ঢাকার অভিজাত এলাকা বনানী। আকাশছোঁয়া দালান আর বিলাসবহুল গাড়ির ভিড়ে এখানকার জীবন কাটে আধুনিকতার ছন্দে। এই যান্ত্রিক কোলাহলের ভেতরেই দাঁড়িয়ে আছে 'ফিরোজা ভিলা' যা এক সম্ভ্রান্ত পরিবারের ঐতিহ্য ও আভিজাত্যের প্রতীক। এই বাড়ির ছোট মেয়ে নওশিন, বয়স ২১, একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্রী। তার জগৎ বই, বন্ধু আর স্বপ্নকে ঘিরে। কিন্তু গত কয়েক সপ্তাহ ধরে তার সেই চেনা জগতে এক অজানা অন্ধকার নেমে এসেছে।
এক দুপুরে নওশিন তার পড়ার টেবিলে বসে নোট তৈরি করছিলো। হঠাৎ তীব্র এক যন্ত্রণা তার মাথায় ছড়িয়ে পড়লো। চোখের সামনের অক্ষরগুলো কাঁপতে শুরু করলো, ঘরের দেয়ালগুলো যেন দুলছে। সে চোখ বন্ধ করতেই তার নিজের কণ্ঠস্বর বদলে গেলো। এক কর্কশ, বয়স্ক পুরুষের গলায় সে চিৎকার করে উঠলো,
"ছেড়ে দে এই শরীর! এ আমার জায়গা! ধ্বংস করে দেবো সব!ছেড়ে দে বলছি?"
মেয়ের রুমের এমন ভয়ংকর শব্দ শুনে তার মা ছুটে এসে দেখলেন, নওশিনের চোখ দুটো উল্টে গেছে, শরীর কাঁপছে আর মুখ দিয়ে এক বীভৎস পুরুষালি কণ্ঠের বিলাপ বেরিয়ে আসছে। মুহূর্তেই বাড়ির পরিবেশ পাল্টে গেলো। আধুনিক 'ফিরোজা ভিলা'র অন্দরে যেন বাসা বাঁধল মধ্যযুগীয় আতঙ্ক। ডাক্তার, সাইকিয়াট্রিস্ট দেখানো হলো। কিন্তু কোনো রোগ নির্ণয় করা গেলো না। নওশিনের অবস্থা দিন দিন খারাপ হতে লাগল। পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠ সদস্য, তার চাচা আর দাদি, এবার তাদের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানালেন, নওশিনকে জিনে ধরেছে। এর চিকিৎসা ডাক্তারি বিদ্যায় নেই।
খবর দেওয়া হলো কুমিল্লার এক প্রভাবশালী 'হাকিম বাবা'কে। তিনি এলেন তার দলবল নিয়ে। লম্বা দাড়ি, চোখে সুরমা আর পরনে সাদা আলখাল্লায় হাকিম বাবাকে দেখেই যেন অর্ধেক সমস্যা সমাধানের ভরসা খুঁজে পেলেন বাড়ির অনেকে। তিনি নওশিনকে দেখেই তার দিকে আঙ্গুল তাক করে ঘোষণা করলেন,
"বদনজর লেগেছে রে আম্মা। এক কাফের জিন এই মেয়ের ওপর আছর করেছে। একে তাড়াতে হলে কঠিন সাধনা লাগবে। আর প্রচুর সদকা দিতে হবে।আপনারা কি এরজন্য প্রস্তুত?"
পরিবারে এমন সমস্যায় আর কোনো উপায় খুজে না পেয়ে এই আধুনিক পরিবারটি শেষে বাধ্য হয়ে বললো,
" আপনাদের যা ইচ্ছা করুন।শুধু আমাদের মেয়েটা যেনো সুস্থ হয়ে উঠে।টাকা পয়সায় চিন্তা করবেন না।যা চাইবেন তার চেয়েও বেশি পাবেন।"
এমন কথায় কার না ভালো লাগে?
