নীরবতার ভিতরে তুমি
পর্ব ৩
রিশাদ সেই রাতে ঘুমাতে পারেনি। মায়ের মুখ, বাবার চিৎকার, গ্রামের সবার চোখ—সব একসাথে মাথার ভেতর যেন বাজছিল। ভোরের আলো ফুটতেই সে উঠল। বাইরে তখনো ঘুমিয়ে আছে মানুষ, কিন্তু রিশাদের ভিতরে কোনও ঘুম নেই। তার বুকের ভিতরে একটাই কথা—
“আমি হারবো না।”
সে নদীর দিকে হাঁটতে লাগল। ঠান্ডা বাতাস বইছে। নদীর জল কুয়াশায় ঢেকে আছে। রিশাদ নিজের হাতদুটো পানিতে ডুবিয়ে রেখে বলল,
“এই জীবনটা আমি বদলাবো। যে যত অপমান দিয়েছে, সব আমি একদিন প্রমাণ দিয়ে ফিরিয়ে দেব।”
গ্রামে সবাই ভাবত রিশাদ নাকি ‘কিছু করতে পারবে না’। পড়াশোনা নেই, টাকা নেই, সম্পর্ক নেই—তাহলে স্বপ্ন কোথা থেকে আসবে?
কিন্তু মানুষ ভুলে যায়—স্বপ্ন টাকা দিয়ে আসে না, সাহস দিয়ে আসে।
রিশাদ কাছে শহরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। কিন্তু যাওয়ার টাকা নেই। তাই সে কাজ খুঁজতে বের হয়। প্রথমে ধানের গোলায় দিনমজুরের কাজ পেল। রোদে পোড়া মুখে সে কাজ করত, আর রাতে লণ্ঠনের আলোয় গল্প লিখত। প্রতিটা শব্দে ছিল তার কষ্ট, তার লড়াই, তার বেঁচে থাকা।
একদিন গোলার মালিকের মেয়ে, নাম মেহরিন, রিশাদকে লিখতে দেখে বলল—
“তুমি কি লেখক?”
রিশাদ মাথা নিচু করে বলল—
“কে জানে। শুধু মনে হয় কথা জমে থাকে, তাই লিখি।”
মেহরিন হেসে বলল—
“একদিন তুমি অনেক বড় হবে। কারও বিশ্বাস লাগবে না, শুধু নিজেরটুকু রাখো।”
এই কথা রিশাদের মনে আগুন ধরিয়ে দিল।
জীবনে প্রথম কারও মুখে সে নিজের জন্য বিশ্বাস শব্দটা শুনল।
তারপর রিশাদ শহরে এসে একটি ছোট বইয়ের দোকানে কাজ পায়। সেখানে পুরনো বই, ধুলাবালি, আর মানুষের কথাবার্তার ভিড়। কিন্তু রিশাদ প্রতিদিন বইয়ের ফাঁকে ফাঁকে নিজের গল্প লিখত।
সময় গেলে লেখা বাড়ল। শব্দগুলো গভীর হলো।
হঠাৎ একদিন শহরে একটি লেখা প্রতিযোগিতা ঘোষণা হলো।
পুরস্কার—নিজের বই প্রকাশ করার সুযোগ।
রিশাদ আবেদন করল।
ভয়ে ভয়ে।
গ্রাম, অপমান, স্বপ্ন—সব ভর করে ছিল তার কাগজের পাতায়।
ফলাফল ঘোষণার দিন।
লোকজন ভিড়।
রিশাদ দাঁড়িয়ে চোখ নিচু করে।
তৃতীয় স্থান
দ্বিতীয় স্থান
প্রথম স্থান—
ঘোষণা হলো,
“রিশাদ আহমেদ।”
হলভর্তি হাততালি।
কিন্তু রিশাদের কানে শুধু মায়ের কণ্ঠস্বর বাজল—
“তুই পারবি না।”
আর সে হাসল।
ধীর, গভীর, শান্ত একটা হাসি।
যেন বলছে—
“আমি পেরেছি।”
(চলবে — পর্ব ৪ এ শুরু হবে রিশাদের বই প্রকাশ, খ্যাতি এবং মেহরিনের সঙ্গে সম্পর্কের পরিবর্তন)