একজন সুখী মানুষ
ছোট্ট একটি গ্রামে বাস করত এক মানুষ। গ্রামের মানুষ তাকে সবাই চিনত, কিন্তু তার নাম কেউ বিশেষ মনে রাখত না। কারণ তিনি কখনো নিজেকে সামনে আনতেন না, কারো কাজে বাধা দিতেন না, কারো সাথে তর্ক করতেন না। শুধু একটিই বিষয়ে তিনি সবাইকে অবাক করতেন—তার মুখে সবসময় একটি শান্ত হাসি থাকত।
লোকজন বলত—
“ও কি দুঃখ জানে না?”
“ওর জীবনে সমস্যা নেই?”
কেউ ভাবত—
“এতো শান্ত থাকা কি সম্ভব?”
কিন্তু সত্যি কথা হলো, তার জীবন রাতারাতি সুখী হয়ে যায়নি। তার জীবনেও ছিল প্রচণ্ড ঝড়। শৈশবে বাবাকে হারিয়েছিল, যৌবনে বহু কষ্ট করে রোজগার শিখেছিল, মানুষ তাকে প্রতারণা করেছিল, প্রিয়জন তাকে ভুল বুঝেছিল। কিন্তু তবুও সে কষ্টকে হৃদয়ে পাথর করে জমিয়ে রাখেনি।
সে একদিন বুঝেছিল—
“কষ্ট তো থাকবে, জীবন এমনই। কিন্তু আমি যদি কষ্টকে মুখে ফুটিয়ে হাঁটি, তবে আমি হারালাম। আমি বেছে নিলাম—সুখ।”
তার ঘর ছিল ছোট, জিনিসপত্র ছিল কম, পোশাক ছিল সাধারণ। কিন্তু একটি জিনিস সবসময় ঝকঝকে ছিল—তার মন।
প্রতিদিন ভোরে সে উঠে নদীর ধার দিয়ে হাঁটত। শিশির ভেজা ঘাসের ওপর পা রেখে সে মনে মনে বলত—
“আজকের দিনটি আমার জন্য নতুন।”
সে কারো দোষ দেখত না।
কেউ ভুল করলেও বলত—
“মানুষ তো ভুল করবে, এটাই স্বাভাবিক।”
সে কারো রাগকে নিজের রাগে পরিণত করত না।
কারো ঈর্ষাকে নিজের হৃদয়ে ঢুকতে দিত না।
একদিন গ্রামের এক ছেলে তাকে জিজ্ঞেস করল—
“চাচা, আপনি এত সুখী কিভাবে?”
তিনি নরম গলায় বললেন—
“আমি যা পাই, তাকে গ্রহণ করি। যা পাই না, তা নিয়ে ভাবি না। অন্যের জীবন দেখে নিজের জীবনকে হীন করি না। আর সবচেয়ে বড় কথা—আমি কাউকে মন থেকে ঘৃণা করি না।”
ছেলেটি আবার জিজ্ঞেস করল—
“কিন্তু কষ্ট হলে?”
তিনি ধীরে নদীর জল স্পর্শ করে বললেন—
“কষ্ট হলে আমি কষ্টকে বসতে দিই, কিন্তু আমাকে চালাতে দিই না। কষ্ট অতিথি, কিন্তু আমি বাড়ির মালিক।”
সময়ের সাথে সেই কথা ছেলেটি মনে রাখল।
আর গ্রামের অনেক মানুষ ধীরে ধীরে বুঝতে শুরু করল সুখ মানে অনেক টাকা, অনেক খাবার, বড় বাড়ি নয়।
সুখ মানে—
মনের প্রশান্তি,
ক্ষমা করার শক্তি,
অন্যের ভালোতে খুশি হওয়া,
অহংকারকে পরাজিত করা,
আর জীবনের প্রতিটি দিনে নতুন করে শ্বাস নেওয়া।
মানুষটি এখনো গ্রামে আছে।
সে এখনো ভোরে হাঁটে।
তার ঘর এখনো ছোট।
কিন্তু তার মন?
তার মন পাহাড়ের চূড়ার মতো উঁচু, আর সমুদ্রের মতো গভীর।
লেখা যায়—
সুখী মানুষ সে নয় যার কাছে সব আছে।
সুখী মানুষ সে, যে যা আছে—তা দিয়ে সন্তুষ্ট।
আর সেই মানুষ?
সে ছিল এমনই একজন সুখী মানুষ।