Posts

ইন্টারভিউ

ইরানের চলচ্চিত্র পরিচালক জাফর পানাহির সাক্ষাৎকার : স্বৈরাচারের যুগে সিনেমা নির্মাণ

November 4, 2025

জেসী খন্দকার / Jasy Khandaker

Original Author জেরেমি ও. হ্যারিস

Translated by জেসী খন্দকার

710
View

ইরানের চলচ্চিত্র পরিচালক জাফর পানাহির সাক্ষাৎকার :

স্বৈরাচারের যুগে সিনেমা নির্মাণ
লেখক: জেরেমি ও. হ্যারিস

অনুবাদ : জেসী খন্দকার

সাক্ষাৎকারের সময়কাল : ০৯ অক্টোবর, ২০২৫

ইন্টারভিউ ম্যাগাজিন 

জাফর পানাহি সম্ভবত আমাদের সময়ের অন্যতম প্রশংসিত পরিচালক—তার রাজনৈতিক থ্রিলার “ইট ওয়াজ জাস্ট অ্যান অ্যাক্সিডেন্ট” এর জন্য তিনি সদ্য জিতেছেন কান চলচ্চিত্র উৎসবের সর্বোচ্চ পুরস্কার, পালম দ’অর। তবে এই সপ্তাহে যখন তিনি কিছুটা অবসর নিয়ে নিউইয়র্কে এলেন, তখন তিনি একদম সাধারণ পর্যটকের মতো আচরণ  করলেন—এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিং ঘুরে দেখলেন এবং ম্যাকডোনাল্ড’স-এ খাওয়া-দাওয়া করলেন। নিউইয়র্ক ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে অংশ নিতে আসা ৬৫ বছর বয়সী এই ইরানি পরিচালক বর্তমানে অস্কার-মনোনয়ন নিয়েও আলোচনায় রয়েছেন। তার নতুন চলচ্চিত্রটি তার নিজ দেশের স্বৈরাচারী সরকারের বিরুদ্ধে এক তীব্র প্রতিবাদ—যে সরকারের হাতে তিনি নিজেও নির্যাতিত ও সেন্সরড হয়েছেন। সপ্তাহের শুরুতে তিনি ফিল্মের পরিবেশক NEON–এর অফিসে বসে কথা বলেন লেখক ও নাট্যকার জেরেমি ও. হ্যারিস-এর সঙ্গে—বিষয় ছিল দমনমূলক শাসনের মধ্যেও শিল্পচর্চা।

জেরেমি ও. হ্যারিস:
আপনাকে দেখা খুবই আনন্দের। আমি জেরেমি।

জাফর পানাহি:
হ্যালো জেরেমি, আপনাকে পেয়ে ভালো লাগছে।

হ্যারিস:
এটা সত্যিই আমার জন্য সম্মানের। আমার বাগদত্তা ও তার পরিবার পারস্যের, তাই আমার হবু শ্বশুর যদি জানেন আমি আপনার সঙ্গে কথা বলেছি, তিনি উচ্ছ্বাসে পাগল হয়ে যাবেন।

পানাহি:
(হেসে) আহা, ধন্যবাদ।

হ্যারিস:
আপনি পালম দ’অর জিতেছেন, আরও অনেক পুরস্কার পেয়েছেন এই চলচ্চিত্রের জন্য। আমি চাই দর্শকরা এই অভিজ্ঞতাটা অনুভব করুক। তবে আমি চাই এই সুযোগে আপনি আমেরিকান চলচ্চিত্র নির্মাতাদের বা পাঠকদের শেখান—কীভাবে গল্প বলা যায় এমন সময়ে, যখন দমননীতি যেন একদম দোরগোড়ায়।

