বর্ষার রাত। মেঘনা নদীর বুক চিরে ছুটে আসা বাতাস আন্ধারমানিক গ্রামের ঘুমন্ত ঘরবাড়িতে অশরীরী দীর্ঘশ্বাসের মতো আছড়ে পড়ছে। গ্রামটা যেন নিজেই তার নামের সার্থকতা প্রমাণে ব্যস্ত। বিদ্যুৎহীন এই জনপদে অমাবস্যার অন্ধকার আর মেঘের গর্জন মিলেমিশে এক আদিম ভয় তৈরি করেছে। নদীর তীরে দাঁড়িয়ে থাকা কাশেমের দোচালা ঘরটা অন্ধকারের এই সমুদ্রে একটা বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো ভাসছে। ভেতরে কুপি বাতির কাঁপা কাঁপা আলোয় কাশেমের তরুণ মুখটা একবার আলোকিত হচ্ছে, আবার ডুবে যাচ্ছে ছায়ায়। বয়স ২২ কি ২৩ হবে, পেশায় জেলে। মেঘনার বুকে জাল ফেলাই তার জীবন। কিন্তু আজ কয়েকদিন হলো তার চোখে ঘুম নেই। এক অজানা আতঙ্ক তাকে তাড়া করে ফিরছে।কিন্তু কি সেই আতঙ্ক?
হঠাৎ সেই আতঙ্ক আরো জুড়ালো হলো যখন এক ভীষণ মোটা আর অদ্ভুত কন্ঠ কাশেম শুনতে পেলো।
"কাশেম... ও কাশেম..."
কাশেমের রক্ত হিম হয়ে গেলো।সে ভালোকরে শুনার চেষ্টা করলো।পরক্ষনেই সে বুঝতে পারলো এটা আর কেউ নয়, স্বয়ং এটা তার মৃত মায়ের কণ্ঠ!
তিন বছর আগে কলেরায় ভুগে তার মা মারা গেছেন। কিন্তু এই কণ্ঠস্বর এত জীবন্ত, এত চেনা! তার মা ঠিক এভাবেই তাকে ডাকতেন।কিন্তু তার মা ত মারা গেছে, তাহলে? সে দ্রুত উঠে বসলো। ঘরের বেড়ার ফাঁক দিয়ে বাইরে তাকালো। জমাট বাঁধা অন্ধকার ছাড়া কিছুই চোখে পড়ে না। কেবল ঝিঁঝিপোকার একটানা ডাক আর বাতাসের শোঁ শোঁ শব্দ।
"কিরে, শুনতে পাস না? আমি তোর মা... বাইরে আয় বাবা।"
এবার ডাকটা আরও করুণ, আরও আকুল। কাশেমের বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো। সে জানে এটা হওয়ার কথা নয়। গ্রামের সবাই তাকে সাবধান করেছে। নিশি! রাতের বেলা প্রিয়জনের কণ্ঠ নকল করে ডাকে। যে সেই ডাকে সাড়া দিয়ে বাইরে যায়, সে আর ফেরে না। গ্রামের মোড়ল থেকে শুরু করে সবাই তাকে বলেছে, রাতের বেলা কোনো ডাকে কান দিবি না। কিন্তু এ যে তার মায়ের ডাক! তার মস্তিষ্ক বলছে এটা বিভ্রম, কিন্তু তার হৃদয় বলছে এটা সত্যি। দ্বিধার এই সংগ্রামে তার যুক্তিবোধ ক্রমশ হেরে যেতে লাগলো। ডাকটা তাকে চুম্বকের মতো টানছে। সে ঘোরের মধ্যে পা বাড়াল দরজার দিকে।কিন্তু সে জানেও না সে কোন ফাঁদে পা দিচ্ছে।
........
পরদিন সকালে গ্রামের ঘাটে কাশেমের জাল আর গামছাটা পাওয়া গেলো। কিন্তু কাশেম নেই। মেঘনার বিশাল বুকে আরও একটি তরুণ হারিয়ে গেলো, ঠিক আগের চারজনের মতোই।কিন্তু কেনো?কেনো এক অজানা অভিশাপ তাদের উপর নেমে এলো?কাশেমের পর আন্ধারমানিক গ্রামের ওপর এই নিশির অভিশাপ যেন আরও ঘনীভূত হলো।
.......
