জীবনে যেকোনো পর্যায়ে নারীরা যখন কোনো বাধা অতিক্রম করে তা দেখাটা আনন্দদায়ক। পুরুষ আধিপত্যের সমাজব্যবস্থার মধ্যে সবসময় মনে হয়, উচ্চপদে নারীদের আসীন হওয়ার মধ্য দিয়ে সম্ভবত শান্তি ও গণতন্ত্রের ভেতরকার সেতুবন্ধ শক্তিশালী হয়। মাউন্ট এভারেস্ট জয় করা থেকে শুরু করে মহাকাশে নারীর প্রথম কণ্ঠস্বর শোনা কিংবা যেকোনো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণের মধ্য দিয়ে নারী যখন নেতৃত্বের ভূমিকায় উঠে আসে, তখন নিঃসন্দেহে লাখ লাখ তরুণী অনুপ্রাণিত হয়। কিন্তু কোনো নারী, বিশেষত শ্বেতাঙ্গ নারীবাদী আন্দোলনের কেউ ক্ষমতার জন্য নৈতিক অবস্থান পরিত্যাগ করে ডানপন্থি মতাদর্শকে আলিঙ্গন করলে তা হৃদয় ভেঙে যাওয়ার মতো বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডার লিয়েন হচ্ছেন আলোচিত সেই ক্রীড়নকের ভূমিকা গ্রহণকারী ওই নারীবাদী ব্যক্তিত্ব।
উরসুলা আরেক নারীকে মনে করিয়ে দেন। তিনি হচ্ছেন যুক্তরাজ্যের সাবেক প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচার, যিনি তার কোনো রাজনৈতিক সহকর্মীকে রাজনৈতিক পরিসরের মধ্যে ওপরে উঠতে দেননি। থ্যাচার ও উরসুলা একই ধাঁচের। তারা নারীর ক্ষমতায়ন এবং উন্নয়নকে অগ্রগতির ধারায় নেওয়ার চেয়ে ক্ষতিটাই বেশি করেছেন। বাস্তবিক ক্ষেত্রে, তাদের নারীবাদী ভাবমূর্তি কুৎসিত, বিপজ্জনক এবং রাষ্ট্রদ্রোহীও বটে। অনেক উদারবাদী নারী নারী অধিকারের প্রশ্নে তাদের সোচ্চার মনে করে থাকেন। অথচ গাজা উপত্যকার পাশাপাশি ইসরায়েল কর্র্তৃক দখলকৃত পশ্চিম তীরে ফিলিস্তিনি নারীদের দুর্ভোগে, এমনকি দখলদার রাষ্ট্রের নিপীড়ন নিয়ে তাদের নীরবতাটাই সর্বাগ্রে ফুটে ওঠে।
নিজ ভিটেমাটি থেকে বিতাড়িত ফিলিস্তিনি নারীরা শরণার্থী শিবিরগুলোতে জনঘনত্বের তীব্রতার মধ্যে বাস করতে বাধ্য হচ্ছে; যার কারণ শুধু একটাই, ইসরায়েল তাদের নিজ ভূমিতে ফেরার অধিকার অস্বীকার করে। গত সাত মাসে নিজ নিজ পরিবারের প্রজন্মকে ইসরায়েলি বোমার আঘাতে মূলোৎপাটিত হতে দেখেছেন ফিলিস্তিনি নারীরা। এসব মানুষের অনেকে চেতনানাশক ছাড়াই অস্ত্রোপচারের টেবিলে যাওয়ার পর ব্যথার যন্ত্রণায় কাতর হয়েছেন, মারাও গেছেন।
অনেক নারী ধ্বংসস্তূপের নিচে, যেখানে এক সময় তাদের বাড়িঘর দাঁড়িয়ে ছিল, সেখানেই নীরবে সন্তান জন্মদান করেছেন। পশ্চিমাদের কাছ থেকে পাওয়া বিশেষ ধরনের বোমা যা সামরিক বাংকার বা স্থাপনাকে একদম মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিতে পারে তার সাহায্যে ফিলিস্তিনিদের বাড়িঘরে ইসরায়েলিরা মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিয়ে যাচ্ছিল। সেই ধ্বংসস্তূপের মধ্যে আটকা পড়া নারীরা প্রাণ হারানো স্বজনদের হাতটুকু ধরে উদ্ধারের নিষ্ফল প্রত্যাশায় ছিলেন। অথবা তীব্র যন্ত্রণা আর শোকের মধ্যে শেষ মুহূর্তটা পর্যন্ত সন্তানের ভাঙাচোড়া দেহের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে রেখেছিলেন সেইসব নারীরা।
