ধর্মভিত্তিক সংগঠনগুলোর সমালোচনার মুখে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নতুন সৃষ্ট সংগীত শিক্ষক পদ বাতিল করেছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। একই সঙ্গে বাতিল করা হয়েছে শরীরচর্চা শিক্ষকের পদও।
এই দুটি পদ বাদ দিয়ে ‘সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষক নিয়োগ বিধিমালা-২০২৫’-এ কিছু শব্দগত সংশোধনসহ নতুনভাবে গেজেট প্রকাশ করা হয়েছে।
বোধের কি বিস্ময়কর অবনমন! শিক্ষার্থীদের সঙ্গীত ও শরীরচর্চা নাকি লাগবে না। লাগবে কেবল ধর্মশিক্ষা! তাহলে ওই ধর্মশিক্ষা মেডিকেল, ইঞ্জিনিয়ারিং ও আইন কলেজে পাঠ্য করে দাও; কেমন চিকিৎসক, প্রকৌশলী ও আইনবিদ বের হয় আমরা দেখি।
অন্তত বৈশ্বিক কালচারের সাথে সংযোগ স্থাপন করার জন্য হলেও মানুষের সঙ্গীতচর্চা জরুরি। জাতীয় সঙ্গীত কোথায় না গাইতে হয়? সেনা নৌ বিমান, পুলিশ, আনসার, কারারক্ষী, কোস্ট গার্ড সবারই প্রশিক্ষণ কুচকাওয়াজে সঙ্গীত লাগে। ছন্দোবদ্ধ ও সুশৃঙ্খল জীবন রপ্ত করতে হলে সঙ্গীত বাদ দেয়ার এতটুকু উপায় নাই। যারা সঙ্গীতের বিরোধিতা করছে তারা এই সমাজের কোন উপকারে লাগে? তাদের শিক্ষাদীক্ষা ও পোশাকআশাক দিয়ে সেনা কমান্ড দেয়ার যোগ্যাতা তারা কখনো অর্জন করতে পারবে? শিশুরা সঙ্গীত যদি না শেখে জাতীয় সঙ্গীত গাইবার লোক বিদেশ থেকে ভাড়া করে আনতে হবে? সুতরাং প্রাইমারি স্কুলে সঙ্গীত নিষিদ্ধের এই ন্যাক্কারজনক কাজটি সর্বৈব ভুল এবং মহাঅন্যায়।
হাদিসে এসেছে, 'তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি কোন খারাপ কাজ দেখবে, সে যেন তা নিজ হাত দ্বারা পরিবর্তন করে দেয়। যদি (তাতে) ক্ষমতা না রাখে, তাহলে নিজ জিভ দ্বারা। যদি (তাতেও) সামর্থ্য না রাখে, তাহলে অন্তর দ্বারা।' আমাদের ক্ষমতা কম তাই শরীরচর্চা ও সঙ্গীত শিক্ষকের বিরোধিতা যারা করল এবং বিরোধিতাকারীদের ক্রীড়নক হয়ে কাজ করল, অন্তর থেকে তাদের প্রতি ঘৃনা ও নিন্দা জানাই।
কোনো দলের নাম উল্লেখ না করে গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটির সদস্য ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ তাঁর সোশ্যাল হ্যান্ডেলে বলেছেন, 'এইসব দলের কথা আমরা বুঝি, তারা গান নাচ নাটক খেলাধুলা শিল্পকর্ম কিছুই পছন্দ করে না। বিশেষত মেয়েরা কথা বলবে, গান গাইবে, হাসবে, খেলবে, প্রাণ প্রকৃতির মধ্যে আনন্দ খুঁজবে এটা তাদের কাছে অসহ্য। তারা আসলে মানুষের প্রাণের শক্তির প্রকাশেরই বিরোধী। কোনো সৃজনশীল অভিব্যক্তি বা সক্রিয়তা তাদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়।
সবাই রোবটের মতো থাকবে এবং তাদের হুকুম মতো চলবে এটাই তাদের দাবি। এর জন্য জোরজবরদস্তি, হামলা হুমকি, মব সন্ত্রাস সবকিছু করতে তারা প্রস্তুত।