কাশেমের নিখোঁজ হওয়ার তিনদিন পর। তার ছোট বোন রাবেয়া, গ্রামের একমাত্র কলেজপড়ুয়া মেয়ে, ঢাকায় এক পরিচিত সাংবাদিককে ফোন করলো। তার কণ্ঠ কাঁপছিলো, কিন্তু কথায় ছিলো দৃঢ়তা। সে সাংবাদিককে নিশির গল্প বা অভিশাপের কথা বললো না। সে শুধু বললো,
"ভাইয়া, আমাদের গ্রামে গত তিন মাসে পাঁচজন সবল-সুস্থ যুবক হারিয়ে গেছে। সবাই বলছে নিশির কাজ, কিন্তু আমার মন মানছে না। এর পেছনে অন্য কোনো রহস্য আছে। আপনারা কি সাহায্য করতে পারেন?"
এই ফোনকলটিই পৌঁছে গেলো আমাদের গল্পের প্রধান আকর্ষণ রায়হান চৌধুরীর কাছে। রায়হান, প্রাক্তন অনুসন্ধানী সাংবাদিক, আর এখন তার গড়া 'লৌকিক' দলের প্রধান। কুসংস্কারের কারণে ব্যক্তিগত জীবনে এক মর্মান্তিক ক্ষতির শিকার হওয়ার পর থেকেই তার জীবনের একমাত্র লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে অলৌকিকতার মুখোশ উন্মোচন করা।মানুষের অন্ধ বিশ্বাস দুর করে সত্যটাকে টেনে বের করে আনা।
রাবেয়ার ফোনের বিবরণ শুনে রায়হান তার দলের সদস্যদের ডাকলো।তার ছোট কিন্তু কার্যকরী অফিসে মিটিংয়ে বসলো পাঁচজন। রায়হানের বিপরীতে ডঃ আনিকা হক, দলের বৈজ্ঞানিক বিশেষজ্ঞ। তার শান্ত চোখজোড়ায় বুদ্ধির ঝিলিক। পাশে বসে আছে জিমি, টেক জিনিয়াস।তার আঙুলগুলো ল্যাপটপের কি-বোর্ডের ওপর অস্থিরভাবে নাচছে। অন্য কোণায় সায়রা সুলতানা, মনোবিজ্ঞানী ও লোকসংস্কৃতি গবেষক। তার হাতে ধরা প্যাডে নোট নিচ্ছে। আর দরজার কাছে পাহাড়ের মতো নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে কামাল আহমেদ, দলের নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ।মোটামুটি এই হলো তাদের দলের আকার,আকৃতি।
রায়হান উত্তেজনাসহিত বললো,
"নতুন কেস এসেছে। চাঁদপুর সংলগ্ন আন্ধারমানিক গ্রাম। কেস প্রোফাইল: 'নিশিডাক'। গত তিন মাসে পাঁচজন যুবক নিখোঁজ। স্থানীয় বিশ্বাস, নিশি নামের আত্মা এর জন্য দায়ী। আমাদের যেতে হবে।"
আনিকা চশমাটা ঠিক করে বললো,
"নিশিডাক... ইন্টারেস্টিং। Mass hysteria বা অডিটরি হ্যালুসিনেশনের ক্লাসিক কেস হতে পারে। কিন্তু পাঁচজন নিখোঁজ হওয়াটা প্যাটার্নের বাইরে।"
"এক্স্যাক্টলি...."
রায়হান সায়রার দিকে তাকালো।
"সায়রা, তুমি লোককথাটা নিয়ে একটু রিসার্চ করো। জিমি, স্যাটেলাইট ম্যাপে গ্রামটার জিওগ্রাফি আর কানেক্টিভিটি দেখে নাও। কামাল, নদীপথে পালানোর রুটগুলো নিয়ে ভাবতে থাকো। আমরা কাল সকালে রওনা হচ্ছি।"
সকলে সম্মতি জানিয়ে যে যার কাজে লেগে পড়লো...
.....
