সুখী পরিবার
একটি ছোট গ্রামে বাস করত এক পরিবার—বাবা, মা, এক ছেলে এবং এক মেয়ে। ঘর ছিল ছোট, বেড়া ছিল বাঁশের, আর উঠোনে দাঁড়িয়ে ছিল একটি বড় আমগাছ। সেই আমগাছের ছায়াতেই সন্ধ্যাবেলা তারা বসে গল্প করত, হাসত, আর একসাথে চা খেত। তাদের ঘরে দারিদ্র্য ছিল, কিন্তু ভালোবাসা ছিল ভরপুর।
বাবা ছিলেন কৃষক। মাটি ছিল তার হাতের সাথী। ভোর হলেই তিনি কাঁধে কোদাল তুলে মাঠের পথে যেতেন। মা ছিলেন শান্ত, ধৈর্যশীল ও মমতাময়ী। তিনি খুব অল্প খাবার দিয়েও পুরো পরিবারকে তৃপ্ত করতে পারতেন। ছেলে ছিল পরিশ্রমী, আর মেয়ে ছিল হাসিখুশি—তার আঁকার খাতা ভরা ছিল রঙ আর আকাশ।
তাদের ঘরে বেশি কিছু ছিল না, কিন্তু সন্ধ্যায় যখন সবাই একসাথে হাসত, তখন মনে হতো পৃথিবীর সব সুখ যেন এই ছোট ঘরেই।
গ্রামের মানুষ বলত—
“ওদের কিছু নেই, তাও হাসে। সত্যিই ওরা সুখী।”
এক বছর গ্রামের ওপর নেমে এল প্রচণ্ড খরা।
ফসল শুকিয়ে গেল, জমি ফেটে গেল, আর বাবার চোখে দেখা দিল ক্লান্তি।
মা বললেন—
“ভয় পেও না। যা আছে আমরা ভাগ করে খাবো।”
ছেলে পড়াশোনা কমিয়ে বাবার সাথে মাঠে কাজ করতে লাগল।
মেয়ে ছবি আঁকা বন্ধ করে সেলাইয়ের কাজ শিখতে লাগল।
তারা একসাথে ছিল—এটাই ছিল তাদের শক্তি।
কিন্তু একদিন বাবা জ্বরে খুব অসুস্থ হয়ে পড়লেন।
ডাক্তার দেখানোর মতো টাকা ছিল না।
মা সারারাত ভিজে কাপড়ে বাবার গা মুছিয়ে দিলেন,
ছেলে আর মেয়ে পাশে বসে দোয়া করল।
কিন্তু ভোরের সাথে বাবা চুপচাপ চলে গেলেন।
আমগাছের ছায়াটাও যেন অন্ধকার হয়ে গেল।
এরপর পরিবারটি আগের মতো আর হাসল না।
ছেলে শহরে কাজ করতে গেল।
সে মাসে একবার ফিরে আসত,
তার চোখে আর আগের সেই উজ্জ্বলতা ছিল না।
মেয়ে কথা বলা কমিয়ে দিল।
তার আঁকার খাতায় এখন শুধু কালো রঙ।
মা একা বারান্দায় বসে থাকতেন,
কখনও আমগাছের দিকে তাকিয়ে,
কখনও আকাশের দিকে।
একদিন মেয়ে জিজ্ঞেস করল—
“আমরা কি আবার আগের মতো সুখী হবো?”
মা মৃদু গলায় বললেন—
“যে ঘরের হাসি চলে যায়,
সে ঘর শুধু দাঁড়িয়ে থাকে—
কিন্তু আর বাঁচে না।”
মানুষ আজও বলে—
“ওরা ছিল এক সুখী পরিবার।”
হ্যাঁ…
ছিল।
এখনও ঘর আছে,
মানুষও আছে,
কিন্তু সুখ নেই।
কারণ সুখ কখনও কখনও গল্পের মাঝেই শেষ হয়ে যায়,
আর বেঁচে থাকে শুধু সেই স্মৃতি—
যেটা মনে পড়লে চোখ ভিজে ওঠে।