চারুবালার মা মনোরোমার তাস খেলার চেয়ে প্রিয় বস্তু সংসারে আর কিছুই ছিল না। কিন্তু খেলার ঝোক যতটা ছিল দক্ষতা ততটা ছিল না। তাহার এই ত্রুটি শুধরাইয়া যাইতো ললিতাকে পাইলে ।সে খুব ভালো খেলিতে পারিত। মনোরোমার মামাতো ভাই গ্রিনটো আসা পর্যন্ত এ কয়দিন সমস্ত দুপুর বেলা তাহার ঘরে তাসের বিরাট আড্ডা বসিতেছিল। গিরিন পুরুষ মানুষ, খেলে ভালো , সুতরাং তার বিপক্ষে বসিতে গেলে মনোরোমার ললিতাকে চাই-ই।
থিয়েটার দেখার পরের দিন যথাসময়ে ললিতা উপস্থিত হইল না দেখিয়া মনোরমা ঝিকে পাঠাইয়া দিলেন । ললিতা তখন একটি মোটা খাতায় একখানা ইংরেজি বই হইতে বাংলা তরজমা করিতেছিল, গেল না । তাহার সই আসিয়াও কিছু করিতে পারিলো না, তখন মনোরমা নিজে আসিয়া তাহার খাতা পত্র একদিকে টান মারিয়া সরাইয়া দিয়া বলিলেন নে ওঠ, বড় হয়ে তোকে জজিয়তি করিতে হবে না ,বরং তাস খেলতেই হবে চল।
ললিতা মনে মনে অত্যন্ত বিপদগ্রস্ত হইয়া কাঁদো কাঁদো হইয়া জানাইলো আজ তাহার কিছুতেই যাবার জো নাই, বরং কাল যাইবে। মনোরমা কিছুতেই শুনিলেন না, অবশেষে মামিকে জানাইয়া তুলিয়া লইয়া গেলেন, সুতরাং গিরিনের এর বিপক্ষে বসিয়া তাস খেলিতে হইবে, কিন্তু খেলা জমিল না। এদিকে সে এতটুকু মন দিতে পারিল না। সমস্ত সময়টা আড় হইয়া রহিলো এবং বেলা না পড়িতে উঠিয়া পরিল ।যাইবার সময় গিরিন বলিল রাত্রে আপনি টাকা পাঠিয়ে দিলেন, কিন্তু গেলেন না, কাল আবার যাই চলুন।
ললিতা মাথা নাড়িয়া মৃদু কন্ঠে বলিল না আমার বড় অসুখ করেছিল । গিরিন হাসিয়া বলিল এখন তো অসুখ সেরেচে চলুন কাল যেতে হবে।
না,না কাল আমার সময় হবে না ,বলিয়া ললিতা দ্রুত পদে প্রস্থান করিল ।আজ শুধু যে শেখরের ভয়ে তাহার খেলায় মন লাগে নাই তাহা নয় তাহার নিজেরও ভারী লজ্জা করিতেছিল।
শেখরের বাড়ির মতো এই বাড়িতেও সে ছেলেবেলা হইতে আসা-যাওয়া করিয়াছে এবং ঘরের লোকের মতই সকলের সম্মুখে বাহির হইয়াছে । তাই চারুর মামার সম্মুখেও বাহির হইতে, কথা বলিতে, প্রথম হইতেই তাহার কোন দ্বিধা হয় নাই । কিন্তু আজ গিরিনের সম্মুখে বসিয়া সমস্ত খেলার সময় টা কেমন করিয়া যেন তাহার কেবলই মনে হইতেছিল, এই কয়েকদিনের পরিচয়ে গিরিন একটু প্রীতির চোখে দেখিতে ছিল। পুরুষের প্রীতির চক্ষু যে এত বড় লজ্জার বস্তু তাহা সে ইতিপূর্বে কল্পনাও করে নাই।
বাড়িতে একবার দেখা দিয়াই সে তাড়াতাড়ি ও- বাড়িতে শেখরের ঘরে গিয়া ঢুকিল, এবং একেবারে কাজে লাগিয়া গেল। ছেলেবেলা হইতে এ ঘরের ছোটখাটো কাজগুলি তাহাকে করিতে হইত । বই প্রভৃতি গুছাইয়া তুলিয়া রাখা, টেবিল সাজাইয়া দেওয়া , দোওয়াত কলম ঝারিয়া মুছিয়া ঠিক করিয়া রাখা , এর সমস্ত সে না করিলে আর কেহ করিত না ।ছয়- সাত দিনের অবহেলায় অনেক কাজ জমিয়ে গিয়াছিল , সেই সমস্ত ত্রুটি শেখরে ফিরিয়ে আসিবার পূর্বেই নিঃশেষ করিয়া ফেলিতে কোমর বাধিয়া লাগিয়া গেল।
ললিতা সময় পাইলেই কাছে কাছে থাকি তো এবং সে নিজে কাহাকেও পর মনে করিতো না বলিয়া এ বাড়িতে তাহাকেও কেউ পর মনে করিতো না ।আট বছর বয়সে মা বাপ হারাইয়া মামার বাড়িতে প্রবেশ করিয়াছিল । তখন হইতে সে ছোট বোনটির মত শেখরের আশেপাশে ঘুরিয়া তাহার কাছে লেখাপড়া শিখিয়া মানুষ হইতেছে।
সে যে শেখরের বিশেষ স্নেহের পাত্রী তাহা সবাই জানি তো শুধু সেই স্নেহ যে এখন কোথায় উঠিয়া আছে তাহাই কেউ জানি তো না ললিতা না শিশুকাল হইতে শেখরের কাছে তাহাকে একইভাবে এত অপর্যাপ্ত আদর পাইতে সবাই দেখিয়া আসিয়াছে যে আজ পর্যন্ত তাহার কোন আদরই কাহারোই চোখে বিষদৃশ্য বোধ হয় না। কিংবা কোন ব্যবহারই কারো দৃষ্টি আকর্ষণ করে না । করে না বলিয়াই সে যে কোন দিন বধূরূপে এই গৃহে প্রতিষ্ঠিত হইতে পারে সে সম্ভাবনাও তাহারও মনে উদয় হয় নাই। ললিতাদের বাড়িতেও হয় নাই ,ভুবনেশ্বরীর মনেও হয় নাই।
ললিতা ভাবিয়া রাখিয়াছিল কাজ শেষ করিয়া শেখর আসিবার পূর্বেই চলিয়া যাইবে। কিন্তু অন্যমনস্ক ছিল বলিয়া ঘড়ির দিকে নজর করে নাই । হঠাৎ দারের বাহিরে জুতার মচমচ শব্দ শুনিয়া মুখ তুলিয়াই এক পাশে সরিয়া দাড়াইলো।
শেখর ঘরে ঢুকিয়াই বলিল এই যে! কাল তাহলে ফিরতে কত রাত হল?
