জামায়াত কি সেক্যুলারিজম আত্মস্থ করতে চাইছে? ধর্মীয় কট্টরপন্থা একপাশে রেখে উদারনৈতিক গণতন্ত্র চর্চার দিকে হাঁটছে? যেখানে কেবলমাত্র মুসলিম সম্প্রদায় নয়, রাজনীতিতে ভিন্নধর্মীদেরও সমান অংগ্রহণের নিশ্চয়তা থাকবে? একজন আদিবাসী চাকমাও দাঁড়িপাল্লাকে নিজের মনে করে দলে এবং দেশে নেতৃস্থানীয় রাজনীতিক হিসেবে পরিচয় গড়ে তুলতে পারবে? কম্যুনাল রাজনীতির ধারক -এই তকমা দূরীভূত করতে চাইছে জামায়াত?
এটা এখনি নিশ্চিত করে বলা যাবে না, যতক্ষণ না তারা আনুষ্ঠানিকভাবে রাষ্ট্র ক্ষমতায় গিয়ে নাগরিকের ব্যক্তি স্বাধীনতা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা, আইনের শাসন, মানবাধিকার, বাঙালি সংস্কৃতি সুরক্ষা, সংখ্যালঘু ও ভিন্নমতের মানুষদের অধিকার নিশ্চিত করা এবং নারীর ক্ষমতায়ন ও শিক্ষাদীক্ষাকে পুরুষের সমানাধিকার বলে মেনে নিয়ে বৈশ্বিক মানদণ্ডনির্ভর কল্যাণরাষ্ট্রের পক্ষে ইতিবাচক পলিসি মেকিং করছে। যতক্ষণ না দলটি একাত্তরে স্বাধীনতাবিরোধী ভূমিকার কথা আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার করে বাংলাদেশের আপামর জনগণের কাছে অ্যাপোলজি প্রার্থনা করছে।
খেয়াল করলে দেখবেন তাদের লিডিং পর্যায়ের কেউ কিন্তু তাদের অর্গানোগ্রাম মোতাবেক এখন আর জোর দিয়ে শরিয়া আইনের কথা বলছে না। বিশেষ করে 'কুরআনের আইন চাই, সৎ লোকের শাসন চাই' -এই স্লোগানটিও তারা আগের মতো প্রমোট করছে না।
আবারো দুইবছরের জন্য আমির হিসেবে পুনর্নির্বাচিত হয়েছেন ডা. শফিকুর রহমান। সাবেক জাসদ অ্যাক্টিভিস্ট মিস্টার শফিকুর রহমানের জামায়াত কি ৮৩ বছরের মধ্যে কিঞ্চিত আলাদা? হতে পারে। ১৯৪১ সালের ২৬ আগস্ট সাইয়েদ আবুল আলা মওদূদী কর্তৃক ব্রিটিশ ভারতের লাহোরে প্রতিষ্ঠিত জামায়াতে ইসলামী এখন পর্যন্ত তাদের মাদারল্যান্ড পাকিস্তান কিংবা দ্বিতীয় ভূমি বাংলাদেশে এককভাবে রাষ্ট্র ক্ষমতায় যেতে পারেনি। তবে ২৪ এর জুলাই গণ-আন্দোলনে শক্তিশালী রেজিম হঠিয়ে দেয়ার পর ইতিহাসের এই সন্ধিক্ষণে জামায়াত স্বপ্ন দেখছে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় যাওয়ার। ইনফ্যাক্ট পারিপার্শ্বিক অবস্থা ও তাদের অ্যাটিচ্যুড প্রমাণ করে তারাই এখন ছায়া ক্ষমতায় আছে।
ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় জামায়াতের তাত্ত্বিক গুরু মিস্টার মওদূদী কিংবা আজকালকার নেতৃবৃন্দের সাথে আমেরিকার সম্পর্ক মধুরতম। বর্তমান বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষিতদের মধ্যে লিডিং পর্যায়ের প্রায় সবাই জামায়াতের অনুসারী। এমনকি জামায়াতের তরুণ নেতারাও বিদেশি শিক্ষায় শিক্ষিত। পশ্চিমা ভাবধারা অনুধাবন করা এই মানুষগুলো তবে কি বুঝে নিয়েছে বর্তমান বিশ্বসমাজের সাথে তার মিলিয়ে চলতে গেলে কোনো একটি নির্দিষ্ট ধর্মকে রাজনীতিকীকরণের মধ্য দিয়ে গেলে তা ব্যাহত হবে? এটা হতে পারে। জামায়াত আধুনিক হতে চাইছে। এমনকি শোনা যাচ্ছে তাদের নাম, লোগো এবং দলীয় অর্গানোগ্রাম বদলে নিতে চাইছে। এবং এটা যদি সত্যি হয় -বিএনপি-আ.লীগকে আজকের এই জামায়াতের সাথে বড় প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অবতীর্ণ হতে হবে। এর কারণ দল হিসেবে বিএনপি ও আ.লীগ হলো Embodiment of dynastic politics কিংবা Symbol of family-based autocracy'র ধারক। সেখানে একমাত্র জামায়াতেই সারাদেশের ভোটের মাধ্যমে নেতা নির্বাচিত হয়। ভারতের বিজেপি সরকার প্রধান নরেন্দ্র মোদির মতো একজন চাওয়ালারও যেমন রাজক্ষমতায় যাওয়া সম্ভব, তেমনি বংশমর্যাদা ও রাজনৈতিক উত্তরাধিকার ছাড়াই সাংগঠনিক যোগ্যতায় জামায়াতের কেউ শীর্ষ ক্ষমতা পেতে পারে।
