পোস্টস

চিন্তা

কী অপেক্ষা করছে আমেরিকার সামনে?

৪ জুন ২০২৪

সামদানী প্রত্যয়

মূল লেখক স্টিফেন কলিনসন

অনুবাদক সামদানী প্রত্যয়

যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে ফৌজদারি মামলায় দোষী সাব্যস্ত করেছে নিউ ইয়র্কের ম্যানহাটান আদালতের জুরি বোর্ড। ট্রাম্পের বিরুদ্ধে অভিযোগ, ২০০৬ সালে পর্নো তারকা স্টর্মি ড্যানিয়েলসের সঙ্গে যৌন সম্পর্ক করেছিলেন তিনি। এরপর ২০১৬ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে বিষয়টি নিয়ে মুখ বন্ধ রাখতে ১ লাখ ৩০ হাজার ডলার ঘুষ দেন ড্যানিয়েলসকে। তবে ব্যাবসায়িক নথিতে এই অর্থ লেনদেনের বিষয় গোপন রাখায় জালিয়াতির অভিযোগে ট্রাম্পের বিরুদ্ধে মামলা হয়। মামলায় তার বিরুদ্ধে ৩৪টি অভিযোগ আনা হয়। ট্রাম্পের জন্য বড় বিপদের কারণ, সব কটি অভিযোগেই তিনি দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন। আর এর মধ্য দিয়ে ইতিহাস রচনা করেছেন আলোচিত-সমালোচিত এই রিপাবলিকান নেতা। কেননা, ট্রাম্পই প্রথম কোনো সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট, যিনি ফৌজদারি অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হলেন।

 

দোষী সাব্যস্ত অপরাধী হওয়ার পরপরই ডোনাল্ড ট্রাম্পকে আইনের শাসনের ওপর নতুন করে আক্রমণ শুরু করতে দেখা গেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে কঠিন নীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত, সে কথা সবার জানা। যুক্তরাষ্ট্রের নীতি অনুযায়ী, আইনের দৃষ্টিতে সবাই সমান, তা তিনি যিনিই হোন না কেন। মার্কিন আইনের কোথাও বলা নেই যে, কোনো কোটিপতি আইনের ঊর্ধ্বে। একইভাবে এ-ও বলা নেই, সাবেক বা সম্ভাব্য প্রেসিডেন্টের বেলায় দায়মুক্তির সুযোগ আছে। এতে স্পষ্ট হয়, আদালতের রায়ে কেউ দোষী প্রমাণিত হলে তাকে নিশ্চিতভাবে সাজা ভোগ করতে হবে। তবে ট্রাম্পের মামলার রায়ে লক্ষ করা গেছে, কর্তৃত্ববাদী আচরণের বিস্ফোরণ ঘটিয়ে চলেছেন এই সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট।

 

রায় ঘোষণার পর মার্কিন বিচারব্যবস্থার প্রতি আঙুল তুলে শীর্ষস্থানীয় এই রিপাবলিকান নেতা হুমকির স্বরে বলেছেন, ‘এটা নিছক কারচুপি। এই বিচার অসম্মানজনক। প্রকৃত রায় হবে ৫ নভেম্বর। জনগণ খুব ভালো করেই জানে যে, এখানে কী ঘটেছে।’

ট্রাম্প একটি লিখিত বিবৃতিও জারি করেছেন। এই বিবৃতিতে এমন সব কথা বলা হয়েছে, যার মধ্য দিয়ে স্পষ্ট বোঝা যায়, নিজের ভাগ্য এবং দেশ—এ দুই বিষয়কে আলাদা করে দেখার লোক ট্রাম্প নন! বরং একজন স্বৈরাচারী নেতার বৈশিষ্ট্যই তার মধ্যে বেশি লক্ষণীয়। বিবৃতিতে ট্রাম্প লিখেছেন, ‘আমি একদমই নির্দোষ। তবে আমি বলে রাখছি, আমি দেশের জন্য লড়ছি। আমি আমাদের সংবিধানের জন্য লড়াই করছি।’ তিনি এমন কথাও অবলীলায় বলেছেন, ‘আমাদের পুরো দেশে এখন কারচুপি করা হচ্ছে।’ এ ধরনের কথা সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্টের মুখে কতটা শোভা পায়?