ললিতা জবাব দিল না।
শেখর একটা গদি আটা আরাম চৌকির ওপর হেলান দিয়া শুইয়া পড়িয়া বলিল , ফেরা হলো কখন দুটো? তিনটে? মুখে কথা নাই কেন? ললিতা তেমনি চুপ করিয়া দাঁড়াইয়া রহিল।
শিখর বিরক্ত হইয়া বলিল ,নিচে যাও, মা ডাকছেন।
ভুবেনশ্বরী ভারের সম্মুখে বসিয়া জলখাবার সাজাইতে ছিলেন ললিতা কাছে আসিয়া বলিল ডাকছিলে মা ?
কই ডাকিনি তো বলিয়া মুখ তুলিয়া তাহার মুখের পানে চাহিয়াই বলিলেন মুখখানি এমন শুকনো কেন ললিতে ?কিছু খাসনি বুঝি এখনও?
ললিতা ঘার নাড়িল।
ভুবেনশ্বরী বলিলেন আচ্ছা যা , তোর দাদাকে খাবার দিয়ে আমার কাছে আয়।
ললিতা খাবার হাতে করিয়া খানিক পরে উপরে আসিয়া দেখিলো, তখনো শেখর তেমনি ভাবে চোখ বুজিয়া পড়িয়া আছে, অফিসের পোশাকও ছাড়ে নাই হাত মুখো ধই নাই।
কাছে আসিয়া আস্তে আস্তে বলিল খাবার এনেচি।
শেখর চাহিয়া দেখিলো না বলিল কোথাও রেখে দিয়ে যাও। ললিতা রাখিয়া দিল না হাতে করিয়া চুপ করিয়া দাঁড়াইয়া রহিলো।
শেখর না চাহিয়াও বুঝিতে ছিল ললিতা যায় নাই দাঁড়াইয়া আছে, মিনিট দুই- তিন নিঃশব্দে থাকিয়া বলিল, কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবে ললিতা, আমার দেরি আছে দেখে নিচে যাও।
ললিতা চুপ করিয়া দাঁড়াইয়া মনে মনে রাগিতেছিল, মৃদুস্বরে বলিল থাক দেরি আমারও নিচে কোন কাজ নেই ।
শেখর চোখ চাহিয়া হাসিয়া বলিল, এই যে কথা বেরিয়েছে। নিচে কাজ না থাকে ও বাড়িতে আছে তো ?তাও না থাকে তার পরের বাড়িতেও আছে তো? বাড়িতে তোমার তো একটা নয় ললিতে?
নয়ই তো বলিয়া রাগ করিয়া ললিতা খাবারের থালাটা দুম করিয়া টেবিলে রাখিয়া দিয়া হনহন করিয়া বাহির হইয়া গেল। শেখর চেচাইয়া বলিল সন্ধ্যার পরে একবার এসো।
এক শো বার আমি উপর নিচ করতে পারিনে বলিয়া ললিতা চলিয়া গেল।
নিচে আসিবা মাত্রই মা বলিলেন দাদাকে তোর খাবার দিয়ে এলি পান দিয়ে এলি নেরে ?
আমার খিদে পেয়েছে মা আমি আর পারিনে ,আর কেউ দিয়ে আসুক বলিয়া ললিতা বসিয়া পরিলো।
মা তাহার রুষ্ট মুখের পানে চাহিয়া একটুখানি হাসিয়া বলিলেন আচ্ছা তুই খেতে বস, ঝিঁকে পাঠিয়ে দিচ্চি।
ললিতা প্রত্যুত্তর না করিয়া খাইতে বসিয়া গেল।
সে থিয়েটার দেখিতে যায় নাই তবু শেখর তাহাকে বকিয়াছিল, এর আগে সে চার- পাঁচ দিন শেখর কে দেখা দেয় নাই ।অথচ সে অফিসে চলিয়া গেলে দুপুরবেলা গিয়া ঘরের কাজ করিয়া দিত, শেখর নিজের ভুল বুঝিতে পারিয়া তাহাকে দুদিন ডাকিয়া পাঠাইয়া ছিল তথাপি সে যায় নাই।