পানাহি:
অবশ্যই, আমরা চাই এই চলচ্চিত্র এখন দেখা হোক, তবে আসলে এটি ভবিষ্যৎ নিয়ে। আমি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে নির্মিত ডকুমেন্টারি ও চলচ্চিত্রে দেখেছি—যারা নাৎসিদের সঙ্গে সহযোগিতা করেছিল, যুদ্ধের পর তাদের মাথা ন্যাড়া করে দেওয়া হয়েছিল, অপমান করা হয়েছিল, রাস্তায় লাঞ্ছিত করা হয়েছিল। অর্থাৎ, যুদ্ধের সহিংসতাই চলতে থাকে নতুন রূপে।
আমি সেই প্রশ্ন তুলতে চেয়েছি: শাসনব্যবস্থা পতনের পরও কি সহিংসতা শেষ হবে, নাকি সহিংসতার এই চক্র কখনও বন্ধ হবে না?
আমার চলচ্চিত্র বর্তমান সময়ে তৈরি, কিন্তু এর দৃষ্টিভঙ্গি ভবিষ্যতের দিকে। আমি বলতে চাইনি কী হওয়া উচিত, বরং প্রশ্ন তুলেছি—আমরা এখনই এই বিষয়ে ভাবতে শুরু করব কি না।

হ্যারিস:
অবিশ্বাস্য ব্যাপার যে আপনি এত দূরদর্শী চিন্তা করছেন। এত চাপের মধ্যেও কাজ করেছেন। আপনাকে জেলে যেতে হয়েছে, ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে, অনেক কিছু সহ্য করতে হয়েছে। অনেক শিল্পী হয়তো পিছিয়ে যেতেন। আপনি কেন এখনো এগিয়ে যাচ্ছেন?

পানাহি:
প্রথমেই একটা ভুল ঠিক করে নিই—আমি কখনও গৃহবন্দি ছিলাম না। এটা বহু বছর ধরে ভুলভাবে বলা হচ্ছে। আমি ইরানের ভেতরে চলাফেরা করতে পারতাম, শুধু দেশের বাইরে যেতে পারতাম না।
আর আমার মূল বিষয় হলো—সিনেমা। আমি সিনেমা বানাবো, এটা আমার স্বাভাবিক অধিকার। আমি এটাকে রাজনৈতিক প্রতিবাদ হিসেবে ভাবতে চাই না, বরং এটি আমার মৌলিক মানবাধিকার।
আমি জানি এই কাজের জন্য আমাকে মূল্য দিতে হয়, কিন্তু এটাকে আমি সাহস নয়, নিজের অধিকার ফিরিয়ে নেওয়া বলি।
সমস্যা শুরু হয়েছিল “দ্য সার্কেল” চলচ্চিত্র দিয়ে—কারণ এটি “নিষিদ্ধ” বিষয় নিয়ে কথা বলেছিল: নারী বন্দিদের কথা, শ্রেণি বৈষম্য, যৌনকর্মীদের জীবন। এসব ছিল তখনকার সমাজে ট্যাবু। সেখান থেকেই দ্বন্দ্ব শুরু, কিন্তু আমি থামিনি। আমি আমার সিনেমা বানিয়ে গেছি।

হ্যারিস:
আমেরিকা নিজেকে বাকস্বাধীনতার দেশ হিসেবে দাবি করে—যদিও ইতিহাসে এটা সবসময় সত্য ছিল না, বিশেষ করে আমার মত মানুষদের জন্য। এখন অনেক তরুণ প্রথমবার বুঝতে পারছে, কথা বলার মূল্য অনেক বেশি হতে পারে। তাদের জন্য আপনার কোনো পরামর্শ আছে?

পানাহি:
কাউকে উপদেশ দেওয়া যায় না। আমি শুধু আমার দেশকে জানি, এই দেশকে নয়।
তবে আমি কিছু লক্ষণ দেখি—যেমন কোনো সাংবাদিক যখন আমার সঙ্গে কথা বলে, কিছু জায়গায় হঠাৎ কণ্ঠ নিচু করে ফেলে, যেন কেউ গোপনে শুনছে। আমরা এসব লক্ষণ আগেই দেখেছি আমাদের দেশে, আর জানি এগুলোর পরিণতি কী হয়।
আমি টরন্টো ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে বলেছিলাম—আমি এই লক্ষণগুলো দেখে উদ্বিগ্ন। এটা শুধু আমেরিকায় নয়, পৃথিবীর আরও অনেক দেশে ঘটছে। পার্থক্য শুধু এই যে, আমেরিকায় এটা অবিশ্বাস্য ও অপ্রত্যাশিত।
সমাধান কী, আমি জানি না। কিন্তু ইরানে আমরা লড়ছি। বিশেষ করে নারীরা পথ দেখিয়েছে।
তিন বছর আগে “উইমেন, লাইফ, ফ্রিডম” আন্দোলন আমাদের ইতিহাসকে দুই ভাগে ভাগ করে দিয়েছে—এর আগে ও পরে।
নারীরা রাস্তায় নেমেছিল, মার খেয়েছে, চোখ হারিয়েছে, তবু হিজাব পুড়িয়ে দিয়েছে। পরদিনও তারা রাস্তায় নেমেছে।
এখনও অনেক নারী হিজাব ছাড়াই চলাফেরা করছে—সরকার কোনো পরিবর্তন আনেনি, কিন্তু জনগণ এনেছে।
তাই আমি পরামর্শ দিতে পারি না, শুধু বলতে পারি: লক্ষণগুলো চিনুন, তাদের পরিণতি ভয়াবহ হতে পারে।