শুরু হলো 'চিকিৎসা' নামক প্রহসন। নওশিনের ঘর থেকে আধুনিক সব জিনিসপত্র সরিয়ে ফেলা হলো। তার খাওয়া-দাওয়া, চলাফেরা সবকিছুতেই আরোপ হলো কঠোর নিয়ম। হাকিম বাবা প্রতিদিন সন্ধ্যায় তার দলবল নিয়ে এসে মন্ত্র পড়া, ধোঁয়া দেওয়া আর নওশিনকে নানা ধরনের 'তাবিজ-কবচ' পরাতে লাগলেন। ফিরোজা ভিলার আধুনিকতা যেন এক ভণ্ড পীরের ভণ্ডামির কাছে অসহায় আত্মসমর্পণ করলো।
....
নওশিনের বড় ভাই, নাদিম, একজন সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। সে পরিবারের এই অন্ধবিশ্বাসে বিরক্ত কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতের কাছে অসহায়। সে নিজের চোখে দেখছে, এই 'চিকিৎসা'র নামে তার বোনের অবস্থা আরও খারাপ হচ্ছে। সে দিনের পর দিন নওশিনকে নিস্তেজ হয়ে পড়তে দেখছে, তার চোখের নিচের কালি গাঢ় হচ্ছে। হাকিম বাবার ডিমান্ডও বাড়ছে। প্রতি সপ্তাহের 'সাধনা'র জন্য তিনি মোটা অঙ্কের টাকা নিচ্ছেন।
একদিন রাতে, যখন বাড়ির সবাই হাকিম বাবার কেরামতিতে মগ্ন, নাদিম লুকিয়ে তার বোনের 'আছর' হওয়ার একটি ভিডিও ধারণ করলো। এরপর সে ইন্টারনেট ঘেঁটে এমন কাউকে খুঁজতে লাগলো যারা এই ধরনের ঘটনার পেছনের সত্য উদ্ঘাটন করে। এভাবেই সে 'লৌকিক' দলের খোঁজ পেলো। এক গভীর রাতে সে রায়হান চৌধুরীকে ফোন করলো। তার কণ্ঠে ছিলো উদ্বেগ আর আকুতি।
"রায়হান সাহেব, আমি জানি আপনারা কুসংস্কারের বিরুদ্ধে কাজ করেন। আমার বোনকে সবাই বলছে জিনে ধরেছে। কিন্তু আমার বিশ্বাস হয় না এসবে। দিনের পর দিন একজন পীর নামধারী ভণ্ড আমাদের বাড়িতে আস্তানা গেড়েছে। আমার বোনটা শেষ হয়ে যাচ্ছে। আপনারা কি ওকে বাঁচাতে পারবেন?"
রায়হান ওপাশ থেকে বললো,
" আচ্ছা,আপনি তাদের আচার অনুষ্ঠানের কোনো ভিডিও বা ছবি তুলেছেন?কিংবা কোনো ডকুমেন্টস? "
"জ্বী, আমি ভিডিও করেছি।"
" গুড,এবার আমার দেয়া ইমেইলে ভিডিওটি পাঠিয়ে দিন।"
কিছুক্ষনের মধ্যেই ভিডিও চলে এলো।রায়হান নাদিমের পাঠানো ভিডিওগুলো দেখলো। নওশিনের অস্বাভাবিক আচরণ, তার বদলে যাওয়া কণ্ঠস্বর সবকিছুই ছিলো অত্যন্ত নাটকীয় এবং বিশ্বাসযোগ্য। কিন্তু রায়হানের অভিজ্ঞ চোখ এর পেছনের সম্ভাব্য কারসাজিগুলোও দেখতে পাচ্ছিলো। সে তার দলকে আবার একত্রিত করলো।
অফিসের স্ক্রিনে ভিডিওটি চলছিলো। জিমি বললো,
