রাত তখন প্রায় বারোটা। শহরের সব আলো নিভে গেছে, বিদ্যুৎ নেই।
পুরনো ভাড়া বাসায় একা বসে আছে রিমি। চারদিকে নিস্তব্ধতা, শুধু বৃষ্টির শব্দ।
রিমির সামনে একটা মাত্র মোমবাতি জ্বলছে — শেষটা।
তার শিখাটা দুলছে, যেন বলছে, “আমি যতক্ষণ আছি, ভয় পেয়ো না।”
রিমি একটু চুপ করে থাকে।
আজ তার মা’য়ের মৃত্যুর তৃতীয় বার্ষিকী।
মা চলে যাওয়ার পর থেকেই রিমি ভয় পায় অন্ধকারে।
ঠিক তখনই দরজায় টোকা।
ঠকঠক... ঠকঠক...
রিমির বুক ধক করে ওঠে।
এই গভীর রাতে কে হতে পারে?
বাইরে তাকায়, কেউ দেখা যায় না।
দ্বিতীয়বার আবার টোকা শোনা যায় — এবার একটু জোরে।
সে সাহস করে দরজা খোলে।
দেখে, এক ছোট্ট মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে — বয়স হয়তো সাত-আট।
চুল ভেজা, পোশাক কাদায় মাখা, হাতে একটা নিভে যাওয়া লণ্ঠন।
মেয়েটা বলল,
“আপা, একটু আলো দেবেন? আমার লণ্ঠনটা জ্বালাতে হবে।”
রিমি বিস্ময়ে বলে,
“এই ঝড়ের রাতে তুমি একা?”
মেয়েটা হেসে বলে,
“না আপা, আমি একা না। আপনি আছেন তো।”
রিমি কিছু না বুঝে মোমবাতিটা এগিয়ে দেয়।
মেয়েটা তার লণ্ঠনে আগুন নেয়, আর হালকা আলোয় মুখটা উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।
অদ্ভুত ব্যাপার — মেয়েটার চোখ একদম রিমির ছোটবেলার মতো।
রিমি থমকে যায়।
সে কিছু জিজ্ঞেস করতে চায়, কিন্তু মেয়েটা তখনই বলে—
“আপা, ভয় পাবেন না। অন্ধকার কখনো শেষ হয় না, শুধু আলো বদলায়।”
এরপর মেয়েটা ঘুরে দরজা দিয়ে বেরিয়ে যায়।
রিমি দৌড়ে বাইরে আসে — কিন্তু চারদিকে শুধু বৃষ্টি আর ফাঁকা রাস্তায় জলের ধারা।
মেয়েটা নেই।
রিমি ঘরে ফিরে দেখে, মোমবাতিটা নিভে গেছে...
তবু ঘরটা আলোয় ভরে আছে।
দেয়ালে ঝুলানো ছবিটার দিকে তাকায় —
তার মা আর ছোটবেলার সে নিজে।
ছবির কোণ থেকে এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ছে, যেন বৃষ্টির ফোঁটা নয় — মায়ের আশীর্বাদ।
রিমি ফিসফিস করে বলে,
“তুমি এসেছিলে... আমি জানতাম।”
বাইরে তখন বৃষ্টি থেমে গেছে,
নতুন ভোরের আলো জানালা ভরিয়ে দিচ্ছে।
শেষ মোমবাতি নিভে গেছে,
কিন্তু রিমির মন জ্বলে উঠেছে নতুন আলোর মতো।