পোস্টস

ভ্রমণ

মতিভ্রমে অতিভ্রমণ ১

৩ জুন ২০২৪

জাফর সাদেক

মূল লেখক জাফর সাদেক রুমী

কথা ছিল একটা আউলা ঝাউলা ট্যুর হবে! কিন্তু প্লানে যেইটা ছিল না সেইটা হইল শনির দশা! রবিবারে যাত্রা শুরু করে যদি কপালে শনির দশা লাগে, তাহলে ব্যাপারটা দুঃখজনকই! কিন্তু, কি আর করা, নেমেছি ক্র্যাক ট্রাভেলে, একটুতো পড়বই ভেজালে!

ভেজালের প্রথম শুরু মিস্কৌ আইল্যন্ড থেকে ফেরার পথে! কুইবেকের পয়লা মঞ্জিলে পৌঁছাতে তখনো চারঘণ্টা টানা ড্রাইভ করতে হবে! এই পথ যদি না শেষ হয় টাইপ গান বাজাতে বাজাতে ড্রাইভ করছিলাম নিশ্চিন্তে! এমন সময় হঠাত রিয়ারভিউ মিররে তাকিয়ে দেখি টিউঁ টিউঁ করে সাইরেন বাজাতে বাজাতে লালনীল চিগিভিগি লাইট জালিয়ে পেছনে একটা পুলিশগাড়ি!

 

পুলিশগাড়ি-এম্বুলেন্স এইসব দেখলেই রাস্তার ডানপাশে সাইড করে দাঁড়িয়ে থাকা এইদেশে নিয়ম! আমিও দাঁড়ালাম, আর কোন গাড়লের কপাল পুড়ল সেই নাটক দেখার জন্য গাড়ি থেকে কল্লা বের করে উঁকিঝুঁকি দিতে থাকলাম! আর গাড়িটা কীনা এসে থামল আমার ঠিক পেছনে? এসেই টম হ্যাংকস টাইপ হলিউডি হিরোর মত পুলিশ ভাইটি ফ্রেঞ্চে কিছু এক্টা বলল! মস্তিস্কের শব্দভান্ডার হাতড়ে কোন মতে বললাম, "জো নো কনে পালু ফ্রসেঁ !" ফ্রেন্চ না পারলে নাকি এম্নেই নিজের অজ্ঞতা জাহির করতে হয়। করলাম। এরপরে ইংরেজীতেই পুলিশ আমার ড্রাইভিং লাইসেন্স চেয়ে বসল- বুক ধুকপুকানি শুরু হয়ে গেল, কারণ-  ট্রাভেল বাজেটের স্প্রেডশীটে মিসসেলানাসের কলামে হয়তো আরেকটা রো যোগ হতে যাচ্ছে। পুলিশের এক কলমের খোঁচাতেই যেকোন মুহূর্তে হাজারখানেক ডলার খসে যেতে পারে পকেট থেকে।

 

টম হ্যাংকস জানালো, স্পীড লিমিটের চেয়ে নাকি ২৭ কিলোমিটার বেশী গতিতে চলছিল গাড়ি। বুঝিয়ে বল্লাম, স্পীড লিমিট চেন্জ হয়েছে , এমন কোন সাইন আমরা দেখিনি। এরপর লাইসেন্স নিয়ে কিছুক্ষন নাড়াচাড়া করে কী মনে করে জরিমানা না করেই ছেড়ে দিল। ধারণা করি,ড্ছয় বছরের ড্রাইভিং রেকর্ডে কোন লালকালি না থাকায় এইবারের মত মাফ পেয়ে গেলাম!

শনির দশা পরেরদিনেও পিছু ছাড়েনি। নিউ রিচমন্ড থেকে দ্বিতীয়দিন  আমরা দেখতে গিয়েছিলাম পার্স রক।সেই প্রাগৈতিহাসিক রক-টক ঘুরে, গাসপি পেনিনসুলা হয়ে অস্থির একটা লুপ নেয়ার প্লান করলাম সাগরপাড়ের ওশ্যানভিউ হাইওয়ে দিয়ে। কক্সবাজার থেকে টেকনাফ পর্যন্ত যে মেরিন ড্রাইভটা আছে, এই রাস্তাও সেইরকম সাগরপাড়েই, কিন্তু আরো অনেক অস্থির দৃশ্য পথে পথে। কখনো কড়া বাঁক নিয়ে পাহাড়ি পথে টান দিতে হয় গাড়ি, কখনো উঁকি দেয় একগাদা উইন্ডমিল, আর অবধারিতভাবেই নানান পদের লাইটহাউসতো আছেই।

