‘দেখুন আশে-পাশে দোকান থাকলে টাকাটা ভাঙিয়ে নিয়ে নিতাম।’
শ্রাবস্তী বিড়বিড় করে কী সব বললো। শোনা যাচ্ছে না কিছু। আমি মুখ ঘুড়িয়ে নিলাম। কচমচ করে তিলেখাজা ভেঙে শ্রাবস্তী মুখের ভেতর দিতে লাগলো। আমার উপরের রাগ বেচারা তিলেখাজার উপর শোধ তুলছে। বাঃ বেশ রাগ আছে তো শ্রাবস্তীর। আমি বাপু কেটে পড়ি। কী জানি, ওর সাথের লোকজন চলে আসলে আমাকে আলুভর্তা করে ছাড়বে। আমি শ্রাবস্তীর দিকে তাকাতেই চোখে-চোখ পড়লো। বুকের ভেতর যেন ভূমিকম্প শুরু হলো। নিজেকে স্বাভাবিক রেখে শ্রাবস্তীর ভাবকে উপেক্ষা করে ব্যাগটা হাতে নিতেই শ্রাবস্তী বলে উঠলো, ‘এই মিস্টার, এই যে।’
আমি কোনো কথা না বলে ট্রেন থেকে নিচে নেমে পড়লাম। শ্রাবস্তী ওর হাতের টাকা আমার দিকে ছুড়ে মাড়লো। আমার গতি যেন বেড়ে গেলো। আমি শ্রাবস্তীর দিকে আর তাকালাম না। টাকাটা জানালা দিয়ে আমার দিকে ছুরে মারতেই নিচে পড়ে গিয়েছিলো। আমি একটু এগিয়ে গিয়ে শ্রাবস্তীর দিকে তাকাতেই দেখি এক টোকাই টাকাটা তুলে নিয়ে দৌঁড় দিয়েছে। শ্রাবস্তী তাতে আরো বেশি রেগে গিয়েছে। ও ট্রেনের কামরা থেকে দ্রুত নেমে টোকাইয়ের দিকে পড়ে থাকা কী যেন খুঁজছে। খুঁজতে খুঁজতে কলার খোসা পেয়ে তাই ছেলেটির দিকে ছুরে মারতে লাগলো। আনন্দ করতে করতে টোকাই চলে গেলো বেশ দূরে। বেচারীর একশো টাকা খোয়া গেলো। ক্ষুধা নিবারণ করার জন্য কত কিছু না করতে হবে মানুষকে! শ্রাবস্তীর জন্য একটু খারাপ লাগলো।
সূর্যের আলো শ্রাবস্তীকে যেন আদর করতে লাগলো। দূর থেকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, শ্রাবস্তীর মুখটা লাল টক-টক করছে। এতো শান্তশিষ্ট মেয়ে শুধু আমারই জন্যেই পাগলীর মতো আচরণ করছে। আসলে ওর জন্য খুবই খারাপ লাগছে। আমার পানে তাকালো শ্রাবস্তী। বিড়বিড় করে কী যেন বলছে। শ্রাবস্তী কি যাদুমন্ত্র জানে ? না আমাকে বশ করার মন্ত্র পড়ছে ? আচ্ছা এতো কিছু ঘটে গেলো অথচ ওর লোকজন আসছে না কেন? তবে কি এখনো বাকি আছে আরো ঘঁনা ? না বাবা, আমি আর যাচ্ছি না শ্রাবস্তীর কাছে। ট্রেন যখন ছাড়বে শেষ মুহুর্তে কামরায় উঠবো এই গাছ তলায় নিরাপদ। পঞ্চাশ টাকার উপর দিয়েই যাক। আজীবন মনে থাকবে আজকের ঘটনা। আমার টাকায় কেনা কলায় শ্রাবস্তীর ক্ষুধা নিবারণ হয়েছে। নিশ্চয় শ্রাবস্তী অকৃতজ্ঞ নয়। সুন্দর চেহারা ও সুন্দর মন যার আছে, সে তার রাজ্যে সুন্দর এক মানুষ । আমার মনে হয় আমি যা ভাবছি তা ঠিক না। আবার ঠিক হতেও পারে।
শ্রাবস্তী ট্রেনের কামরায় উঠলো। নির্দিষ্ট আসনে বসলো।
নিজের সম্মন্ধে আমার একটা ধারণা আছে যে আমি ততটা খারাপ ছেলে না। নিজের প্রতি যার বিশ্বাস আছে, তাকে সহজে বুঝতে পারা যায় না। আমি হয়তো শ্রাবস্তীকে ঠিকভাবে বুঝতে পারছি না। দু’জনেই হয়তো ভুল করছি। এখনকার ঘটনায় দু’জনেরই দোষ আছে কম বেশি। প্রথমে কি আমিই দোষ করেছি! শ্রাবস্তী আমাকে তিলেখাজা খাওয়ার অনুরোধ করেছিল। আমি ভয়ে খাইনি। একা ছিলাম বলে হয়তো তিলেখাজা খাওয়ার অনুরোধ করেছিলো। কিন্তু আমি অন্যরকম ভেবেছিলাম। তবে কি আমার ব্যবহারের জন্য দুঃখ প্রকাশ করবো ? না তা হয় না। এমন করলে শ্রাবস্তী বেশিমাত্রায় আরো বেশি ভাব দেখাবে। যদি তেমন সুযোগ করে দেয়, তাহলে চেষ্টা করে দেখতে পারি। মনের ভেতর কত রকম পরিকল্পনা জাগছে। আমি শ্রাবস্তীর পানে তাকিয়ে আছি। আমার দিকে থেকে বিপরীত দিকে শ্রাবস্তীর নজর। শ্রাবস্তী ট্রেনের কামরায়, আমি কাঁঠাল গাছের তলায় দাঁড়িয়ে। আমি ভাবছি ওকে নিয়ে, কিন্তু ও কী ভাবছে ?
