Posts

চিন্তা

সৌদি আরবের সংস্কৃতি এত আপন, সঙ্গীত কেন পর!

November 4, 2025

ফারদিন ফেরদৌস

76
View

ঠিক এই মুহূর্তে সৌদি আরবে নারীদের তৈরি একমাত্র রক ব্যান্ড ‘সিরা’ ইউরোপ মাতাচ্ছে। তারা জার্মানি ও সুইজারল্যান্ডের পর এখন আছে যুক্তরাজ্যে। ব্যান্ডটির সদস্যরা হলেন—ড্রামার থিং, গিটারিস্ট হায়া, বেস গিটারিস্ট মিশ এবং ভোকাল ও কিবোর্ডে নোরা। নোরা তাদের পরবর্তী অ্যালবাম ‘সারাব’ থেকে গান পরিবেশন করেছেন। লন্ডনে তাদের গান গাওয়া ছিল একটি মাইলস্টোন। কারণ সৌদির কোনো ব্যান্ড লন্ডনে এর আগে গায়নি। নোরা গণমাধ্যমকে বলেছেন, যদিও মানুষ আমাদের ভাষা বোঝে না। কিন্তু আমরা যে আবেগ গানে দিই সেটি স্রোতারা বুঝতে পারেন।

পক্ষান্তরে অক্টোবরের শুরুর দিকে মেহেরপুরের 'সূর্য ক্লাব' আয়োজিত জেমসের কনসার্ট স্থানীয় মুরুব্বিদের দোহাই দিয়ে বন্ধ করে দেয় প্রশাসন। এবং অনেক কানাঘুষার পর ধর্মভিত্তিক দলগুলোর আর্জির প্রেক্ষিতে অন্তর্বর্তী সরকার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সঙ্গীত ও শরীরচর্চা শিক্ষক নিয়োগ বন্ধ ঘোষণা করেছে।

সৌদি টাইমস ২০২৩ সালের জুনে খবর দেয়, সৌদি আরবের শিক্ষা মন্ত্রণালয় গত মাসে এক যুগান্তকারী পরিকল্পনা ঘোষণা করেছে—৭,০০০ কিন্ডারগার্টেন শিক্ষককে সংগীত শিক্ষার প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। এটি এমন এক শিক্ষা ব্যবস্থায় বড় পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে, যেখানে এর আগে সংগীতকে কখনোই আনুষ্ঠানিক বিষয় হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি।

এই পদক্ষেপটি 'ভিশন ২০৩০'-এর অধীনে সৌদি আরবে যে ব্যাপক সাংস্কৃতিক রূপান্তর ঘটছে, তারই প্রতিফলন। ইতিমধ্যে দেশজুড়ে সংগীত উৎসব ও কনসার্টের বিস্তার ঘটেছে। জেদ্দার ১৬ বছর বয়সী রীম এ. বলেন, 'এটা দারুণ খবর। আমার স্কুলের অনেক মেয়েই বাদ্যযন্ত্র বাজানো শিখতে চায়—গান গাওয়ার চেয়ে বরং বাজানোতেই বেশি আগ্রহ—কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত আমাদের স্কুলে সংগীত ক্লাস নেই।'

মুসলিম মিরর ২০২৪ এর ডিসেম্বরে খবর পরিবেশন করে, সৌদি আরবের সব সরকারি স্কুলে সংগীত শিক্ষা চালু হচ্ছে। এ জন্য ৯ হাজারের বেশি সংগীত শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়েছে। একই সঙ্গে সংগীত শিক্ষাকে জাতীয় শিক্ষাক্রমের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবেও বিবেচনা করছে দেশটির সরকার।

যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের ‘ভিশন ২০৩০ ’–এর আওতায় অর্থনৈতিক বৈচিত্র্য এবং সামাজিক আধুনিকীকরণের লক্ষ্যে শিল্প, বিনোদন এবং শিক্ষায় সংস্কার ও বিনিয়োগের অংশ হিসেবে এই পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, সৌদি যুব সমাজের সাংস্কৃতিক দিগন্ত প্রসারিত করতে ও শিক্ষায় রক্ষণশীলতা দূর করার লক্ষ্যে ব্যাপকসংখ্যক সংগীত শিক্ষক নিয়োগ দিল দেশটির সরকার। এর আগে সংগীত শিক্ষা ও চর্চা নিষিদ্ধ বলে বিবেচিত হতো; কিন্তু সৌদি আরব এখন সক্রিয়ভাবে সংগীতকে শিক্ষাক্রমের অন্যতম উপাদান হিসেবে প্রচার করছে।