 

এইসব দেখতে দেখতেই নিউ রিচমন্ডে ফেরার রাস্তা সেট করে নিলাম গুগল ম্যাপে। যাওয়ার রাস্তা দুইটা। একটা শর্টকট, আর আরেকটা  গাসপেসি ন্যাশনাল ফরেস্ট হয়ে, আরো দুইঘন্টা এক্স্ট্রা পথ উজিয়ে যেতে হবে! পৌঁছাতে পৌঁছাতে রাত ২টা বাজবে। নাহ বাবা, রাত বিরাতে জংগলে গিয়ে কাজ নেই। আর এমন অমাবস্যার রাতে জংগলে আর কী দেখব? দারা-পুত্র-পরিবার নিয়ে বিপদে পড়ার কোন মানে নেই। এইসব জংগলে বিপদে পড়লে সারারাত জংগলেই ধুঁকতে হবে! এইখানে সব মুজের আস্তানা, একটু পরপর সতর্কবার্তা- সামনে অসংখ্য মুজ, সাবধানে চালাও। হুট করে যদি একটা সামনে পড়ে যায়, তাহলেই ইন্নালিল্লাহ! 

 

স্টাটিস্টিকস  বলছে কানাডায় বছরে পাঁচশোর বেশি দূর্ঘটনা ঘটে এই মুজের গায়ে আছড়ে পড়ে, আর তার মধ্যে ২৩৬জনই শাহাদাৎ বরণ করে- মানে গাড়িতে থাকা মানুষের কথা বলছি, মুজদের নিয়ে আমার অত মাথাব্যাথা নেই। তাই শর্টকাটে যাওয়াই স্থির করলাম।

অল্মোস্ট এশার ওয়াক্তে গাড়ি বামে ঘোরালাম- ওশ্যানভিউ পথ ফেলে উঠলাম একটা পাহাড়ই রাস্তায়। এম্নিতেই অমাবশ্যার অন্ধকার, তারমধ্যে দুইপাশে বিশাল সব পাহাড়। হাইবিমের হেডলাইটের আলোও খুব বেশি আলোকিত করলো না তাই। এই পথ ধরে মাইল পঞ্চাশেক চালালেই মার্ডকভিল শহর, তারপরে ডানের একটা শর্টকাট দিয়ে আরো মাইলচল্লিশেক গেলে আরেকটা বড়রাস্তা- সেটা পেরুলেই নিউ রিচমন্ড ! আহ্ শান্তি!

 

গাড়ি সেই ডানের শর্টকাট নিতেই আবিষ্কার করলাম, ভুলে আমি নরকের রাস্তা বেছে নিয়েছি। শর্টকাটের রাস্তাটা একটা পাহাড়ি জংগুলে রাস্তা, এবং অতি অবশ্যই পাথরের নুড়ি বিছানো একটা গ্রাভেল রোড। দু:খের ব্যাপার, রাস্তাটা গেছে একেবারে গাস্পেসি ন্যাশনাল পার্কের কোল ঘেঁষে! টিভিতে মাঝে মাঝে আমি র‌্যালি রেসিং দেখি, মাঝে মাঝে বউয়ের চোখ বাঁচিয়ে বাসার আশেপাশের পরিচিত গ্রাভেল রোডের নিরাপদ পরিবেশে গাড়ি ছুটিয়ে ডোপামিনের ডোজ নিই, এমনকি এই অজানা অচেনা শ্বাপদসংকুল রাস্তায়ও বাল-বাচ্চা নিয়ে যাওয়াও সম্ভব ছিল, রুপান্জেল আর ফাইজান আমার চেয়েও দুইকাঠি সরস অ্যাডভেঞ্চারিস্ট বলে। কিন্তু আমাদের সাথেতো আরো একজন আছে- তাকে নিয়ে কীভাবে এই পথ পাড়ি দেয়া যায়?

 

গুগল ম্যাপে রাস্তা পাল্টানোর চেষ্টা করলাম, কিন্তু ইন্টারনেট না থাকায় সেটা সম্ভব হলো না! আন্দাজে এগুনো যায়, কিন্তু মাঝরাস্তায় পথ ভুল করলে?