আন্ধারমানিক গ্রামে পৌঁছানোর পথটা ছিলো দীর্ঘ। পাকা রাস্তা ছেড়ে মেঠোপথে তাদের জিপগাড়িটা যখন প্রবেশ করলো, সভ্যতার শেষ চিহ্নগুলো যেন পেছনে মিলিয়ে গেলো। গ্রামটা আশ্চর্যরকম নীরব।কেমন যেনো অজপাড়াগাঁ। তাদের গাড়ি দেখে যে ক'জন বাইরে ছিলো, তারাও কেমন সন্দেহের চোখে তাকিয়ে দ্রুত সরে গেলো। সন্ধ্যার আগেই পুরো গ্রাম যেন ভূতুড়ে নিস্তব্ধতায় ডুবে গেলো।
রাবেয়ার বাড়িতেই তাদের থাকার ব্যবস্থা হলো। মেয়েটির চোখে ভয় থাকলেও বুদ্ধির ছাপ স্পষ্ট। সে নিখোঁজ হওয়া পাঁচজনের নাম, বয়স, বাড়ির অবস্থান সবকিছুর একটা তালিকা করে রেখেছিলো।
পরদিন সকাল থেকে 'লৌকিক' দল তাদের কাজ শুরু করলো। পরিকল্পনা অনুযায়ী তারা চার ভাগে ভাগ হয়ে গেলো।
সায়রা গেলো গ্রামের মোড়লের সাথে কথা বলতে। বৃদ্ধের বাড়ি পুরানো আমলের মাটির বাড়িরই মতো।যদিও সে প্রথমে কিছু বলতে না চাইলেও অনেক জোড়াজুড়ি করার পর রাজি হলো। বৃদ্ধ মোড়ল হুঁকায় টান দিতে দিতে বললেন,
"এইডা নিশির কাণ্ড, মা। যুগ যুগ ধইরা এই আন্ধারমানিকে তার বাস। সে ভালা মানুষের গলা নকল কইরা ডাকে। তার ডাকে যে বাইর হয়, তার লাশও পাওয়া যায় না।"
সায়রা নরম গলায় জিজ্ঞেস করলো,
"চাচা, যারা হারিয়ে গেছে, তাদের সবার কথাই কি আপনারা শুনেছেন?"
"না, মা। যার নাম ধইরা ডাকে, হেই শুধু শোনে। আর কেউ না।"
এই তথ্যটা সায়রার কাছে গুরুত্বপূর্ণ মনে হলো। এটা সাধারণ অডিটরি হ্যালুসিনেশন থেকে ভিন্ন। সে নিখোঁজ হওয়া যুবকদের পরিবারের সাথেও কথা বললো। সবাই একই কথা বলল । ডাকটা ছিলো একান্তই ব্যক্তিগত এবং অতি পরিচিত কারো। সায়রা তার নোটে লিখল, "Selective auditory targeting. How?"
অন্যদিকে রায়হান ও কামাল পুরো গ্রামটা হেঁটে জরিপ করতে লাগলো। রায়হান নিখোঁজ হওয়ার স্থানগুলো তার ট্যাবলেটের ম্যাপে চিহ্নিত করলো। সবগুলো বাড়িই নদীর খুব কাছে, গ্রামের কিছুটা বিচ্ছিন্ন অংশে। কামাল চারপাশটা দেখছিলো একজন কমান্ডোর চোখে। সে রায়হানকে বললো,
"বস, প্রতিটা স্পট থেকে নদীতে নামার সহজ পথ আছে। কোনো ধস্তাধস্তির চিহ্ন নেই। এর মানে হলো, ভিকটিমরা স্বেচ্ছায় হেঁটে গেছে অথবা এমনভাবে তাদের নেওয়া হয়েছে যে তারা বাধা দেওয়ার সুযোগই পায়নি।"
রায়হান ম্যাপে চোখ রেখে বললো,
"পাঁচজনই তরুণ এবং সুস্থ। মানব পাচারের সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। কিন্তু প্রশ্ন হলো, তারা কোনো প্রতিরোধ ছাড়াই কীভাবে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো?"