"ভয়েস মডুলেশন? নাকি ভেন্ট্রিলোকুইজম? কিন্তু মেয়েটার মুখ নড়ছে। এটা বেশ কনফিউজিং ব্যাপার।"
আনিকা ভিডিওটি পজ করে একটি নির্দিষ্ট ফ্রেমে জুম করলো, যেখানে নওশিনের চোখ দেখা যাচ্ছে। সে বললো,
"ওর চোখের মণি দেখুন। অস্বাভাবিকভাবে প্রসারিত (dilated pupils)। এটা কোনো ড্রাগের প্রভাবে হতে পারে। শুধু মানসিক রোগ বা অভিনয়ে এমনটা হওয়া কঠিন।"
সায়রা বললো,
"পরিবারের ভেতরের পরিবেশটা জানা দরকার। এই ধরনের ঘটনায় প্রায়ই পারিবারিক দ্বন্দ্ব, সম্পত্তি বা মানসিক চাপ বড় ভূমিকা রাখে। আর এই 'হাকিম বাবা' লোকটাকেও পর্যবেক্ষণ করতে হবে।"
রায়হান সিদ্ধান্ত নিলো।
"আমাদের আন্ডারকভার যেতে হবে। সরাসরি তদন্তকারী হিসেবে গেলে কিছুই জানা যাবে না। আনিকা, সায়রা, তোমরা হাকিম বাবার ভক্ত সেজে ওই বাড়িতে প্রবেশ করবে। নাদিম তোমাদের দূর সম্পর্কের আত্মীয় হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেবে। তোমাদের কাজ হবে নওশিনের সার্বক্ষণিক সঙ্গী হয়ে থাকা এবং নমুনা সংগ্রহ করা।"
কামাল আর জিমিকে নিয়ে রায়হান বাইরে থেকে সাপোর্ট দেওয়ার পরিকল্পনা করলো। এবার শুরু হলো লৌকিক দলের নতুন মিশন, মিশন: ফিরোজা ভিলার রহস্যভেদ।
...
পরিকল্পনামতো সায়রা ও আনিকা সাধারণ সালোয়ার-কামিজ পরে, মাথায় ওড়না টেনে 'ফিরোজা ভিলা'য় প্রবেশ করলো। নাদিম তাদের পরিচয় করিয়ে দিলো,
"চাচা, এরা আমার দূরের খালাতো বোন। হাকিম বাবার কথা শুনে উনার দোয়া নিতে এসেছে।"
বাড়ির থমথমে পরিবেশ তাদের শরীর,অন্তর স্পর্শ করলো। নওশিনের চাচা হাশেম সাহেব, আর দাদি তারাই বাড়ির কর্তা। তাদের চোখেমুখে হাকিম বাবার প্রতি অগাধ বিশ্বাস।তারা আনিকা আর সায়রাকে তারা আপাদমস্তক মেপে নিলো।
এদিকে প্রথম দিনেই তারা তাদের কাজ শুরু করলো।
সায়রা: সে পরিবারের সবার সাথে গল্প জুড়ে দিলো। দাদির কাছে শুনলো নওশিন ছোটবেলা থেকেই কেমন শান্ত আর আদুরে ছিলো। চাচার কাছে শুনলো, তাদের পারিবারিক ব্যবসা কত বড় এবং নওশিনের নামেও অনেক সম্পত্তি লেখা আছে। সায়রা তার মনোবৈজ্ঞানিক দক্ষতা দিয়ে বুঝতে পারছিলো, এই পরিবারে বাহ্যিক ঐক্যের নিচে চাপা কোনো অন্য স্রোত বইছে। সে হাকিম বাবার 'চিকিৎসা' পদ্ধতিও খুব কাছ থেকে পর্যবেক্ষণ করল। ধোঁয়া, মন্ত্র সবই ছিলো মনস্তাত্ত্বিক চাপ তৈরির কৌশল।