এসব দুঃসাহসী নারী অবিরতভাবে একটি যুদ্ধবিরতির প্রার্থনায় ছিলেন। কিন্তু ইসরায়েল ও তার মিত্ররা অনবরত তা এড়িয়ে গেছে। এমনকি গাজায় ইসরায়েলি গণহত্যা সরাসরি সম্প্রচারিত অনুষ্ঠানের মতো করে গোটা বিশ্ব দেখছে (এখনো চলছে এই হত্যাযজ্ঞ)। হাসপাতালের করিডরে মায়েদের খুঁজতে থাকা আহত ও শঙ্কিত শিশুদের কান্না প্রতেক্যের বিবেককে নাড়া দেয়। কিন্তু ব্যতিক্রম শুধু সেখানকার (ইউরোপ) আইনসভার সদস্যরা, যারা কি না জায়নবাদী বর্ণবাদী রাষ্ট্রটির সমালোচনার সাহস করে উঠতে পারেন না।
কিন্তু এ ধরনের পরিস্থিতি সত্ত্বেও এসব ফিলিস্তিনি নারী হাসিমুখেই পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাওয়ান, সন্তানদের কাছে ব্যথা-বেদনা লুকিয়ে রাখেন, প্রতিবেশীদের সহায়তা করতেও প্রস্তুত থাকেন; এমনকি আগন্তুকদের প্রতিও সদয় হতে দ্বিধা করেন না। তাদের ভূমিকা সত্যিই দুর্দান্ত। নারী হয়ে নারীর প্রতি এই ভ্রাতৃত্ব আর সহমর্মিতার দৃষ্টান্তের কাছে পশ্চিমা নারীবাদ যেন ফ্যাকাশে হয়ে পড়েছে।
ফিলিস্তিনি নারীদের অধিকার বিনষ্ট করার বিরুদ্ধে না দাঁড়িয়ে কোনো রাজনৈতিক দল যদি নারীদের ভোটাধিকার উদযাপন করে, তাহলে ভণ্ডামিপূর্ণই হয়। ষাটের দশকে পশ্চিমা দুনিয়ার নারীবাদীরা বর্ণ ও নেতৃত্বের মতো ইস্যুতে খুব কমই সোচ্চার ছিল। অদ্রি লর্ড উপনিবেশোত্তর নারীবাদের ব্রান্ড সামনে আনেন ১৯৮৪ সালে তারই প্রকাশিত ‘দ্য মাস্টার্স টুলস উইল নেভার ডিসমান্টেল দ্য মাস্টার্স হাউস’ শীর্ষক প্রবন্ধের মাধ্যমে। লর্ডের সঙ্গে চন্দ্র তালপাডি মোহন্ত লিখেছিলেন, দক্ষিণ বিশ্ব তথা গ্লোবাল সাউথের চাহিদামাফিক দৃষ্টিকোণ থেকে আন্তঃসাংস্কৃতিক বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে অধিকাংশ নারীবাদী কখনোই দৃষ্টিপাত করেননি। উল্লেখ্য, চন্দ্র তালপাডি মোহন্ত ১৯৮৪ সালে তৃতীয় বিশ্বের নারীদের দুর্দশাকে কেন্দ্র করে লিখেছিলেন ‘আন্ডার ওয়েস্টার্ন আয়িস’।
