Posts

চিন্তা

সাংবাদিকের স্বাধীনতা ও ক্ষমতার অস্বস্তি

October 28, 2025

ফারদিন ফেরদৌস

126
View

নিউইয়র্কের বাংলা গণমাধ্যম ঠিকানার প্রধান সম্পাদক সাংবাদিক খালেদ মুহিউদ্দীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এক আলোচনা সভায় বলেছেন, তিনি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাক্ষাৎকার নিতে চান। এমনকি সেই কারণে তিনি জেলে যেতেও প্রস্তুত। এই বক্তব্যে সরকারি মহলে অস্বস্তি তৈরি হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেছেন, ইন্টারভিউ নেন সমস্যা নাই, তবে শেখ হাসিনাকে সাবেক প্রধানমন্ত্রী বলা যাবে না; আর সেই ইন্টারভিউর মাধ্যমে একজন অপরাধীর প্রতি গণমানুষের মধ্যে সহানুভূতির জায়গা তৈরি করা যাবে না। 

প্রেস সচিব তাঁর সোশ্যাল হ্যান্ডেলে লিখেছেন, সমস্যাটা আসলে সাক্ষাৎকার নেওয়ায় নয়। বহু সাংবাদিক বিশ্বের সবচেয়ে ভয়ংকর সন্ত্রাসীদেরও সাক্ষাৎকার নিয়েছেন। কিন্তু তারা সবসময় পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দিয়েছেন, কাকে তারা কথা বলছেন। তারা কখনোই সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে সন্ত্রাসীদের আদর্শকে বৈধতা দেননি, কিংবা এমনভাবে উপস্থাপন করেননি যাতে তাদের প্রতি সহানুভূতি জন্মায় বা তাদের কণ্ঠ আরও জোরালো হয়। শেখ হাসিনার সাক্ষাৎকার নিতে চাওয়া যে কারও জন্য আসল প্রশ্নটা হলো: আপনি তাকে কীভাবে উপস্থাপন করবেন?' 

প্রশ্ন হলো -একজন সাংবাদিক কাকে কীভাবে সাক্ষাৎকার নেবেন, তা কি রাষ্ট্র নির্ধারণ করবে?
সাংবাদিকতার মূলনীতি বলছে -সত্য অনুসন্ধানের স্বাধীনতাই এই পেশার প্রাণশক্তি। সাংবাদিক কাকে প্রশ্ন করবেন, কোন বক্তব্য প্রকাশ করবেন, তা তাঁর সম্পাদকীয় স্বাধীনতার অংশ। 

জাতিসংঘের সাংস্কৃতিক সংস্থা ইউনেসকো (UNESCO), আন্তর্জাতিক সাংবাদিক ফেডারেশন (IFJ) বা আমেরিকার Society of Professional Journalists (SPJ)‌ -সবাই স্পষ্টভাবে বলেছে, 'Journalists must be free to seek truth and report it without fear or favor. অর্থাৎ সাংবাদিককে ভয় বা পক্ষপাত ছাড়া সত্য অনুসন্ধানের স্বাধীনতা' দিতে হবে।' 

অবশ্যই এ স্বাধীনতারও সীমা আছে। কোনো সাক্ষাৎকার যদি সহিংসতা উসকে দেয়, ঘৃণা ছড়ায় বা বিচারাধীন বিষয়ে প্রভাব ফেলে, সেটি আইনসম্মত নয়। কিন্তু কেবল একজন বিতর্কিত বা অভিযুক্ত ব্যক্তির সাক্ষাৎকার নেওয়া কোনো অপরাধ নয় -যদি সেটি তথ্যনির্ভর ও জনস্বার্থে হয়। 

বিশ্বজুড়ে বিবিসি, আল জাজিরা, নিউইয়র্ক টাইমস এমন অনেক সাক্ষাৎকার নিয়েছে, যেখানে যুদ্ধাপরাধী, সন্ত্রাসী বা বিতর্কিত রাজনীতিকের মুখোমুখি হয়েছে সাংবাদিকরা। উদ্দেশ্য ছিল ইতিহাসের নথি তৈরি করা, অপরাধীকে বৈধতা দেওয়া নয়। 

রাষ্ট্র যদি নির্ধারণ করে দেয় কাকে 'সাবেক প্রধানমন্ত্রী' বলা যাবে আর যাবে না, তাহলে সেটি মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ওপরে হস্তক্ষেপ। একটি রাষ্ট্রযন্ত্র সাংবাদিকের প্রশ্নের পরিধি নির্ধারণ করতে পারে না -যে রাষ্ট্র তা করতে চায়, সে আসলে নিজের অনিরাপত্তা প্রকাশ করে, কর্তৃত্ববাদ দেখায়। 

সাংবাদিক খালেদ মুহিউদ্দীন তাঁর পরের সভাতেই বিষয়টি পরিষ্কার করে দিয়েছেন যে, শেখ হাসিনা যদি সাবেক প্রধানমন্ত্রী না হন, তাহলে বর্তমান রাষ্ট্রপতিকে কে নিয়োগ দিয়েছে?

আদালত যদি শেখ হাসিনার অপরাধ প্রমাণ করেন, তদানুযায়ী তার সাজা হবে। কিন্তু শেখ হাসিনাকে মানুষের মন থেকে মুছে দিতে চাইলে তার চেয়ে অধিক ভালো কাজ আপনাদেরকে করে দেখাতে হবে বৈকি। আপনারাই নিজেদেরকে জাজ করেন, নেপোটিজম ও করাপশন করেছেন কিনা? নিজের ভাইবেরাদরদেরকে আলাদিনের পদ-পদবির আশ্চর্য প্রদীপ দিয়েছেন কিনা? বিদেশে অর্থ পাচার করেছেন কিনা? দেশকে অনিরাপদ করে তুলেছেন কিনা? কোনো একটি রাজনৈতিক দলকে বেশি সুবিধা দিতে অন্য দলগুলোর রাশ টেনে ধরছেন কিনা? দেশের গণমানুষের ঘরে এবং মনে শান্তি ফিরায়ে দিতে পেরেছেন কিনা? মানুষ স্বস্তি নিয়ে বলছে কিনা, আহা, এই সরকার যদি যুগের পর যুগ টিকে যেত! এসবের উত্তর যদি সবগুলোই ইতিবাচক হয় তাহলে একজন স্বাধীন সাংবাদিকের ইন্টারভিউকে আপনাদের ভয় পাওয়ার কী আছে? পরাজিত ও পলাতক একজন একনায়কের লেজেটিমেসি কিংবা নরমালাইজের প্রশ্নই বা কেন আসবে? আপনাদের অযথা অস্বস্তিই বা কেন হবে? 

খালেদ মুহিউদ্দীনের বক্তব্যের মূল সুর হলো -সাংবাদিকতার মূল শক্তি ক্ষমতার ভয় না পাওয়া এবং কঠোরভাবে ক্ষমতাকে জবাবদিহি করা। রাষ্ট্র অথবা ক্ষমতাবানরা যদি তাতে ভয় ঢুকিয়ে দিতে চায়, তখন গণমাধ্যম হয়ত ধুকে ধুকে টিকে থাকে, কিন্তু সাংবাদিকতা হারিয়ে যায় চিরতরে। 

লেখক: সাংবাদিক 
২৮ অক্টোবর ২০২৫
 

Comments

    Please login to post comment. Login