আনিকা: তার লক্ষ্য ছিলো একটাই নমুনা সংগ্রহ। সে নওশিনের সাথে ভাব জমালো। তার সেবা করার ছলে, একদিন নওশিনের খাবারের প্লেট থেকে সামান্য ভাত, তার পান করা পানির গ্লাস এবং চিরুনি থেকে ঝরে পড়া কয়েকটি চুল সংগ্রহ করতে সক্ষম হলো। তার বৈজ্ঞানিক চোখ এড়িয়ে গেলো না যে, নওশিনকে প্রতিদিন একটি নির্দিষ্ট শরবত খাওয়ানো হয়, যা তার চাচা হাশেম সাহেব নিজের হাতে বানিয়ে আনেন 'পীরের নির্দেশ' বলে।
আর এদিকে রায়হান, কামাল ও জিমি বাড়ির বাইরে একটি গাড়িতে বসে তাদের ভ্রাম্যমাণ ল্যাব ও কন্ট্রোল সেন্টার বানিয়েছিলো। জিমি অত্যাধুনিক স্পেকট্রাম অ্যানালাইজার দিয়ে বাড়ি থেকে নির্গত সব ধরনের রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি স্ক্যান করতে লাগলো। কিন্তু সে কিছুই খুঁজে পেলো না।
কামাল তার বাইকে করে হাকিম বাবার গতিবিধির ওপর নজর রাখছিলো। সে দেখলো, বাবা শুধু ফিরোজা ভিলাতেই নয়, শহরের আরও কয়েকটি ধনী বাড়িতে একইভাবে 'চিকিৎসা' চালান। তার সাথে সবসময় দুজন শক্তিশালী চেলা থাকে।
সন্ধ্যার পর আনিকা সংগৃহীত নমুনা নিয়ে গাড়িতে ফিরে এলো। তার পোর্টেবল ল্যাবে শুরু হলো আসল কাজ। কয়েক ঘণ্টার রাসায়নিক পরীক্ষার পর সে যা আবিষ্কার করলো, তাতে পুরো দলের চোখ কপালে উঠলো।
আনিকা রিপোর্ট দেখিয়ে বললো,
"নওশিনের রক্তে এবং খাবারের নমুনায় অ্যাট্রোপিন (Atropine) এবং স্কোপোলামিন (Scopolamine) পাওয়া গেছে। দুটোই ধুতুরা গাছ থেকে পাওয়া যায়। খুব অল্প মাত্রায় নিয়মিত প্রয়োগ করলে হ্যালুসিনেশন, স্মৃতিভ্রম, ব্যক্তিত্বের পরিবর্তন এবং কিংকর্তব্যবিমূঢ়তার মতো লক্ষণ দেখা দেয়।খুবই মারাত্মক ড্রাগস এগুলো।চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া এগুলো ব্যবহার করা মারাত্মক।এতেই বুঝা যাচ্ছে কেউ ওকে পরিকল্পিতভাবে স্লো পয়জনিং করার করছে।"
রায়হান বললো,
"তার মানে 'জিনের আছর' আসলে ড্রাগের প্রভাব। কিন্তু কণ্ঠস্বর? ওই পুরুষালি কণ্ঠের ব্যাখ্যা কী?"
জিমি হতাশ হয়ে বললো,
"আমি কোনো রেডিও সিগন্যাল পাইনি, বস। কোনো হিডেন মাইক্রোফোন বা স্পিকার নেই। অন্তত আমার স্ক্যানারে ধরা পড়ছে না।"
রহস্যের একটা অংশ সমাধান হলেও সবচেয়ে বড় প্রশ্নটা রয়েই গেলো। কণ্ঠটা কার এবং কীভাবে আসছে?
...
