বেস্ট ফ্রেন্ড আর ফ্রেন্ডের মধ্যে আসলে বিশাল একটা তফাত থাকে। সবাই বন্ধুর মতো পাশে থাকে না, আর সবাইকে নিজের সবচেয়ে কাছের বলা যায় না। একটা মানুষ তখনই আমাদের বেস্ট ফ্রেন্ড হয়, যখন তার মধ্যে আমাদের কিছু অংশ খুঁজে পাই। আমরা নিজের অজান্তেই ওর ভেতর নিজেদের প্রতিফলন দেখতে পাই। ওর হাসিতে নিজের হাসি, ওর রাগে নিজের রাগ, এমনকি ওর কষ্টেও নিজের কষ্টটা খুঁজে পাই। অনেকেই বলে, দুই মেরুর মানুষও নাকি ভালো বন্ধু হতে পারে, কিন্তু আমি মনে করি বেস্ট ফ্রেন্ডশিপের জন্য কিছু মিল থাকা একদমই জরুরি। কারণ, যাদের ভাবনা এক নয়, জীবনের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি এক নয়, তারা হয়তো একে অপরকে পছন্দ করতে পারে, কিন্তু কখনো গভীরভাবে একে অপরকে বুঝতে পারে না।
আমাদের জীবনে অনেক বন্ধু আসে যায়, স্কুলের বন্ধু, কলেজের বন্ধু, বিশ্ববিদ্যালয়ে — সবাই কোনো না কোনোভাবে আমাদের জীবনের অংশ হয়। কিন্তু তাদের সবার সঙ্গে সেই আবেগের বন্ধন তৈরি হয় না। যে মানুষটা আমাদের মন বোঝে, আমাদের কথা না বললেও বুঝে ফেলে কী হয়েছে, সেই মানুষটাই ধীরে ধীরে বেস্ট ফ্রেন্ড হয়ে ওঠে। এক সময় বুঝতে পারি, আমরা ওর সঙ্গে হাসতে পারি, কাঁদতে পারি, রাগ করতে পারি — তবুও সম্পর্কটা নড়ে না। কারণ বেস্ট ফ্রেন্ডের সম্পর্কটা কোনো মুখোশের নয়, ওখানে আছে বাস্তবতা, আন্তরিকতা আর গ্রহণ করার ক্ষমতা।অনেক সময় দেখা যায়, আমরা নিজেই বুঝি না কোন মুহূর্তে কেউ আমাদের সবচেয়ে কাছের হয়ে গেল। হয়তো একসাথে ক্লাসে বসতে বসতে, বা একদিন হুট করে জীবনের কষ্টের কথা বলতে বলতে বুঝে ফেলি — এই মানুষটার সামনে আমি কোনো কিছু লুকাতে পারি না। এখানেই বন্ধুত্ব আর বেস্ট ফ্রেন্ডশিপের পার্থক্য। বন্ধুর সঙ্গে আমরা সীমিত কথা বলি, কিন্তু বেস্ট ফ্রেন্ডের সঙ্গে আমরা সীমাহীন কথা বলতে পারি।বেস্ট ফ্রেন্ড মানে শুধু সেই না, যে সবসময় পাশে থাকে, বরং সেই যে আমাদের খারাপ দিকও জানে, তবুও আমাদেরকে বিচার না করে ভালোবাসে। সে জানে কখন তোমার মন খারাপ, কখন তুমি কেবল একটু মনোযোগ চাও। কথায় না বললেও বুঝে যায় — আজ কিছু একটা ঠিক নেই। এই বোঝাপড়ার জায়গাটা শুধু মিল থাকা মানুষদের মাঝেই তৈরি হয়। কারণ বেস্ট ফ্রেন্ড হচ্ছে তোমার আরেকটা রূপ, তোমার ভেতরের প্রতিবিম্ব।
অনেক সময় আমরা মুখে বলি — আমার আর আমার বেস্ট ফ্রেন্ডের কোনো মিল নেই, সব অমিল। কিন্তু সত্যি কথা হলো, এমন হলে তোমাদের বন্ধুত্ব টিকতো না। কারণ, যতই অমিল থাকুক, ভেতরে ভেতরে কোথাও না কোথাও একটা গভীর মিল থেকেই যায়। সেটা চিন্তায় হোক, মানসিকতায় হোক, বা জীবনের দৃষ্টিভঙ্গিতে। বেস্ট ফ্রেন্ড এমন মানুষ, যে তোমার কথা শেষ হওয়ার আগেই বুঝে ফেলে তুমি কী বলতে চাও।তবে আজকাল একটা বিষয় চোখে পড়ে, মানুষ খুব সহজে “বেস্ট ফ্রেন্ড” ট্যাগ দেয়। দুইদিনের পরিচয়ে কেউ বলে দেয় — “তুই আমার বেস্ট ফ্রেন্ড।” কিন্তু বেস্ট ফ্রেন্ডশিপ সময়ের মতোই ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে। এটা একদিনে হয় না, মাসখানেকের পরিচয়ে গড়ে ওঠে না। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আমরা মানুষটাকে দেখি, ওর ভেতরের সত্যিকারের রূপটা বুঝি, ওর সাথে আমাদের সংযোগ কতটা গভীর সেটা অনুভব করি — তখনই বোঝা যায় ও আসলেই বেস্ট ফ্রেন্ড কিনা।