নারীবাদী সত্তার অতীত ত্রুটিগুলো নিয়ে লেখক হতাশ। তাই তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন নিউক্যাসল সেন্ট্রাল এবং ওয়েস্ট আসনে এ বছরের সাধারণ নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হবেন। আসনটির বর্তমান আইনপ্রণেতা (এমপি) চি ওনউরাহকে পদচ্যুত করাই তাঁর লক্ষ্য। বর্তমান এমপি ওয়েস্টমিনস্টার বিতর্কে যুদ্ধবিরতি বন্ধের প্রশ্নে নিজের অবস্থান জানান দিতে অক্ষম ছিলেন। এই নারী এমপির কাছে গণহত্যর ব্যাপারটিতে অবস্থান নেওয়া জটিল ও কঠিন বলে মনে হয়েছে। কিন্তু গণহত্যার প্রশ্নে তো কোনো জটিল বা কঠিন কিছু থাকার কথা নয়। এ ছাড়া নিউক্যাসলের ভোটারদের সামনে কথা বলার সময়ও তিনি ফিলিস্তিনি নারীদের নিয়ে কোনো বাক্যব্যয় করেননি। উপরন্তু, গাজার ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরায়েলি আগ্রাসনের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি লজ্জাজনক বিবৃতি দিয়েছিলেন।
বিশ্বে হাজার হাজার সাধারণ ইহুদি যখন রাস্তায় নেমে এসে ইসরায়েল রাষ্ট্রের অপরাধের নিন্দা জানাচ্ছে, তখনো ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী কর্র্তৃক ফিলিস্তিনি নারীদের প্রতিদিনের অধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা নিয়ে নারীবাদীদের কণ্ঠস্বর শোনা যাচ্ছে না।
ফিলিস্তিনি নারীদের দুর্ভোগকেস্বীকৃতি না দিয়ে যেসব নারী রাজনৈতিক মতাদর্শের ডান দিকে ঝুঁকছেন তাদের সমালোচনা না করে উপায় নেই। চি ওনউরাহর মতো এমপি হয়তো শুধু একজন ব্যক্তি; কিন্তু এটি আসলে সেই ঔপনিবেশিক শৃঙ্খল যাকে ভেঙে ফেলতে হবে এবং এই সময়ে এই শৃঙ্খল প্রোথিত রয়েছে ইসরায়েল নামের বর্বর রাষ্ট্রের মধ্যে। এই পরিস্থিতির স্থিতাবস্থাকে ভাঙতে হবে অথবা পরিবর্তনের বলটাকে ধাক্কা মারতে হবে।
লেখক প্রত্যাশা করেন, জার্মান নারী উরসুলাকে সরিয়ে ইউরোপের কোনো বলিষ্ঠ নারী তার পদ তথা জায়গা দখল করবেন। শক্ত কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকলে অবশ্য তিনিই হয়তো দ্বিতীয় মেয়াদে ওই পদে থাকবেন। এই মুহূর্তে তিনি অভিবাসন ইস্যুতে যেভাবে কট্টর ডানপন্থি দলগুলোর সঙ্গে কুৎসিত আলোচনায় ইন্ধন জোগাচ্ছেন, তাতে ইউরোপ জুড়ে ভয়ের পরিবেশ বহুগুণ বেড়ে যাচ্ছে।
উরসুলার মতো নারীবাদীদের জবাবদিহির আওতায় আনতে চান আয়ারল্যান্ড থেকে আসা ইউরোপীয় ইউনিয়নের আইনপ্রণেতা ক্লেয়ার ডালি। তিনি তার এক বক্তৃতায় উরসুলাকে ‘ ফ্র জেনোসাইড’ আখ্যা দিয়েছেন (ভৎধঁ হচ্ছে, জার্মান ভাষায় নারীদের সম্বোধনের একটি ভাষিক অলংকার)। তবে ডালির এই সম্বোধন নিছক আলংকারিক নয়। ডালি একজন প্রতিশ্রুতিশীল রাজনীতিক এবং অবিচারের বিরুদ্ধে তার ভাষণ হৃদয় থেকে উৎসারিত। তার মতো ভয়ডরহীন নারীর অসাধারণ ভূমিকা তরুণ নারীদের রাজনীতিক হতে উৎসাহী করে তোলে তিনি উরসুলা ভন ডার লিয়েনের মতো কেউ নন। উরসুলা ও তার মতো পক্ষপাতমূলক দৃষ্টি ধারণকারীদের জন্য ব্যাপারটি ভালোই; কারণ, মূলধারার দলগুলো উগ্রবাদীদের মোকাবিলা করতে ভয় পায়। এতে আগামী জুনের নির্বাচনে কট্টর ডানপন্থি দলগুলোর সমর্থনের জোয়ার দেখা যেতে পারে।