পরদিন দলটি নতুন পরিকল্পনা নিয়ে কাজে নামলো। আনিকা নওশিনের চাচা হাশেম সাহেবের ওপর নজর রাখতে শুরু করলো। সে লক্ষ্য করলো, চাচা নওশিনকে শরবত দেওয়ার আগে নিজের ঘর থেকে একটি ছোট কৌটা বের করেন।
এদিকে জিমি তার কৌশল বদলাল। সে রেডিও ফ্রিকোয়েন্সির বদলে ম্যাগনেটিক ফিল্ড বা চৌম্বক ক্ষেত্র স্ক্যান করা শুরু করলো। এবং এবার সে সফল হলো। নওশিনের ঘরের একটি নির্দিষ্ট কোণ থেকে, বইয়ের শেলফের কাছ থেকে একটি দুর্বল কিন্তু স্থির চৌম্বক ক্ষেত্রের অস্তিত্ব খুঁজে পেলো সে।
জিমি উত্তেজনায় রায়হানকে বললো,
"বস, এটা কোনো সাধারণ স্পিকার নয়। এটা একটা ম্যাগনেটিক ট্রান্সডিউসার। এই ডিভাইসটি কোনো বস্তুকে (যেমন একটি জানালার কাঁচ বা কাঠের বোর্ড) ভাইব্রেট করিয়ে সেটাকেই স্পিকারে পরিণত করতে পারে। এর জন্য কোনো তার বা শক্তিশালী রেডিও সিগন্যালের দরকার হয় না।খুব কাছাকাছি থাকা একটি ট্রান্সমিটার থেকেই এটা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।"
রায়হান উত্তেজিতো হয়ে বললো,
" কি বুদ্ধি অপরাধীর।কিন্তু শেষ ভালো যার, সব ভালো।তাহলে এই কেসটারও শেষে সমাধান পাওয়া গেলো।চলো তাহলে, এবার মুল অপরাধীকে ধরা যাক"
সবকিছু জলের মতো পরিষ্কার হয়ে গেলো। অপরাধী পরিবারেরই কেউ, যে নওশিনের খুব কাছে যেতে পারে এবং এই প্রযুক্তি ব্যবহার করার মতো বুদ্ধি রাখে। সন্দেহ গিয়ে পড়ল চাচা হাশেম সাহেবের ওপর।
এবার তাকে হাতেনাতে ধরার পালা।
রায়হান নাদিমকে তাদের পরিকল্পনার কথা জানালো। সেদিন সন্ধ্যায় হাকিম বাবা তার 'চূড়ান্ত চিকিৎসা' শুরু করার প্রস্তুতি নিচ্ছিলো। বলা হয়েছিলো, আজ রাতে জিনকে শরীর থেকে নামিয়ে আনা হবে।তাই পুরো পরিবার নওশিনের ঘরে জড়ো হয়েছে।
হাকিম বাবা তার নাটকীয় ভঙ্গিতে মন্ত্র পড়া শুরু করলো। ঠিক তখনই নওশিন আবার সেই পুরুষালি কণ্ঠে চিৎকার করে উঠলো,
"আজ তোদের শেষ দিন!"
এদিকে হাশেম সাহেবের মুখে ফুটে উঠলো এক ক্রুর হাসি।
কিন্তু তার হাসি মিলিয়ে যেতে বেশি সময় লাগলো না। রায়হান এবং কামাল হঠাৎ করেই ঘরে প্রবেশ করলো সাথে পুলিশ। তাদের আকস্মিক আগমনে সবাই হতবাক। রায়হান সরাসরি হাশেম সাহেবের দিকে তাকিয়ে বললো,
"খেলা শেষ, হাশেম সাহেব।"
একই মুহূর্তে জিমি তার গাড়ি থেকে একটি জ্যামার চালু করে দিলো, যা সেই ম্যাগনেটিক ট্রান্সডিউসারের ফ্রিকোয়েন্সি ব্লক করে দেয়।ফলে 'জিনের' কণ্ঠ হঠাৎ থেমে গেলো।
হাশেম সাহেব আতঙ্কিত হয়ে বইয়ের শেলফের দিকে এগোতেই কামাল তার পথ আটকে দাঁড়ালো। রায়হান শেলফ থেকে কয়েকটি বই সরালো। তার পেছনে লুকানো ছিল ছোট্ট একটি কালো ডিভাইস, এটি সেই