স্বার্থের জায়গা থেকেও অনেকেই বন্ধুত্ব করে। যতদিন উপকার মেলে, ততদিন সম্পর্ক থাকে। কিন্তু যেইদিন স্বার্থ ফুরিয়ে যায়, সেদিন বন্ধুত্বের শেষ। অথচ আমরা তখনও হয়তো মনে করি, ও আমার বেস্ট ফ্রেন্ড। আসলে ওটা বন্ধুত্ব না, ওটা একটা ভুল সংজ্ঞা। সত্যিকারের বেস্ট ফ্রেন্ড কখনো তোমার বিপদে দূরে সরে যায় না, বরং তখনই পাশে আসে যখন সবাই দূরে যায়।
বেস্ট ফ্রেন্ড সেই, যে তোমার সাফল্যে গর্বিত হয়, আবার তোমার ব্যর্থতার সময় কাঁধে হাত রেখে বলে, “চিন্তা কোরো না, আমি আছি।” তোমার প্রতিটা ছোট জিনিস মনে রাখে, তোমার অজান্তেও খেয়াল রাখে তুমি ঠিক আছো কিনা। অনেক সময় তুমি হয়তো ভুল করছো, তবুও সে তোমাকে একটাও খারাপ কথা না বলে বোঝানোর চেষ্টা করে — কারণ ও জানে, তুমি মানুষ, ভুল তোমারও হতে পারে।
বেস্ট ফ্রেন্ডের সঙ্গে ঝগড়া হয়, রাগ হয়, কথা বন্ধও হয় — কিন্তু সম্পর্কটা কখনো শেষ হয় না। কারণ সেটা কোনো স্বার্থ বা শর্তের উপর দাঁড়িয়ে না, বরং দাঁড়িয়ে থাকে ভালোবাসা আর বিশ্বাসের উপর। এমন সম্পর্কেই আমরা নিজেদের সবচেয়ে সত্যিকারের রূপটা খুঁজে পাই।
সত্যিকারের বেস্ট ফ্রেন্ড খুব বেশি পাওয়া যায় না। জীবনের পথে হয়তো শত মানুষ আসে, কিন্তু এক-দুজনই থেকে যায় যাদের ছাড়া জীবনটা অসম্পূর্ণ মনে হয়। তারা কেবল বন্ধু নয়, তারা হয়ে ওঠে পরিবারের অংশ, আত্মার মতো কাছের কেউ। তাদের সাথে ঝগড়া হলেও মন খারাপ থাকে, কথা না বললেও মনে একটা টান থেকে যায়। কারণ তারা কেবল আমাদের জীবনের অংশ না, তারা আমাদের নিজেরই একাংশ।তাই বন্ধুত্ব আর বেস্ট ফ্রেন্ডশিপের মধ্যে পার্থক্যটা স্পষ্ট — বন্ধু হয়তো আমাদের সঙ্গে সময় কাটায়, কিন্তু বেস্ট ফ্রেন্ড আমাদের জীবনটা বোঝে। বন্ধু আমাদের হাসায়, কিন্তু বেস্ট ফ্রেন্ড আমাদের কান্নার কারণ জানে। বন্ধু পাশে থাকে আনন্দে, কিন্তু বেস্ট ফ্রেন্ড পাশে থাকে অন্ধকারেও।
আজকাল মানুষ “বেস্ট ফ্রেন্ড” শব্দটা যত সহজে ব্যবহার করে, তত সহজে তারা কাউকে হারিয়ে ফেলে। কারণ মানুষ এখন আবেগকে ব্যবহার করে, অনুভূতিকে নয়। কিন্তু সত্যিকারের বেস্ট ফ্রেন্ড কখনো বদলায় না, সময় যতই পেরিয়ে যাক না কেন। হয়তো যোগাযোগ কমে যায়, কথা বলা হয় না, কিন্তু মনে একটাই জায়গায় থেকে যায় — “ও ছিল, আছে, থাকবে।
শেষ পর্যন্ত বলতে হয়, বন্ধুত্ব মানে শুধু একসাথে থাকা না, বরং একে অপরকে সত্যিকারভাবে বোঝা। বেস্ট ফ্রেন্ড সেই যে তোমার হাসির আড়ালে লুকানো কান্না চিনে ফেলে, তোমার নীরবতায়ও তোমার কথা শুনে ফেলে। এমন মানুষ খুব কম পাওয়া যায়, কিন্তু একবার পেলে বুঝবে, জীবনে একটাই বেস্ট ফ্রেন্ড থাকাই যথেষ্ট — কারণ সে তোমার আরেকটা তুমি।
56
View