বলিবে?
কোথাও যাওয়া আসা সম্বন্ধে আজ পর্যন্ত তাহার শেখরের তরফ হইতে অবাধ স্বাধীনতা ছিল, সে জোরেই সে একেবারে কাপড় পরিয়া সাজিয়া আসিয়াছিল ,এখন শুধু যে সেই স্বাধীনতায় এমন রুঢ় ভাবে খর্ব হইয়া গেল তাহা নয় এজন্য হইল সে কারণটা যে কত বড় লজ্জার, তাহাই আজ তাহার ১৩ বছর বয়সে প্রথম উপলব্ধি করিয়া সে মরমে মরিয়া যাইতে লাগিল। অভিমানে চোখ অশ্রু পূর্ণ করিয়া সে আরও মিনিট পাঁচেক নিঃশব্দে দাঁড়াইয়া থাকিয়া নিজের ঘরে গেল। নিজের ঘরে গিয়া, ঝি কে দিয়া আন্না কালীকে ডাকাইয়া আনিয়া তাহার হাতে দশটা টাকা দিয়ে কহিল, তোরা আজ যা কালি ,আমার বড় অসুখ কচ্চে ,সই কে বল গে আমি যেতে পারব না।
কালী জিজ্ঞাসা করিল কি অসুখ সেজদী ?
মাথা ধরেছে গা বমি বমি করছে ভারি অসুখ করচে, বলিয়া সে বিছানায় পাশ ফিরিয়া শুইলো, তারপর চারু আসিয়া সাধাসাধি করিল, পীড়াপীড়ি করিল , মামীকে দিয়া সুপারিশ করাইলো, কিন্তু কিছুতেই তাহাকে রাজি করিতে পারিল না।
আন্না খালি হাতে দশটা টাকা পাইয়া যাইবার জন্য ছটফট করিতেছিল । পাছে এসব হাঙ্গামা পরিয়া যাওয়া না ঘটে, এই ভয়ে সে চারুকে আড়ালে ডাকিয়া টাকা দেখাইয়া বলিল সেজদির অসুখ করছে সে নাই গেল চারুদি, আমাকে টাকা দিয়েচে, এই দেখো আমরা যাই চলো ,চারু বুঝিল আন্নাকালি বয়সে ছোট হইলেও বুদ্ধিতে কাহারো খাটো নয় সে সম্মত হইয়া তাহাকে সঙ্গে করিয়া চলিয়া গেল।