জিমি তখন তার প্রযুক্তির ভান্ডার নিয়ে ব্যস্ত। রাবেয়ার ঘরের এক কোণায় সে তার মিনি কন্ট্রোল স্টেশন বানিয়ে ফেলেছে। সে গ্রামের ড্রোন ফুটেজ বিশ্লেষণ করছিলো। কিন্তু অস্বাভাবিক কিছুই চোখে পড়লো না। আনিকা বিভিন্ন স্থান থেকে মাটি, জল এবং বাতাসের নমুনা সংগ্রহ করে তার পোর্টেবল মাইক্রোস্কোপ আর টেস্টিং কিট নিয়ে বসেছে। কয়েক ঘণ্টা পরীক্ষার পর সে হতাশ হয়ে রায়হানকে জানালো,
"মাটি, জল বা বাতাসে কোনো বিষাক্ত উপাদান বা ড্রাগের উপস্থিতি নেই। অন্তত আমার এই ফিল্ড কিটে যা পরীক্ষা করা সম্ভব।"
তদন্তের প্রথম দিন শেষে দলের হাতে নির্দিষ্ট কোনো প্রমাণ এলো না।সবাই হতাশ। রহস্য আরও ঘনীভূত হলো। রাত নামার সাথে সাথে আন্ধারমানিক গ্রাম আবার তার সেই আদিম ভয়াল রূপ ফিরে পেলো।
....
দ্বিতীয় রাতে জিমি তার আসল খেলা শুরু করলো। সে রায়হানের অনুমতি নিয়ে গ্রামের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ তিনটি পয়েন্টে হাই-ফ্রিকোয়েন্সি সাউন্ড রেকর্ডার এবং নাইট-ভিশন ক্যামেরা বসিয়ে দিলো। এগুলো সাধারণ ক্যামেরা বা রেকর্ডারের চেয়ে অনেক বেশি সংবেদনশীল।
মাঝরাতে হঠাৎ জিমির ল্যাপটপে একটি অডিও চ্যানেলের গ্রাফ তীক্ষ্ণভাবে লাফিয়ে উঠলো। একটা তীব্র, কিন্তু মানুষের শ্রবণ ক্ষমতার ঠিক সীমানায় থাকা হিসহিস শব্দ রেকর্ড হলো। কয়েক সেকেন্ড পরেই শব্দটা মিলিয়ে গেলো। জিমি দ্রুত সেই সময়ের ক্যামেরা ফুটেজ প্লে করলো। দেখা গেলো, একটি বাড়ির ভেতর থেকে একজন লোক ঘুমের ঘোরে দরজার দিকে এগিয়ে আসছে। কিন্তু ঠিক তখনই তার বাচ্চা কেঁদে ওঠায় ভেতরের অন্য কেউ আলো জ্বালিয়ে দেয় এবং লোকটি সম্বিৎ ফিরে পায়।
জিমি উত্তেজনায় প্রায় চিৎকার করে উঠলো। সে দ্রুত দলের বাকিদের ডেকে তুললো। আনিকা অডিও ফাইলটি তার স্পেকট্রোগ্রাম সফটওয়্যারে বিশ্লেষণ করতে বসলো। স্ক্রিনে ভেসে ওঠা রঙিন তরঙ্গের দিকে তাকিয়ে তার চোখ জ্বলে উঠলো।
"ইউরেকা!"
আনিকা বললো।
"এটা কোনো সাধারণ শব্দ নয়। এটা একটা অত্যন্ত ফোকাসড এবং ডিরেকশনাল সাউন্ড বিম। অনেকটা সাউন্ড লেজারের মতো। একে বলা হয় LRAD বা লং রেঞ্জ অ্যাকোস্টিক ডিভাইস। নির্দিষ্ট টার্গেটের দিকে শব্দ পাঠানো যায়, আশেপাশের মানুষেরা মূল টার্গেটের মতো তীব্রভাবে শব্দটি অনুভব করবে না।"
রায়হান অবাক হয়ে বললো,
"মানে?যাকে পাঠাবে শুধু সে ই ভালোকরে শুনতে পাবে?আজব তো।আরেকটু বিস্তারিতভাবে বলতে পারো?"