গত মাসে ইইউ কমিশন প্রেসিডেন্ট ঘোষণা দেন, তার মধ্যপন্থি ইপিপি ইউরোপের ডানপন্থি দলগুলোর সঙ্গে জোট গঠন করতে প্রস্তুত। এক্ষেত্রে স্পেন, পোল্যান্ড ও ইতালির ডানপন্থি দলগুলোও এতে ভিড়তে পারে। উরসুলার নিকটজনের ভাষ্য, তিনি ফ্রাতেলি দি’ইতালিয়া এবং চেক প্রজতান্ত্রের প্রধানমন্ত্রী পেত্র ফিয়ালার ওডিএস পার্টির মতো দলগুলোকে এক জায়গায় এনে ইউক্রেনপন্থি ও ইইউপন্থিদের একটি সেতুবন্ধন তৈরি করতে চান।
বামপন্থি নেতা ওয়ালটার বেয়ার অভিযোগ করেন, গাজায় ইসরায়েলিদের গণহত্যামূলক অপরাধ সত্ত্বেও উরসুলা যেভাবে ইসরায়েলের পক্ষে সংহতি জানিয়েছেন, তাতে বিশ্বমঞ্চে ইইউয়ের সুনাম ক্ষুণœ হয়েছে। বেয়ার বলেন, ‘তার (উরসুলা) আচরণে দ্বৈতনীতি প্রকাশ পেয়েছে। এটি অপ্রাত্যাশিত এবং এটা সৎ কোনো অবস্থান নয়।’ তিনি আরও মনে করেন, ইসরায়েলের কট্টর ডানপন্থি সরকারের পদক্ষেপের বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলাকে ইহুদিবিদ্বেষী কর্মকান্ড হিসেবে চিহ্নিত করা শুধু ভুলই নয়; বরং অন্যায় ও অস্বচ্ছ। এ নিয়ে তিনি আরও বলেন, বিষয়টি ইতিহাসবিরোধী এবং কোনো কার্যকারণহীন। সাধারণভাবে বলতে গেলে, তিনি (উরসুলা) পুরো বিষয়টিকে খারাপভাবে দেখভাল করছেন। বিষয়টি দক্ষিণ বিশ্বে ইউরোপের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ করছে। প্রকৃতপক্ষে ইহুদিবিদ্বেষকে অস্ত্র হিসেবে যেভাবে ওনউরাহর মতো এমপিরা ব্যবহার করেন তা বেশ দুর্বল। সেইসঙ্গে তারা ইসরায়েলি রাষ্ট্রের গণহত্যাকারী চরিত্রকে জটিল ও কঠিন বিষয় হিসেবে উড়িয়ে দেন।
আগামী মাসে ইউরোপের নির্বাচনটির ওপর সারা বিশ্বের মানুষের নজর সম্ভবত গাজাবাসীর চেয়েও বেশি থাকবে, যেখানে ইউরোপীয় মধ্যস্থতাকারীর ভণ্ডামি আরও একবার উন্মোচিত হয়েছে। ইসরায়েলের সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক অংশীদার হিসেবে ইউরোপ উপনিবেশবাদী ইসরায়েলের আগ্রাসন এবং তার দখলদারি বন্ধ করতে চাপ প্রয়োগ করতে পারত। তবে যতদিন উরসুলার মতো রাজনীতিকরা দায়িত্বে রয়েছেন, ততদিন এ রকমটা হয়তো ঘটবে না। এখন খুঁজতে হবে, কোথায় সেই সাহসী নারী, যিনি উরসুলাকে চ্যালেঞ্জ জানাবেন এবং তাকে পরাস্ত করতে সক্ষম?
মিডল ইস্ট মনিটর থেকে অনুবাদ : সামদানী প্রত্যয়
লেখক: ব্রিটিশ সাংবাদিক