Posts

গল্প

যখন বৃষ্টি নামে

October 31, 2025

Mahima sultana

26
View

সিলেটের ছোট্ট একটি পাহাড়ি গ্রাম, মেঘে ঢাকা এক সন্ধ্যা। বাড়ি ফিরছিলেন সাজিদ। স্থানীয় একটি স্কুলে শিক্ষকতা করেন তিনি। হঠাৎই মেঘ করেছে দেখে, দ্রুত পা চালিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু প্রকৃতি তাঁর চেয়েও দ্রুতগামী। মুষড়ে পড়ল বৃষ্টি। নিকটেই একটি পুরনো মসজিদের চাতাল দেখে, সেই দিকে দৌড় দিলেন তিনি।

গিয়ে দেখেন, সেখানে আরও একজন দাঁড়িয়ে আছেন। একজন তরুণী, পরনে সরল একটা সালোয়ার-কামিজ, ভিজে চুলগুলো কপালে লেপ্টে আছে। সাজিদ তাঁকে চিনতে একটুও দেরি হয়নি। ইরা। গ্রামেরই মেয়ে, যাঁর পরিবার কয়েক বছর আগে ঢাকায় চলে গিয়েছিল। শুনেছিলেন, ইরা এখন একজন দক্ষ বেহালাবাদক।

"ভিজে গেছেন তো?" সাজিদ নিজেই কিছুটা ভিজে, অস্বস্তির সাথে জিজ্ঞেস করলেন।

ইরা হালকা একটা হাসলেন, "আপনিও তো।"

এটাই ছিল তাদের প্রথম সাক্ষাৎ, বহু বছর পর। এরপর থেকে, মসজিদের সেই চাতালটা যেন তাদের দেখা হওয়ার জায়গা হয়ে উঠল। কখনো সকালে, কখনো সন্ধ্যায়। কথা হতো না খুব বেশি। হয়তো শুধু একটা সালাম, কিংবা আবহাওয়া নিয়ে দু'কথা। কিন্তু চোখেই বলে দিত অনেক কিছু।

ইরা ফিরে এসেছিলেন নিজের ভেতরের একটা ক্লান্তি থেকে। ঢাকার ব্যস্ত, প্রতিযোগিতাময় জীবন তাঁকে ক্লান্ত করে দিয়েছিল। আর সাজিদ? তিনি রয়ে গিয়েছিলেন এই গ্রামেই, এক সুপ্ত বেদনা বুকে নিয়ে। কথিত আছে, একবার তাঁর খুব কাছের একজন মানুষ তাঁকে ছেড়ে চলে গিয়েছিল, শহরের মোহে।

ইরার বাড়ির ছাদে বসে তারা কথা বলত। সাজিদ গল্প করতেন তাঁর স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে, আর ইরা শোনাতেন শহরের নানা গল্প। ধীরে ধীরে, তাদের মধ্যে একটা বোঝাপড়া তৈরি হচ্ছিল। ইরা লক্ষ্য করতেন, সাজিদ যখন কথা বলেন, তাঁর চোখে একটা অদ্ভুত কোমলতা ফুটে ওঠে। আর সাজিদ দেখতেন, ইরার মুখে যখন একটা হালকা হাসি ফুটত, সেটা যেন পুরো বিকেলটাকে আলোকিত করে দিত।

একদিন ইরা তাঁর বেহালা বাজালেন সাজিদের জন্য। সুরটা ছিল করুণ, মর্মস্পর্শী। বাজানো শেষ হলে, সাজিদ কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর বললেন, "এই সুরটা শুনলে মনে হয়, তোমার ভেতরের সব কষ্ট বেরিয়ে এসে বাতাসে মিশে যাচ্ছে।"

ইরা অবাক হয়ে তাকালেন। কেউ তো কখনও তাঁর বাজনা এভাবে বুঝতে পারেনি।

আরেকদিন, সাজিদ ইরাকে নিয়ে গেলেন গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে চলা এক ছোট্ট নদীর ধারে। সেখানে একটা পুরনো বটগাছ ছিল, যার নিচে গ্রামের বয়োজ্যেষ্ঠরা গল্প করে। তিনি তাঁর জীবনের সেই বেদনাদায়ক গল্পটি ইরাকে বললেন। বললেন কীভাবে প্রেমিকা তাঁকে ছেড়ে চলে গিয়েছিল, আর তিনি এই গ্রামেই থেকে গিয়েছিলেন, তাঁর শিক্ষকতা আর সাধারণ জীবনকে আঁকড়ে ধরে।