শ্রাবস্তী আমার দিকে তাকাবে হয়তো। হ্যাঁ তাকাবে। এখনই তাকাবে। ও আমার কথাই ভাবছে। হ্যাঁ , মনের ভেতর থেকে কে যেন বলছে, এখনই তাকাবে। ঘড়ি দেখা যাবে না। কোনো দিকে তাকানো যাবে না। যা হচ্ছে হয়ে যাক। আমি প্রস্তুত, চোখে-চোখ পড়বে। আহা! কী মজাই না হবে। অভিজ্ঞতা হবে শ্রাবস্তীর চোখের ভাষা থেকে। আমি নিশ্চিত কারণ অন্যায় করছি না। আমি মুক্ত, আমি পৃথিবীর সন্তান। ইচ্ছা করছে উচ্চস্বরে কবিতা আবৃত্তি করি, গান গাই কিন্তু পারি না। শ্রাবস্তীকে শোনানো হলো না। তবে একটু নৃত্য করি। নাÑতাও তো পারি না। শীস দিতেও পারি না। দরকার হয়নি। তাই শিখিনি। কেন যেন মনে হচ্ছে সব কিছু শেখা দরকার ছিলো।
অভিজ্ঞতা অর্জন করার জন্য প্রস্তুত হয়ে আছি। শ্রাবস্তী ওর মনের ব্যাকুলতা এখনই প্রকাশ করবে। অবাক হচ্ছি আমি নিজের কথা ভেবে। না এমন তো ছিলাম না আমি। আমার পরিচিত কোনো নারী বলতে পারবে না, তার সাথে আমি কখনো খারাপ ব্যবহার করেছি। শ্রাবস্তীর সাথে কী যেন হতে যাচ্ছে! না এতো কিছু ভাবা যাবে না। মানুষ সব সময় এক রকম থাকে ? আমার না হয় একটু পরিবর্তন হলো। হ্যাঁ তাকিয়ে আছি, শ্রাবস্তীর ডান হাত নড়ে উঠলো, চুলগুলোকে শাসন করলো। একটু নড়ে-চড়ে বসলো, আবেগময় চাহনিতে তাকালো। আবার মুখ ঘুরিয়ে নিলো। মুহুর্তে ভূমিকম্প হয়ে গেলো বুকের ভেতর। বুঝলাম, শ্রাবস্তীর সাথে এরকম খারাপ ব্যবহার করা ঠিক হয়নি।
শ্রাবস্তীর মনকে এখন কিছুটা বুঝতে পারছি আমি। শ্রাবস্তীর সম্মন্ধে যা ধারণা করেছি, তা সব ঠিক না। চোখের চাহনিতে নিজেকে দুর্বল বলে প্রকাশ করলো শ্রাবস্তী। আসলেই কি ও মনে-মনে দুঃখ প্রকাশ করছে। না আমি এখানে দাঁড়িয়ে আছি বলে উল্টো আমাকেই অন্যরকম ভাবছে। তাইতো! এখানে দাঁড়ানো ঠিক হচ্ছে না। তাছাড়া শ্রাবস্তীর সাথে আমার এমন কিই বা সম্পর্ক যে শ্রাবস্তীকে নিয়ে এতো ভাবতে হবে। লুকিয়ে লুকিয়ে দেখতে হবে। না, অন্যায় তো আমি করছি। শ্রাবস্তীর চোখের সামনের থেকে একটু দূরে সরে দাঁড়ালাম। মন থেকে আড়াল করতে পারবো না হয়তো। শ্রাবস্তীকে এখন আর দেখা যাচ্ছে না। আমাকেও শ্রাবস্তী দেখতে পাচ্ছে না হয়তো। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকি এই গাছতলায়। গাছটা ছোট। আদরের সহানুভূতির ছাযা বেশি জায়গা দখল করতে পারেনি। সূর্যের আলো শরীরের কিছু কিছু অংশে পরশ বুলিযে দিচ্ছে।
57
View