 

মুখে যাই বলুন না কেন, রায়ের পর ট্রাম্প যখন আদালতকক্ষের বাইরে বের হন, তখন তার মুখ দেখেই পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছিল, এই রায়ের মধ্য দিয়ে তিনি কঠিন যন্ত্রণায় পড়েছেন। এটা আসলেই ট্রাম্পের জন্য বিরাট যন্ত্রণাময় মুহূর্ত! আসন্ন মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়লাভের মাধ্যমে তিনি যে নতুন মেয়াদে মার্কিন প্রেসিডেন্টের চেয়ারে বসার অভিলাষ পোষণ করে আসছেন, এই রায় তার ওপরও বেশ প্রভাব ফেলবে। সব মিলিয়ে ট্রাম্প এক কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন।

 

আগামী ১১ জুলাই এই মামলার আনুষ্ঠানিক রায় ঘোষণা করা হবে। এর দিন কয়েক আগে রিপাবলিকান ন্যাশনাল কনভেনশনে নিজের মনোনয়ন নিশ্চিত করবেন ট্রাম্প। ইতিমধ্যে তিনি বলা শুরু করেছেন, তার ওপর ‘রাজনৈতিক নিপীড়ন’ চালানো হচ্ছে। এ ধরনের কথা প্রচারের পেছনে যে তার ‘রাজনৈতিক কৌশল’ নিহিত আছে, তা-ও স্পষ্ট বোঝা যায়। সমর্থকদের তিনি প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন যে, শত্রুদের বিরুদ্ধে ‘প্রতিশোধ’ নেওয়া হবে এবং মূলত এ কারণেই দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসতে চান। এসব কথা বলে ট্রাম্প সত্যিকার অর্থেই ক্রমাগত ‘মেরুকরণ’ সৃষ্টি করে চলেছেন ভোটারদের মধ্যে। তবে তিনি যা-ই বলুন না কেন, ভোটারদের যা-ই বোঝাতে চেষ্টা চালান না কেন, কোনো সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্টের এভাবে দোষী প্রমাণিত হওয়ার ঘটনা আমেরিকার রাজনৈতিক ইতিহাসে এক মর্মান্তিক ও দুঃখজনক অধ্যায় হয়ে থাকবে। আমেরিকানরা এর আগে কখনোই কোনো সাবেক প্রেসিডেন্টকে অপরাধের দায়ে দোষী সাব্যস্ত হতে দেখেনি। এমনকি এ ধরনের তিক্ত রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মেরুকরণও যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে বিরল। 

 

আমেরিকা প্রকৃত অর্থেই এক ‘নিশ্চল পাথুরে সময়’ পার করছে।

 

একটা বিষয় বিশেষভাবে লক্ষ করার মতো। বিগত বেশ কয়েক মাস ধরে ভোটারদের প্রস্তুত করছেন ট্রাম্প। তিনি যে দোষী সাব্যস্ত হবেন, তা তার জানাই ছিল। এমন একটি অবস্থার মুখে তিনি বার বার দাবি করছেন, তার বিরুদ্ধে যে চার চারটি অপরাধমূলক অভিযোগ আনা হয়েছে, তা তাকে ধ্বংস করার জন্যই। ভোটারদের উদ্দেশে তিনি ঘটা করে প্রচার করছেন, তাকে দমিয়ে রাখতে এটা প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের চক্রান্ত।

 

আরো একটা বিষয় আছে। ‘একজন অপরাধীর পক্ষে প্রেসিডেন্ট হিসেবে কাজ করা হবে চিন্তার বাইরে’—এই আদর্শ ভেঙে ফেলার জন্যও কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন ট্রাম্প। ভোটাররা একে কীভাবে দেখছে, এর প্রতিক্রিয়াই বা কী হবে, তা কেউ জানে না। তবে এত কিছুর পরও শেষ পর্যন্ত সত্যি সত্যিই যদি ট্রাম্প নির্বাচনে জিতে যান, তা হবে আমেরিকার ইতিহাসে আরেক স্মরণীয় অধ্যায়। যদি ট্রাম্পই ৪৭তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে মার্কিন সংবিধানের রক্ষাকর্তার ভূমিকায় অবতীর্ণ হন, তাহলে আমেরিকা পরিচালিত হবে একজন অপরাধীর নেতৃত্বে। সেই অবস্থায় বিচারব্যবস্থার কী দশা হতে পারে, তা-ই বড় প্রশ্ন। এটা আমেরকার জন্য আসলেই বিরাট চিন্তার বিষয়। এর কারণ, ২০২০ সালের নির্বাচনে হেরে গিয়েও ক্ষমতায় থাকার জন্য ট্রাম্প কী ধরনের প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন, তা থেকেই বোঝা যায়, নিজেকে বাঁচাতে যা করা দরকার, সবই করবেন তিনি। এমনকি যদি তার কাজকর্মে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো বিপর্যয়কর পরিস্থিতিতে পড়ে যায়, তাতেও তার কোনো ভাবান্তর থাকবে না।