সুতরাং তারা যখন বলে স্কুলে কোনো গানের শিক্ষক থাকতে পারবে না তখন সেই চিন্তার ধরন কারণ আমরা বুঝতে পারি। কিন্তু সরকার বলে যারা নিজেদের দাবি করে তাদের তো একটা মেরুদণ্ড থাকার কথা।'
ডয়েচে ভেলে আজ এক সংবাদভাষ্যে জানিয়েছে, তুরস্কে আতাতুর্কের সময় থেকেই সংগীত শিক্ষা প্রাথমিক শিক্ষার অংশ। আজও সরকারি স্কুলগুলোতে সংগীত, চারুকলা ও নাটক বাধ্যতামূলক। সেখানে ধর্মীয় শিক্ষকও আছে, সংগীত শিক্ষকও আছে। সমাজে ইসলাম বা নৈতিকতা বিলীন হয়নি; বরং তুরস্ক আন্তর্জাতিক মানের অর্কেস্ট্রা, সিনেমা, সাহিত্য ও বিজ্ঞানচর্চার জন্ম দিয়েছে।
মালয়েশিয়ার এডুকেশন ব্লুপ্রিন্ট ২০১৩–২০২৫ অনুযায়ী, সংগীত শিক্ষা "সফট স্কিল ও নৈতিক বিকাশের” অংশ। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এই দেশ সৃজনশীলতাকে নৈতিক বিকাশের সঙ্গে যুক্ত করেছে।
ইন্দোনেশিয়া, পৃথিবীর বৃহত্তম মুসলিম দেশ, ইউনেস্কো (২০২১)-এর রিপোর্টে স্পষ্ট বলছে যে, প্রাথমিক শিক্ষায় সংগীত ও সংস্কৃতি বাধ্যতামূলক, কারণ, এটি শিশুদের কমিউনিটি বন্ডিং ও ধর্মীয় সহনশীলতা শেখায়।
সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই)-এর স্কুলগুলোতেও সংগীত ক্লাস বাধ্যতামূলক, যা তারা ‘বিশ্বনাগরিক দক্ষতা'-এর অংশ হিসেবে দেখে। সেখানে ধর্মীয় শিক্ষা বিদ্যমান, সংগীতও বিদ্যমান, কোনোটাই অন্যটিকে প্রতিস্থাপন করে না।
কাতারের ন্যাশনাল ভিশন ২০৩০-এ বলা হয়েছে, ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে বিজ্ঞান, শিল্প ও নৈতিকতা একসঙ্গে দিয়ে গড়ে তুলতে হবে। ফলে সংগীত শিক্ষা সেখানে স্টেম শিক্ষার পাশাপাশি মৌলিক অংশ হিসেবে রয়েছে। এই উদাহরণগুলো থেকে পরিষ্কার যে সংগীত শিক্ষা কোনো ধর্মীয় বা নৈতিক মূল্যবোধের বিপরীতে নয়, বরং তাকে সমৃদ্ধ করে।
আমাদের ধর্মভিত্তিক দলগুলো পৃথিবীর সাথে তাল মিলিয়ে চলতে চাইছে না। তাহলে তাদের উচিত হবে আলাদা স্বাধীন একটি দেশ বানিয়ে পৃথিবীর সাথে সমস্ত যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে নিজেদের মনমর্জিমতো চলা।
আপনি বিদ্যালয়ে ধর্মীয় শিক্ষক চান -সেটি তো সমস্যা না। শুদ্ধ স্পিরিচুয়ালিটি চর্চায় আপনার দাবি পূরণ হোক সেটা আমরাও চাইব। কিন্তু আপনারা শিশুদের কাছ থেকে সঙ্গীতের মতো চিরায়ত ও সহজাত সংস্কৃতি এবং সুকুমারবৃত্তি কেড়ে নিয়ে কি প্রমাণ করতে চাইছেন? আপনারা পৃথিবী চালাতে পারবেন? বিদ্যুৎ, গাড়ি, প্লেন, পেনিসিলিন আপনারা আবিষ্কার করবার সক্ষমতা রাখেন?
বিখ্যাত সরোদ শিল্পী ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ বলেছেন, 'তোমরা যদি শাসকদের দুঃশাসন ভুলিয়ে দিতে চাও -তবে তাদেরকে সঙ্গীত শিখিয়ে দাও।' আমরা নড়বড়ে মেরুদন্ডের ইন্টেরিম গভমেন্টের জন্য সঙ্গীত ও শরীরচর্চা শিক্ষক নিয়োগের জোর দাবি জানাই।
লেখক: সাংবাদিক
৩ নভেম্বর ২০২৫
48
View