আনিকা এবার আরও ভালোকরে ব্যাখ্যা করলো,
"এই প্রযুক্তিতে দুটি ভিন্ন ফ্রিকোয়েন্সির আলট্রাসনিক তরঙ্গ একসাথে পাঠানো হয়। তরঙ্গ দুটি যখন টার্গেটের কাছে মিলিত হয়, তখন সেখানে মানুষের শ্রাব্য একটি নতুন শব্দ তৈরি হয়। এর ফলে মনে হয় শব্দটা যেন মাথার ভেতর থেকে বা খুব কাছ থেকে আসছে। এটা বিভ্রান্তি এবং সম্মোহনের মতো পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে।"
রায়হান চেয়ারে সোজা হয়ে বসলো।
"তার মানে, অপরাধীরা বেশ আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করছে। তারা দিনের বেলা কোনোভাবে ভিকটিমের পরিচিত লোকের কণ্ঠ রেকর্ড করছে, তারপর রাতে সেই ভয়েস ডেটা এই ডিভাইসের মাধ্যমে টার্গেটের দিকে পাঠাচ্ছে।"
জিমি যোগ করলো,
"আর দিনের বেলা গ্রাম নিরীক্ষণের জন্য তারা প্যারাবোলিক মাইক্রোফোন ব্যবহার করতে পারে। অনেক দূর থেকে নির্দিষ্ট কথোপকথন শোনা সম্ভব ওটা দিয়ে।"
কামাল বললো,
"ওরে,এইতো দেখি অনেক জটিল ব্যাপার।আর এই ধরনের যন্ত্র চালাতে হলে একটা স্থায়ী জায়গা দরকার। আর ভিকটিমকে নিয়ে যাওয়ার জন্য নদীপথই সবচেয়ে সুবিধাজনক। আমার ধারণা, নদীর ওপারে বা নদীর মধ্যেই কোনো নৌকায় তাদের বেস আছে।"
রহস্যের জট খুলতে শুরু করেছে। নিশির আত্মার বদলে ভেসে উঠছে একদল প্রযুক্তি-সচেতন, ধূর্ত মানব পাচারকারী চক্রের ছবি। 'লৌকিক' দল এখন জানে তাদের শত্রু কে। এখন শুধু তাদের সামনে আনার পালা।
.....
দলটি অপরাধীদের ধরার জন্য একটি নিখুঁত ফাঁদ পাতলোল। জিমি নিজেকে টোপ হিসেবে পেশ করল। বয়স এবং শারীরিক গঠনে সে নিখোঁজ যুবকদের কাছাকাছি। পরিকল্পনা অনুযায়ী, নদীর ধারের একটি পরিত্যক্ত ঘরে জিমি রাত কাটাবে। তার সাথে থাকবে একটি গোপন প্যানিক বাটন এবং কানে লুকানো মাইক্রো-ইয়ারপিস।
কামাল এবং রায়হান রাতের অন্ধকারে দুটি ভিন্ন জায়গায় পজিশন নিলো। তাদের কাছে ছিল নাইট-ভিশন গগলস। আনিকা ও সায়রা রাবেয়ার বাড়িতে মনিটরিং স্টেশন থেকে সবকিছু পর্যবেক্ষণ করছিলো। পুরো গ্রামের ভাগ্য যেন এই রাতের ওপর নির্ভর করছে।
রাত প্রায় দুটো। চারদিকে কবরের নিস্তব্ধতা। হঠাৎ জিমির ইয়ারপিসে আনিকার সতর্ক কণ্ঠস্বর ভেসে এলো,
"জিমি, তোমার ঘরের দিকে একটা ফোকাসড এনার্জি সিগন্যাল আসছে। বি রেডি।"
পরমুহূর্তেই জিমি তার নিজের মাথার ভেতরে রায়হানের কণ্ঠ শুনতে পেলো।
"জিমি! সর্বনাশ হয়ে গেছে! কামাল বিপদে পড়েছে। তাড়াতাড়ি বের হ!"
কণ্ঠস্বরটা এতটাই বাস্তব আর জরুরি ছিলো যে, এক মুহূর্তের জন্য জিমির নিজেরই ঘোর লেগে যাওয়ার উপক্রম হলো। কিন্তু সে নিজেকে সামলে নিলো এবং পরিকল্পনা অনুযায়ী অভিনয় শুরু করলো। সে ঘোরের ভান করে দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এলো।
তার দৃষ্টি ছিলো সামনের দিকে, কিন্তু সে অনুভব করতে পারছিলো অন্ধকারের শীতল স্পর্শ। আনিকার থার্মাল ক্যামেরায় ধরা পড়লো, নদীর বুক থেকে একটি ডিঙি নৌকা নিঃশব্দে এগিয়ে আসছে। নৌকা থেকে দুজন লোক নামলো। তাদের হাতে লম্বা একটি যন্ত্র, যেটা দেখতে অনেকটা বন্দুকের মতো LRAD ডিভাইস।
লোক দুটি জিমির কাছাকাছি আসতেই সে প্যানিক বাটন চাপলো।
পরের ঘটনাগুলো ঘটলো খুব দ্রুত। রায়হান আর কামাল যেন অন্ধকার ফুঁড়ে বেরিয়ে এলো। অপরাধীরা কিছু বোঝার আগেই কামাল একজনের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। তার নিখুঁত কমব্যাট প্রশিক্ষণের সামনে ভাড়াটে গুন্ডা দাঁড়াতে পারলো না। রায়হান অন্য লোকটিকে কাবু করলো। একটা সংক্ষিপ্ত ধস্তাধস্তির পরই দুজন অপরাধী মাটিতে।
নৌকায় তল্লাশি চালিয়ে পাওয়া গেল সেই ভয়ঙ্কর যন্ত্রগুলো এবং কিছু চেতনানাশক ইনজেকশন।
...