 

ট্রাম্পের বিচারের রায়ের পর এক গভীর প্রতিক্রিয়ায় ইতিহাসবিদ টিমোথি নাফতালি মন্তব্য করেছেন, দেশের আইনি ব্যবস্থার বিরুদ্ধে কটাক্ষ করা এবং ক্ষমতায় গিয়ে এর প্রতিশোধ নেওয়া—এমন সব প্রচারণার পেছনে ট্রাম্পের ভিন্ন উদ্দেশ্য আছে। এ ধরনের জ্বালাময়ী আহ্বানের মাধ্যমে রিপাবলিকান কর্মী বা সমর্থকদের আসন্ন নির্বাচনে তাকে জেতাতে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য খেপিয়ে তোলা হচ্ছে! আমার দৃষ্টিতে এটা ‘একটি বিষের স্রোত’ তৈরি করতে চলেছে, যা আমরা আলোচিত ৬ জানুয়ারির আগে ‘স্টপ দ্য স্টিল’ প্রচারাভিযানেও দেখেছিলাম। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, সেদিনকার চেয়েও খারাপ হতে চলেছে এবারের অবস্থা! এর মধ্য দিয়ে ‘সংবেদনশীল দেশ’ হিসেবে অবিহিত আমেরিকা ক্রমশ অস্থির হয়ে উঠবে। নাফতালি আরো বলেছেন, আমি উদ্বিগ্ন এ কারণে যে ‘স্টপ দ্য স্টিল’ প্রচারাভিযান আমেরকাির নির্বাচনি ব্যবস্থার সততা ও স্বচ্ছতা সম্পর্কে ব্যাপক সন্দেহ তৈরি করেছিল। অনেকে বিশ্বাস করতে শুরু করেছিলেন যে, ২০২০ সালের নির্বাচনে জালিয়াতি হয়েছে।

 

দেশের বিচারব্যবস্থাকে জড়িয়ে ট্রাম্পের প্রচার-প্রচারণা বেশ কাজেও দিচ্ছে! দোষী সাব্যস্ত হওয়ার পরও ট্রাম্পের প্রতি সমর্থন আছে ৫০ শতাংশের বেশি রিপাবলিকানের। এমনকি অনেক রিপাবলিকান নেতা কড়া প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছেন ট্রাম্পের সঙ্গে তাল মিলিয়ে। যেমন—ট্রাম্পের সম্ভাব্য ভাইস প্রেসিডেন্ট রিপাবলিকান নেতা নিধি এলিস স্টেফানিক হুংকার দিয়েছেন, ‘আজকের রায় দেখায় যে, জো বাইডেন ও ডেমোক্র্যাটদের অধীনে বিচারব্যবস্থা কতটা দুর্নীতিগ্রস্ত, এখানে কী ধরনের কারচুপি চলে এবং এই প্রতিষ্ঠান কতটা অ-আমেরিকান হয়ে উঠেছে।’

 

হাউস স্পিকার মাইক জনসন মন্তব্য করেছেন, ‘আজকের দিনটি আমেরিকার ইতিহাসে একটি লজ্জাজনক দিন। ডেমোক্র্যাটরা উল্লাস করছে; কারণ, তারা বিরোধী দলের নেতাকে হাস্যকর অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করতে সফল হয়েছে।’

রিপাবলিকান নেতা লুইসিয়ানার ভাষ্য, ‘এটা সম্পূর্ণ রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড। এখানে আইনকে তোয়াক্কা করা হয়নি। ট্রাম্পের আরেক শীর্ষ সহযোগী সাউথ ক্যারোলিনার সেন লিন্ডসে গ্রাহাম বলেছেন, ‘এই রায় রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। এটা ন্যায়বিচারের প্রতি উপহাস।’

 

রিপাবলিকানরা যা-ই বলুন না কেন, আসল কথাটি বলেছেন ইতিহাসবিদ নাফতালি। তার ভাষায়, আমেরিকার সামনে এক কঠিন অস্থির সময় অপেক্ষা করছে। ট্রাম্পের বিরুদ্ধে বিচারের রায় এসেছে বটে, তবে এখনো ‘চূড়ান্ত রায়’ আসেনি। আমেরিকার ভবিষ্যত্ নির্ভর করছে সেই চূড়ান্ত রায়ের ওপরেই। সেই চূড়ান্ত রায় কবে হবে? আগামী নভেম্বরের ভোটে!

 

 

লেখকঃ সিএনএন এর কলামিস্ট

সিএনএন থেকে অনুবাদঃ সামদানী প্রত্যয়