ইরা নিঃশব্দে শুনে গেলেন। কোনো মন্তব্য করলেন না, কোনো সান্ত্বনাও দিলেন না। শুধু হাত বাড়িয়ে দিলেন সাজিদের দিকে। একটা নিঃশব্দ, গভীর সমবেদনা।

ভালোবাসা কি এভাবেই জন্ম নেয়? না ফেলে আসা জীবনের আক্ষেপে, না ভবিষ্যতের স্বপ্নে, বরং বর্তমানের এই নিঃশব্দ সঙ্গেই?

গ্রামের মানুষজন তাদের একসাথে দেখতে শুরু করল। কেউ কেউ নানা কথা also বলল। কিন্তু সাজিদ আর ইরা তাতে কান দিলেন না। তাদের সম্পর্কটা ছিল ভিন্ন মাত্রার। এতে কোনো তাড়না ছিল না, ছিল না কোনো দাবি। শুধু ছিল একটা গভীর বোঝাপড়া, আর একে অপরের জন্য এক ধরনের শান্তি।

একটা সময় এলো, যখন ইরাকে আবারও ঢাকায় ফিরে যেতে হবে। পরিবার, কাজ – সবই ডাকছে। শেষ সন্ধ্যাটা তারা কাটালেন সেই পুরনো মসজিদের চাতালেই, যেখানে তাদের পুনর্মিলন হয়েছিল।

"তোমার কী ইচ্ছে করে, ইরা?" সাজিদ জিজ্ঞেস করলেন।

ইরা কিছুক্ষণ ভেবে বললেন, "ইচ্ছে করে, এই গ্রামে একটা ছোট স্কুল অফ মিউজিক খুলি। গ্রামের孩子们 যেন শহরে না গিয়েও সঙ্গীত শিখতে পারে।"

সাজিদ হাসলেন, "তা হলে তো বেশ ভালো হয়।"

চলার সময় হলে, ইরা যখন গাড়িতে উঠবেন, সাজিদ একটা চিরকুট বাড়িয়ে দিলেন তাঁর দিকে। তাতে লেখা ছিল মাত্র একটা লাইন – "যখনই বৃষ্টি নামবে, আমি তোমার কথা ভাবব।"

ইরা চিরকুটটা হাতে নিয়ে, একটা লম্বা শ্বাস নিলেন। গাড়ি ছাড়ল। সাজিদ দাঁড়িয়ে রইলেন, যতক্ষণ না গাড়িটা দৃষ্টির অন্ধকারে মিলিয়ে যায়।

কিন্তু এটা কোনো বিদায়ের গল্প নয়। বরং, এটা একটা শুরুর গল্প। কারণ, ভালোবাসা মানে কখনো কখনো ধরে রাখা নয়, মানে মুক্ত করে দেওয়া। আর সত্যিকারের ভালোবাসা কখনো দূরে যায় না, তা স্থান আর সময়ের উর্ধ্বে, চিরকাল বেঁচে থাকে দুই হৃদয়ের নিঃশব্দ বোঝাপড়ায়।

আর সিলেটের সেই ছোট্ট গ্রামে, এখনও যখন বৃষ্টি নামে, সাজিদ আর ইরার কথা মানুষের মুখে মুখে ফিরে। তারা জানে না ইরা কি আবার ফিরে আসবেন, কিংবা সাজিদ কি কখনও তাঁর গ্রাম ছেড়ে যাবেন। কিন্তু তারা জানে, একটা সত্যি ভালোবাসার গল্প, যেটা তাদের গ্রামের মাটি আর বৃষ্টিভেজা হাওয়ায় মিশে আছে।

Comments

    Please login to post comment. Login

  • Muzahid Shihab 1 month ago

    খুব সুন্দর লিখেছেন, আগিয়ে যান সমানের দিকে