এই উদ্যোগ বাস্তবায়ন করছে সৌদি আরবের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়। স্কুলগুলোতে বিশেষ সংগীত বিভাগ খোলা হবে। শিক্ষকদের অনেকেই শাস্ত্রীয় সংগীত, আরবি সংগীতের ঐতিহ্য এবং আধুনিক ঘরানার প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। তারা শিক্ষার্থীদের সংগীত তত্ত্ব, যন্ত্র এবং পরিবেশনা শিক্ষা দেবেন।

গুটিকয়েক প্রাচীনপন্থী রক্ষণশীল বাদে সৌদি আরবের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা সাধারণ মানুষ দেশটির শিক্ষাক্রমে এই পদক্ষেপকে মাইলফলক হিসেবে উল্লেখ করেন।

এ বছর জানুয়ারিতে গাল্ফ নিউজ জানায়, সরকারি ও বেসরকারি কিন্ডারগার্টেনের ১২,০০০-এর বেশি নারী শিক্ষককে কর্মসূচির প্রথম ধাপে সঙগীত প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে, যা সাংস্কৃতিক সক্ষমতা উন্নয়ন কৌশলের অংশ। নতুন ধাপে প্রায় ১৭,০০০ নারী শিক্ষকের জন্য একটি ব্যাপক প্রশিক্ষণ কর্মসূচি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।

মাত্র এক দশক আগেও সৌদি আরবে বিনোদনের সুযোগ ছিল সীমিত—খাওয়াদাওয়া, কেনাকাটা বা ব্যক্তিগত জমায়েতের মধ্যেই জীবন কাটত। জনসমক্ষে কোনো আয়োজন প্রায় ছিলই না। অনেক সৌদি নাগরিক কনসার্ট দেখতে বা সংগীতচর্চা চালিয়ে যেতে কায়রো বা বৈরুতের মতো শহরে যেতেন। আর এখন সৌদি আরবের নারী শিল্পীরা ইউরোপের দেশগুলো পারফরম্যান্স করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিচ্ছেন।

বস্তুত সংগীত বরাবরই সৌদি সমাজে আবেগ প্রকাশ ও সামাজিক সংযোগের মাধ্যম হিসেবে কাজ করেছে। কঠোর সময়েও রেডিও উপস্থাপকেরা নিয়মিত শ্রোতাদের গান উৎসর্গের অনুরোধ পেতেন, আর ব্যক্তিগত অনুষ্ঠানে যত্ন নিয়ে সাজানো গান বা ডিজে পারফরম্যান্স থাকত। এই নীরব ধারাবাহিকতাই সরকারের কনসার্ট, উৎসব ও বৃহৎ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান অনুমোদনের পর জনজীবনে সংগীতের সহজ অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করেছে।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে একের পর এক মাইলফলক স্থাপিত হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, জেদ্দায় অনুষ্ঠিত ফর্মুলা ১ ইভেন্ট এখন আঞ্চলিক দর্শনার্থীদের আকর্ষণের কেন্দ্র—সেখানে বড় বড় আন্তর্জাতিক সংগীতশিল্পীরাও অংশ নিচ্ছেন। একসময় যেখানে সৌদিরা এমন অভিজ্ঞতার জন্য আবুধাবি যেতেন, আজ সেই অভিজ্ঞতার জন্যই অন্য দেশ থেকে মানুষ সৌদি আরবে আসছেন।

সৌদি সংগীতের শিকড় দেশটির বিভিন্ন অঞ্চলের ঐতিহ্যে গভীরভাবে প্রোথিত। হিজাজ অঞ্চলে মক্কা ও মদিনার সাংস্কৃতিক ঐশ্বর্য প্রতিফলিত হয় উদ, কানুন ও নাই বাদ্যযন্ত্রের সুরে। মধ্যাঞ্চলে প্রাধান্য পায় বেদুইন ছন্দ—যেখানে প্রধান উপাদান হলো ঢাক, তালি আর ঐতিহ্যবাহী আরদাহ—কবিতা, গান ও ঢোলের সমন্বয়ে গড়া এক পারফরম্যান্স। অপরদিকে পূর্ব প্রদেশের সংগীত আসে সমুদ্রঘেঁষা ঐতিহ্য থেকে, যেখানে মুক্তো আহরণ ও নৌজীবনের গল্প মিশে থাকে লোকগানে।