পরদিন সকালে আন্ধারমানিক গ্রামের দৃশ্য ছিলো ভিন্ন। সেখানে ভয় ছিলো না, ছিলো বিস্ময় এবং মুক্তি। গ্রামের মোড়লের বাড়ির উঠোনে 'লৌকিক' দল গ্রামবাসীর সামনে দাঁড়ালো।
রায়হান প্রথমে আটক হওয়া অপরাধীদের পরিচয় দিলো। তারপর জিমি সেই LRAD ডিভাইসটি সবার সামনে চালু করলো। সে মোড়লের কণ্ঠ নকল করে একটি শব্দ তরঙ্গ গ্রামের অন্য প্রান্তে থাকা কামালের দিকে পাঠালো। কামাল ইশারায় জানাল যে সে স্পষ্ট ডাক শুনতে পেয়েছে, কিন্তু উঠোনে দাঁড়ানো কেউ ভালোকরে অনুভব করতে পারেনি।
এরপর আনিকা এগিয়ে এলো। সে খুব সহজ ভাষায় গ্রামবাসীকে বোঝালো কীভাবে বিজ্ঞানের এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে তাদের সাথে প্রতারণা করা হয়েছে। সে বললো,
"নিশি কোনো আত্মা নয়। নিশি হলো মানুষের তৈরি একটি যন্ত্র। আর সবচেয়ে বড় নিশি হলো আমাদের মনের ভয় আর কুসংস্কার। এই অপরাধীরা আপনাদের সেই ভয়কেই অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছে।"
সায়রা সবশেষে কথা বললো। সে গ্রামবাসীদের বোঝালো যে,
"অজানা বিষয়ে প্রশ্ন করা বা সন্দেহ করা কোনো অপরাধ নয়। বরং অন্ধভাবে সবকিছু বিশ্বাস করে নেওয়াই বিপদ ডেকে আনে।আপনাদের আরো সতর্ক হওয়া উচিত।কুসংস্কারগুলো মুছে নতুন করে চিন্তাভাবনা করতে শিখুন।"
গ্রামবাসীদের চোখেমুখে ফুটে উঠলো কৃতজ্ঞতা আর স্বস্তি।
গ্রামের মোড়ল বললো,
"আফনেরা ছিলেন বইলায় আমরা সামনের বিপদ থেইকা রক্ষা পাইলাম।আল্লাহ আফনাগো মঙ্গল করুক।"
এদিকে রাবেয়ার মুখে ছিলো তার ভাইকে খুঁজে পাওয়ার ক্ষীণ আশা।আর এই আশা নিয়ে নতুন করে লড়াই করার প্রত্যয় শুরু তার।
'লৌকিক' দল যখন আন্ধারমানিক গ্রাম ছেড়ে আসছিলো।তখন বিকেলের নরম আলোয় মেঘনার জল চিকচিক করছে। তাদের জিপের আয়নায় রায়হান দেখলো, গ্রামের শিশুরা আবার নির্ভয়ে নদীর ধারে খেলা করছে। কুসংস্কারের অন্ধকার কেটে গিয়ে সেখানে বিজ্ঞানের যুক্তির আলো পড়েছে। রায়হান আনিকার দিকে তাকিয়ে হাসলো। একটি সফল অভিযানের পর তাদের দুজনের চোখে যে নীরব বোঝাপড়া, সেটাই তাদের এগিয়ে চলার সবচেয়ে বড় শক্তি। তাদের গাড়ি আবার ছুটে চলল নতুন কোনো রহস্যের পথে, নতুন কোনো 'অলৌকিক' ঘটনার মুখোশ খুলে দিতে।
(সমাপ্ত)
সিরিজ: অলৌকিক না লৌকিক