হ্যারিস:
ধন্যবাদ। আপনার কাজের মধ্যে একধরনের আলো ও আনন্দ আছে। জানতে চাই, আপনি আনন্দ কোথায় পান? আপনি তো ছোটবেলা থেকেই ক্যামেরা হাতে—কী দেখেন, কী দেখেন না? হালকা মজার টেলিভিশনের কন্টেন্ট দেখেন, নাকি শুধু সিরিয়াস সিনেমা?

পানাহি:
এসবই আমাদের সংস্কৃতির অংশ। কিছু জিনিস আমাদের কাছে একদম সাধারণ, মজারও মনে হয় না। আবার কিছু জিনিসে আনন্দ আছে, হাস্যরস আছে।
যেমন, ১৯৭৯ সালের বিপ্লবের আগে আমাদের অনেক উৎসব ছিল—নওরোজ, বসন্তের শুরুতে সবাই একে অন্যের বাড়িতে যেত, গান বাজনা, নাচ—সব চলত।
তেরোতম দিনে সবাই প্রকৃতিতে যেত উৎসব করতে।
কিন্তু এই শাসনব্যবস্থা ক্ষমতায় এসে এসব উৎসব বন্ধ করে ধর্মীয় শোকানুষ্ঠানে পরিণত করল। তবু মানুষ থামেনি, আজও নওরোজ আরও জাঁকজমকভাবে পালিত হয়।
অর্থাৎ, আনন্দ ও হাসি আমাদের মধ্যে স্বাভাবিকভাবে আছে—চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে আমরা শুধু সেটাতে একটু “মসলা” যোগ করি।

হ্যারিস:
চমৎকার। আপনি এখন নিউইয়র্ক ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে আছেন। শুনেছি আসতে কিছুটা সমস্যা হয়েছিল, এখন এসে পৌঁছেছেন। কিছু ঘোরাঘুরি হচ্ছে, নাকি সারাক্ষণ সাক্ষাৎকারেই ব্যস্ত?

পানাহি:
একটার পর একটা ফ্লাইট, আর সাক্ষাৎকার।

হ্যারিস:
ভালো কোনো রেস্টুরেন্টে যাওয়া হলো না?

পানাহি:
এখনও না। আমরা ভালো রেস্টুরেন্টে যাই, কিন্তু কাজের কথাই বলি। নিউইয়র্কে বিশেষ কোথাও যাওয়া হয়নি।
গতকাল রাতে ঘুম আসছিল না, তাই এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিং ঘুরতে বেরিয়ে পড়লাম।

হ্যারিস:
দারুণ!

পানাহি:
দেড় ঘণ্টা হাঁটার পর মনে হলো, “অনেক দিন ম্যাকডোনাল্ড’স খাইনি।” তাই গেলাম আর খেয়ে নিলাম। এটাই আমার “ভালো রেস্টুরেন্ট”।

হ্যারিস:
(হাসি) ওহ মাই গড!

পানাহি:
(হেসে) হ্যাঁ, আমি একদম আমেরিকান রেস্টুরেন্টে গিয়েছিলাম।

হ্যারিস:
আমি আপনাকে কিছু দারুণ পার্সিয়ান রেস্টুরেন্টের নাম ইমেইলে পাঠাবো।

পানাহি:
অবশ্যই যাব!

হ্যারিস:
অনেক ধন্যবাদ এই আলাপের জন্য। আপনার চলচ্চিত্র সত্যিই অসাধারণ—আমি কান-এ দেখেছিলাম, আবার দেখা হয়ে দারুণ লাগলো।

পানাহি:
ধন্যবাদ আপনাদের।

Comments

    Please login to post comment. Login