আধুনিক সৌদি সংগীত এই ঐতিহ্যের সঙ্গে বৈশ্বিক প্রভাবের মেলবন্ধন ঘটিয়ে এক অনন্য ধ্বনি সৃষ্টি করছে। মাজেদ আল-ঈসা ঐতিহ্যবাহী সংগীতকে আধুনিক সুরে মিশিয়েছেন, অন্যদিকে র‍্যাপার জারা ও হিপ-হপ শিল্পী কুসাই খেদার সাহসী পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে নতুন সংগীতভাষা গড়ে তুলছেন।

আরবের গণমাধ্যমগুলো জানাচ্ছে, সৌদি আরব যখন ক্রমে আরও উন্মুক্ত হচ্ছে, তখন সংগীতশিল্প এক সম্ভাবনাময়, উদ্ভাবনশীল ও প্রকাশমুখী ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে। একসময় সীমাবদ্ধ থাকা সংগীত এখন জনজীবনের কেন্দ্রবিন্দুতে—সৃজনশীলতাকে অনুপ্রাণিত করছে, দৈনন্দিন জীবনকে সমৃদ্ধ করছে। আর শ্রেণিকক্ষ এখন তার সর্বশেষ মঞ্চ।

ইসলাম ধর্মের আঁতুড়ঘর সৌদি আরবেই যেখানে সঙ্গীতের এতটা কদর, সেখানে আরবের অনুবর্তী অন্যান্য মুসলিম দেশেও সঙ্গীতকে দৈনন্দিন জীবনযাপনে চর্চার পাশাপাশি শিশুদের পাঠ্যক্রমেরও অংশ করে নিয়েছে।

তুরস্কে সরকারি স্কুলগুলোতে সংগীত, চারুকলা ও থিয়েটার বাধ্যতামূলক। মালয়েশিয়ার এডুকেশন ব্লুপ্রিন্ট ২০১৩-২০২৫ অনুযায়ী, সংগীত শিক্ষা 'সফট স্কিল ও নৈতিক বিকাশের' অংশ। সংযুক্ত আরব আমিরাত-এর স্কুলগুলোতেও সংগীত ক্লাস বাধ্যতামূলক।

এমন বাস্তবতায় বাংলাদেশের কী হলো আমরা কেউই জানি না। সৌদি সংস্কৃতিতে বলিয়ান বাঙালির এতটা সঙ্গীত ভয় কোন যুক্তিতে কেউ খোলাসা করে বলছে না। আমাদের দেশের শাসক যদি মুহাম্মদ বিন সালমানের মতো সংস্কৃতিমনস্ক ও চিন্তায় আধুনিক হতেন তাহলে হয়ত মিসগাইডেড রিলিজিয়াস পার্সনদেরকে বৈশ্বিক বাস্তবতায় সঙ্গীতের মাধ্যমে শিশুদের নৈতিক শিক্ষার জরুরত বুঝিয়ে বলতে পারতেন।

শিশুর সৃজনশীলতা বিকাশে শিল্প-সংস্কৃতির ভূমিকা বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত। ইউনেস্কোর গবেষণা বলছে -শিল্প ও সংস্কৃতি শিক্ষায় সম্পৃক্ততা শিশুদের সমালোচনামূলক চিন্তাশক্তি, সামাজিক দক্ষতা ও আত্মবিশ্বাস বাড়ায় (UNESCO, The Role of Arts Education, 2006)। অপরদিকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) এক সমীক্ষা অনুযায়ী গান, নাটক, ছবি আঁকার মতো সৃজনশীল কার্যক্রম শিশুদের মানসিক সুস্থতা ও শেখার আগ্রহকে বহুগুণ বাড়ায়।

আড়াই হাজার বছর আগের গ্রিক পণ্ডিত মহামতি প্লেটো প্রাথমিক শিক্ষায় সঙ্গীতের গুরুত্ব নিয়ে যথেষ্ট গভীরভাবে লিখেছেন, বিশেষত তাঁর Republic (রাষ্ট্র) এবং Laws (আইন) গ্রন্থে। প্লেটো মনে করতেন, ছোটবেলাতেই (প্রাথমিক পর্যায়ে) শিশুদের মনে যে ছাপ পড়ে, তা স্থায়ী হয়। তাই সঙ্গীতের মাধ্যমে তাদের চরিত্র, নৈতিকতা ও আত্মার বিকাশ ঘটানো সম্ভব।

লেখক: সাংবাদিক 
৪ নভেম্বর ২০২৫

Comments

    Please login to post comment. Login