ম্যাগনেটিক ট্রান্সডিউসার। আর হাশেম সাহেবের পকেট থেকে পাওয়া গেলো একটি ছোট মোবাইল ফোন, যেখানে একটি ভয়েস চেঞ্জার অ্যাপলিকেশন চালু করা ছিলো।
আনিকা তখন একটি বিশেষ টর্চ (UV light) বের করে নওশিনের হাতে থাকা পানির গ্লাসে ফেললো। গ্লাসের পানি হালকা নীল রঙে জ্বলে উঠলো। আনিকা শান্ত গলায় বললো,
"এই পানিতে আমি একটি ফ্লুরোসেন্ট ডাই মিশিয়ে দিয়েছিলাম। আর যে শরবত আপনি (হাশেম) ওকে খাইয়েছেন, তাতে ছিলো বিষ। সেই বিষের রাসায়নিক গঠন আর এই ডাইয়ের সাথে মিশে এই রঙ তৈরি করেছে। প্রমাণ আপনার সামনেই।"
হাশেম সাহেব ভেঙে পড়লো। সে স্বীকার করলো যে, পারিবারিক সম্পত্তির লোভে সে এই চক্রান্ত করেছিলো। তার উদ্দেশ্য ছিলো, নওশিনকে মানসিকভাবে অসুস্থ প্রমাণ করে তার নামে লেখা সব সম্পত্তি নিজের নিয়ন্ত্রণে আনা। হাকিম বাবা ছিলো তার ভাড়া করা সহযোগী, যে টাকার বিনিময়ে এই ভণ্ডামির নাটক সাজিয়েছিলো।
হাশেম সাহেবের এই ঘৃন্য পরিকল্পনা জানতে পেরে ফিরোজা ভিলা'র বাসিন্দাদের পায়ের নিচের মাটি যেন সরে গেলো। তাদের বিশ্বাস, তাদের ভক্তি সবকিছু এক মুহূর্তে চুরমার হয়ে গেলো। যে চাচাকে নওশিন বাবার মতো শ্রদ্ধা করতো, সেই চাচাই তার জীবনটা ধ্বংস করে দিতে চেয়েছিলো।
হাশেম সাহেব ও ভণ্ড হাকিম বাবাকে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হলো।
সায়রা বিধ্বস্ত পরিবারটির পাশে বসলো। সে তাদের বোঝালো,
"জিন বা আত্মা নয়, মানুষের মনের লোভ, হিংসা আর কুসংস্কারই হলো সবচেয়ে ভয়ঙ্কর জিন। এই জিন আপনাদের পরিবারে আছর করেছিলো। এর চিকিৎসা সচেতনতা আর শিক্ষায়, কোনো তাবিজ-কচবে নয়।"
কয়েক সপ্তাহ পর। নওশিন এখন পুরোপুরি সুস্থ। মনোরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শে সে ধীরে ধীরে ট্রমা থেকে বেরিয়ে আসছে।
আর এদিকে 'লৌকিক' দল তাদের কাজ শেষ করে ফিরে এসেছে নিজেদের ঠিকানায়।
তাদের অফিসে বসে রায়হান কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে বললো,
"সবচেয়ে অবাক লাগে, কুসংস্কার শুধু প্রত্যন্ত গ্রামে নয়, শহরের শিক্ষিতো এবং ধনী সমাজেও কত গভীরভাবে শিকড় গেড়ে আছে।"
আনিকা তার কম্পিউটারে কাজ করতে করতে মৃদু হেসে বললো,
"কারণ ভয় আর লোভের কোনো শ্রেণি হয় না, রায়হান। আর আমাদের কাজ হলো সেই ভয় আর লোভের বানানো মুখোশটা খুলে দেওয়া, সে যেখানেই হোক না কেনো।"
তাদের মিশন চলতেই থাকে। এক রহস্যের অন্ধকার দূর করে তারা এগিয়ে চলে আরেক অন্ধকারের উৎসের দিকে।
(সমাপ্ত.........)