নির্বাচনের আগ দিয়ে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের নিয়ে সভা-সমাবেশ এবং গেল দুর্গাপূজায় জামায়াত যেভাবে প্যাট্রোনাইজ করেছে তাতে জামায়াতের অপোনেন্ট ধর্মভিত্তিক দলগুলোই জামায়াতকে ইসলামী দল হিসেবে রোজকার সভায় খারিজ করে দিচ্ছে। বিশেষকরে হেফাজতে ইসলামী বাংলাদেশের আওতাধীন ইসলাম ধর্মভিত্তিক যেসব রাজনৈতিক দল আছে তারা রীতিমতো জামায়াতকে ভোট দিতে বারণ করছে।
তবে জামায়াতের এই বদলটা যদি লোকদেখানো ভড়ং হয়, জনগণ সেটি বুঝে নিতেও হয়ত সময় নেবে না। রাজনীতিতে কৌশল চলে, কিন্তু আমজনতার সাথে চতুরতা ও ধোঁকাবাজি চলে না। সেটি করতে গেলে হয়ত পুনর্বার এই ভূমিতে ৫ আগস্টকে আরো সবলবেগে নেমে আসতে হবে।
দুইদিন ধরে এনসিপি লিডার হাসনাত আব্দুল্লাহ্'র একটি ভিডিও ক্লিপ ভাইরাল হয়েছে। সেখানে জনৈক প্রশ্নকর্তা ধর্মভিত্তিক দল হিসেবে জামায়াতের নাম নিলে, মিস্টার আব্দুল্লাহ বলেন, 'বাংলাদেশে ধর্মভিত্তিক দল কারা? জামায়াত ধর্মভিত্তিক দল, জানি না তো!' তাঁর এই মন্তব্যের নিচে বিপুলসংখ্যক জামায়াত অনুসারী বিষোদগার করলেও বাস্তবতা কিন্তু হাসনাত আব্দুল্লাহ্'র বিস্ময়বোধক প্রশ্নের বাইরে না।
গেল কয়েকমাসে জামায়াতের আমির আমেরিকায় ট্রিপ দিয়েছেন একের অধিকবার। সেখানকার এক সভায় ৪৭ থেকে ২৫ সালে জামায়াতের যত ভুল আছে সবকিছুর জন্য নিঃশর্ত ক্ষমা চেয়েছেন দেশবাসীর কাছে। যদিও একাত্তর প্রশ্নে জামায়াতের অবস্থান ঠিক ছিল এমন অবস্থানে জামায়াত ঘরাণার বুদ্ধিজীবীরা এখনো অনড় আছেন।
সবদিক মিলিয়ে জামায়াতে ইসলামীর সাম্প্রতিক যে কার্যক্রম এবং দেশের চার স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদে ভোটের যে ফলাফল তাতে জামায়াত ধর্মভিত্তিক রাজনীতি করছে -এমন নজির স্থাপিত হয়নি। সর্বমিত্র চাকমাদের মতো ভিন্নধর্মের লোকও জামায়াতি প্যানেল থেকে জয়ের মুখ দেখে বিশ্ববিদ্যালয়ের আঙিনা দাবড়ে বেড়াচ্ছে।
আমরা আগেও বলেছি বাংলাদেশের রাজনীতি পুরোভাগে বাংলাদেশিদের হাতে নেই। আর বিশ্ব রাজনীতিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের মুরুব্বিয়ানার স্বার্থে বড় ভূমিকা পালন করে থাকে। এর সাথে যেকোনো পরগণার মার্কিন মিত্ররা অনুঘটক হিসেবে কাজ করে। ডিপ স্টেটের কথা আমরা সবাই কমবেশি জানি।
এমন বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে কারো অঙ্গুলিহেলনে জামায়াত যদি ইতিবাচক ইঙ্গিত পেয়ে থাকে -তবে তাদেরকে বদলে না গিয়ে কোনো উপায় নাই। ডোনাল্ড ট্রাম্প নিজে ডানপন্থী, কিন্তু তাঁর মিত্র রাষ্ট্রে উগ্র দক্ষিণপন্থা সহ্য করবেন এমনটা নাও হতে পারে। সুতরাং চোখে যা দেখছি যা হওয়ার তাই হয়ে চলেছে।
লেখক: সাংবাদিক
২ নভেম্বর ২০২৫
81
View